চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রাঙ্গুনিয়ার ৫ জয়িতার জীবনযুদ্ধ

জিগারুল ইসলাম জিগার , রাঙ্গুনিয়া

১৮ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০১ পূর্বাহ্ণ

 

একাগ্রতা ও পরিশ্রমে সফলতা পেয়েছেন রাঙ্গুনিয়ার পাঁচজন নারী। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা মহিলাবিষয়ক দপ্তরের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সম্প্রতি এই ৫ সফল নারীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।

 

শিপ্রা বড়–য়া: শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী শিপ্রা বড়–য়া রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দবাড়ি গ্রামের শৈবাল তালুকদারের স্ত্রী। ৫ ভাই ৩ বোনের সংসারে দরিদ্রতার কারণে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শিপ্রাকে এইচ.এস.সি পড়ালেখাকালীন সময়েই বিয়ে দেয় তার মা-বাবা। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতেও দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়েনি। সেখানে ৭ বোন, ২ ভাই ও বিধবা মায়ের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল তার স¦ামী শৈবাল। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার মেয়ে হয়েও শ্বশুরবাড়িতে এসে পাতা কুড়ানো, জ¦ালানি সংগ্রহ করা, ধান শুকানো, বাটনা বাটা, গোবর লাঠি বানানো সেরে জমিতে বীজ বপন করা, সেলাই কাজ করাসহ এমন কোন কাজ নেই যেটা তাকে করতে হয়নি। সারাদিন ধরে এসব করে সন্ধ্যায় ছোট দেবর-ননদদের পড়াতেন তিনি। প্রতিকূলতার মাঝেও সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন। এরপর বিএড ট্রেনিং শেষে এম-এ পাস করেন। কর্মজীবনের শুরুতেই নিজের মেধা দিয়ে তিনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরিতে যোগদান করেন। তার বড় মেয়ে বর্তমানে ইংরেজিতে এম-এ এবং ছোট মেয়ে গণিতে এম-এ পাস করে শিক্ষকতা করছেন।
মদিনা বেগম: জীবনযুদ্ধে সফল নারী মদিনা বেগম। উপজেলার হোছনাবাদ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের খিল মোগল গ্রামের কৃষক পরিবারে তার জন্ম। ১৯৭৩ সালে এসএসসি পাস করেই দরিদ্রতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় তার। এর আগে ১৯৭১ সালে স¦াধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্না-বান্না, বাজার করা ও খবরাখবর সংগ্রহ করার কাজ করেছেন। ১৯৭৪ সালে রাঙ্গুনিয়ার ইছাখালীতে আরডিপি’র একটি কর্মসূচিতে মহিলা পরিদর্শক পদে যোগদান করেন। ১৯৭৬ সালে রাঙ্গুনিয়ার মরিয়মনগর এলাকার আইয়ুব আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। তার সংসারে রয়েছে ২ ছেলে ও ২ মেয়ে। ১৯৭৭ সালে স্বামীর আপত্তির মুখে চাকরি ছাড়লে পরিবারে অভাব-অনটন ও নানান মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে তার স্বামী তাদের রেখে নিরুদ্দেশ হলে সন্তানদের চালাতে গিয়ে শুরু করেন সেলাই কাজ, বাঁশ-বেতের কাজ, জাল বোনা, কৃষিকাজ ইত্যাদি। নানাভাবে পরিশ্রমে সন্তানদের তিনি উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তার বড় ছেলে আবু মনছুর চট্টগ্রাম ওয়াসায়, মেঝ ছেলে আবু বকর এম.কম পাস করে চট্টগ্রামের হেড অব এপারেল মার্চেন্ডাইংয়ে ও মেয়ে মালেকা নাছরিন বানু ¯œাতক পাস করে শিক্ষকতা করছেন। আর ছোট মেয়ে মালেকা শিরিন বানু এইচএসসি পাস করেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন সেবামূলক কাজে জড়িত থাকার স্বীকৃতিস্বরূপ পরপর ২ বার হোছনাবাদ ইউনিয়নে ইউপি সদস্যা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও হোছনাবাদ ইউনিয়নের প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, ব্র্যাক সংস্থার সহযোগিতায় ৩টিরও অধিক ব্র্যাক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষাক্ষেত্রে রাখেন বিশেষ অবদান। গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া ছেলে মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে সেলাই, বাটিক-বুটিক, কার্পেন্টার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এভাবে জীবনযুদ্ধে নানান ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন মদিনা বেগম।

 

রাশেদা আকতার: রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তিন সৌদিয়া গ্রামের আহম্মদ শুক্কুর ও আলোয়ারা বেগমের কন্যা সন্তান রাশেদা আকতার। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী এই নারী তার পিতা-মাতার ৭ সন্তানের মধ্যে সবার বড়। পাহাড় থেকে লাকড়ি কাটার টাকায় সংসার চলতো তাদের। অভাব অনটনের কারণে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন তিনি। সংসারের দরিদ্রতা ঘোচাতে তিনিও মায়ের সাথে পাহাড় থেকে লাকড়ি কাটা এবং গ্রামের ছোট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। একসময় তিনি সেলাইয়ের কাজ শেখেন এবং টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রথমে একটি সেলাই মেশিন এবং পরবর্তীতে ৩টি মেশিন কিনে একটি সেলাইয়ের দোকান দেন। তার দোকানে সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি তিনি অন্যান্য নারীদেরও প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ শুরু করেন। আর এই উপার্জন দিয়ে তিনি সংসার চালানো ও ছোট ভাই বোনদের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। রাশেদার সেলাই দোকানে গ্রামের অনেক মেয়ে কাজ শিখে নিজেরাও হয়েছেন স্বাবলম্বী। বর্তমানে রাশেদার দোকানে ২ জন পুরুষ ও ১০ জন মহিলা কর্মচারী রয়েছে।
শেলী দাশ: রাঙ্গুনিয়ার পার্শ¦বর্তী রাউজান উপজেলার পূর্ব গুজরা গ্রামের তপন দাশ ও মঞ্জু মহাজনের ৩ কন্যা ও ১ পুত্র সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান শেলী দাশ। বিয়ের পর এখন তিনি রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড ঠা-াছড়ি গ্রামের স্বামীর বাড়িতে থাকেন। তিনি শ্বশুরবাড়ি এলাকার আশপাশের লোকদের বিভিন্ন সমস্যায় দিনরাত পাশে থেকে সাহায্য করতেন। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের বিপদে পাশে থাকার কারণে সবার ভালবাসায় বর্তমানে রাজানগর ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যা নির্বাচিত হন। মহিলা মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে ও পরে তিনি এলাকার মহিলাদের পারিবারিক বিবাদ মিটানোসহ নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে মহিলাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেছেন। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড প্রাপ্তিতে এলাকার দরিদ্র, অসহায় জনগণকে সহযোগিতা করেন। এলাকার মহিলাদেরকে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য তিনি তাদেরকে উৎপাদনমুখী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণে পরামর্শ দান ও ঋণ গ্রহণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছেন।

 

মনজুরা বেগম: সংসার জীবনে নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা সফল নারীর নাম মনজুরা বেগম। রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড ফকিরখীল গ্রামের আহমদ মিয়া ও মাহমুদা খাতুনের সন্তান তিনি। মঞ্জুরার বিয়ে হয় ১৯৭৪ সালে। তার স্বামী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বিয়ের পর থেকে সুখেই সংসার চলছিল তার। পরিবারে চার ছেলে চার মেয়ে নিয়ে মনজুরার সংসার। সংসার জীবনের এক পর্যায়ে তার স্বামীর জীবনে চলে আসে অন্য এক নারী। এদিকে ছোট ৮ সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবেন সেই চিন্তায় তালাক পেপারে স্বাক্ষর না করায় স্বামী তার ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতনের এক পর্যায়ে ছোট ৮ সন্তানসহ তাকে ঘরছাড়া করেন তার স্বামী। সংসারহারা মনজুরা স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন, যেখানে তার মামলা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না।

 

একদিকে সংসারে অভাব অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ, সাথে আবার মামলা চালাতে গিয়ে একেবারে দিশেহারা অবস্থা তার। একপর্যায়ে তাকে আলোর পথ দেখালো বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড। উক্ত সংস্থার সহায়তা পেয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে তিনি গ্রাম্য কুটির শিল্পের কাজ শুরু করেন। একসময় মামলাতেও জয়ী হন তিনি। কুটির শিল্প থেকে উপার্জিত টাকায় তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে অবশেষে সুখের জীবনের সন্ধান পান। তার মতো অসহায় ও নির্যাতিতা নারীদের সাহায্য করতে গিয়ে ২০১১ সালে রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট