চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নারী-শিশু সহিংসতা প্রতিরোধে চাই ‘জনসচেতনতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ’

শাহিদা আকতার জাহান

২৪ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৪ পূর্বাহ্ণ

ঠরড়ষবহপব এর অভিধানিক অর্থ হচ্ছে হিং¯্রতা বা সহিংসতা। এই ঠরড়ষবহপব আমরা যে অর্থেই গ্রহণ করি না কেন, এই ঠরড়ষবহপব একটি সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন ধরেই নারীর সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘটে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও নারী নির্যাতন, শিশু নিযার্তন, যৌতুক, মাদক, বাল্য-বিবাহ নিন্দিত একটি প্রথা। এই প্রথা নারীর মৌলিক অধিকার, সামাজিক অধিকার ও নারীর স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেই যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত আছে, সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। রাষ্ট্র কোন নাগরিককে আলাদাভাবে দেখবে না। সবক্ষেত্রে সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের একই অধিকার, একই স্বীকৃতি থাকার পরও প্রতিনিয়ত নারী-শিশুর স্বাধীনতা লঙ্ঘন হচ্ছে দিনের পর দিন। নারী-শিশুর সহিংসতা পারিবারিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক ধর্মীয় বলয়ের পরিম-ল থেকে সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে নারীরা যে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা বলাবাহুল্য। পারিবারিক বলয়ে নিযার্তন, সামাজিক নিযার্তন, রাষ্ট্রীয় কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি কর্তৃক নিযার্তন, পৃতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, বাল্য-বিবাহ, বহু-বিবাহ, মাদকের সহজলব্যতা, মাতাল স্বামী কর্তৃক অশোভন ভাবে স্ত্রী নিযার্তন, মারধর করা, যৌতুকের কারণে নিযার্তন। স্বামীর বখাটেপনার নিযার্তন, স্ত্রীর ভরন-পোষন দিয়ে নিযার্তন, প্রেম প্রত্যাখ্যানে নিযার্তন, কু-প্রস্তাবে রাজি না হলে নিযার্তন, তালাক, দেন-মোহর, যৌন নিযার্তন, অপহরণ, ইভটিজিং, দাম্পত্যকলহের জের ধরে নিযার্তন, নারীর প্রাপ্ত সম্পত্তির অধিকার নিয়ে নিযার্তন, এসিডে মুখ ঝলসে দিয়ে নারীকে নিযার্তন ও হত্যা। আরো ভয়াবহ হলো পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে মা-বাবা আপন সন্তানদেরকে পাশবিক অত্যাচার-নিযার্তন, মুখে বিষ ঢেলে, গলাটিপে নির্মমভাবে হত্যা করে, আবার দেখা যায় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় কেরাসিন ঢেলে দিয়ে আগুনে পুড়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বামীর বহুবিবাহ মেনে না নেওয়া, পরকীয়া প্রেমে বাধা দেওয়ায় হত্যার শিকারও হচ্ছে নারীরা। আবার দেখা যায় মা-বাবা, ভাইয়ের পছন্দমত ছেলেকে বিয়ে না করলে পরিবার কর্তৃক শারীরিক মানসিক নিযার্তনের শিকার। নারীর বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ মনোভাব, স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে শারীরিক সর্ম্পকে বাধ্য করা, নারী-শিশু পাচার। একজন নারীকে শুধু তার স্বামী নিযার্তন করছে তা নয়, স্বামীর পরিবারের একাধিক সদস্য মা-বাবা, ভাই-বোন, জা-ননদ, দেবর-ভাসুর সবার দ্বারা নারী নিযার্তিত হচ্ছে।
একের পর এক নারী-শিশু নিযার্তনের ঘটনায় দেশের মানুষ বিব্রত-মর্মাহত। সর্বশেষ ৭ বছরের শিশুকে ধর্ষন করে হত্যা। মুখে রক্ত, ঠোঁটে নরপিশাচের কামড়ের দাগ, ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। নাম সামিয়া আফরিন সায়মা, রাজধানীর ওয়ারী সিলভারডেল স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ফুলের মত নিষ্পাপ একটি শিশুকে ধর্ষনের পর হত্যা? কি বর্বরতা? কি মর্মস্পর্শী নির্মমতা, ৭ বছরের একটি শিশুর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। পারছিনা ঘর থেকে বাইরে কোথাও নারী-শিশুর নিরাপত্তা দিতে। বিকৃত যৌন উন্মাদনার শিকার এই ছোট্ট শিশু পরিটি? নিথর দেহ পড়ে ছিল ৯তলার একটি নির্জন খালি ফ্লাটের এক কোণে? নিউজটি পড়ে অন্তর কেঁদে উঠলো, চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, দুঃখে-কষ্টে-অপমানে। হায়রে মানুষ! হায়রে পুরুষ! সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ সৃষ্টি করেছেন ভালো কাছ করার জন্য। আর মানুষ শয়তানের চেয়েও নিকৃষ্ট। এ ছোট্ট শরীলে কী রূপ ছিল? কী যৌনতা ছিল? দিনদিন মানুষ নরপিশাচে পরিণিত হচ্ছে। মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, বরগুনায় রিফাতকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা আর এর রেশ কাটতে না কাটতেই ৭ বছরের শিশু সামিয়াকে ধর্ষন করে হত্যা? কী হচ্ছে দেশে?
এ ঘটনার পর দেশ জুড়ে চলছে বিক্ষোভ। এভাবে চলতে পারে না। সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে নিযার্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বর্তমানে অত্যন্ত নাজুকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে শিশু-কিশোরী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীরাও। তাদের মধ্যে কেউ পরিবারে কেউ আবার মহান দ্বায়িত্বে থাকা শিক্ষক দ্বারা লাঞ্চনার শিকার হচ্ছে। শিক্ষক হল জাতির পথপ্রদর্শক। সেই মহান পেশায় দায়িত্বে থাকা শিক্ষক নামের অভিভাবকটিও নাম লেখাচ্ছেন ধর্ষকের খাতায়। পবিত্র শিক্ষাঙ্গন আজ অপবিত্র। নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে নির্যাতিতদের অভিভাবকরা। সাথে কাঁদছে পুরো দেশ, পুরো জাতি। যেখানে রেহাই পাচ্ছে না ৬-৭বছরের শিশুও। আবার ধর্ষন করার পর হত্যাও করা হচ্ছে। এছাড়া পরিবারে আপন লোকদের হাতে চার দেয়ালের মাঝেও নারী-শিশু নিযার্তনের শিকার হচ্ছে অহরহ। আপন পিতার কাছে, ভাই, আত্নীয় স্বজনদের হাতে। আপন মেয়ে সন্তান নিরাপদ নয় তাদের নিকটতম আপন লোকদের কাছে, কিংবা বখাটেদের কাছে। পৃথিবীতে মা-বাবা হলো সন্তানদের নিরাপথ স্থান আজ তাদের কাছেও কিছুক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা ভুগছে সন্তানরা। মার হাতে খুন হচ্ছে আপন সন্তান, বাবার হাতে নিযার্তন হচ্ছে খুন হচ্ছে তার অবুঝ সন্তান। তবে সব পিতা-মাথা একই নয়। সমাজে কিছু পিতা-মাতা, নামের নরপশু আছে আমি তাদের কথা বলছি।
আজকের সমাজ ব্যবস্থায় ৬ থেকে শুরু করে যে কোন বয়সের নারী-শিশুরা প্রতিনিয়ত নিযার্তনের শিকার হচ্ছে। আমরা আমাদের শিশু সন্তানদেরকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না। তাদেরকে শারীরিক মানসিক ও সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। পত্রিকার পাতায় আমরা প্রতিনিয়ত এ হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো দেখতে পাচ্ছি। বিরামহীন ভাবে চলছে ধর্ষন। একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা মানুষের জন জীবনকে অস্থির করে দিচ্ছে। এখানে শুধু কঠোর আইন করে নারী-শিশু নিযার্তন বন্ধ করা সম্ভব নয়। আইনের অনেক ফাঁক থাকে। তাই নারী-নির্যাতন সম্পর্কে সচেতনতা দরকার। যত বেশি নির্যাতন নিয়ে প্রচার হবে, ততবেশি সচেতন হবে মানুষ। শিশুকাল থেকেই নারী-শিশু নিযার্তন বিষয়ে পড়ালেখা এবং স্কুল-কলেজে এসব বিষয় নিয়ে সচেতনামুলক ক্লাস। সর্বোপরি পরিবার থেকে সবচে বেশী শিক্ষা দিতে হবে। অনেক পরিবার আছে মেয়ে সন্তান জন্ম গ্রহণের পর সাদরে গ্রহণ করে। তারা বুঝতে পারে, কিন্তু পরিবারের সম্মানের কারণে কিছু বলে না। তারা এটুকু বুঝতে পারে তারা শুধু দৈহিক নয়, মানসিকভাবেও নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। পরিবারে মা-ই একজন ছেলে-মেয়ের ভেতর একটা বৈষম্য তৈরি করে। মা’দের সবসময় বলতে শুনা যায় মেয়েরা ঘরের কাজ করবে, তাকে রান্নাবান্না শিখতে হবে, তাকে বিয়ে দিতে হবে। অন্যদিকে ছেলেরা পড়াশুনা করবে, আয় রোজগার করবে, এ প্রক্রিয়া তাদের ভিতর এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, মেয়েরা মনে করে এটাই সমাজ, এটাই নিয়ম, এটাই সত্য। আজকে নারীর অধিকার, নারী-শিশু নিযার্তন নিয়ে বেশি চিন্তিত সবাই। কারণ নারী-শিশু নিযার্তন সহিংসতা, এটি কোন লোকাল প্রবলেম নয়, এটি একটি গ্লোবাল প্রবলেম। নারীদের সমাজের মূল স্রােতধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্টা করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন সচেতনতা বোধ সবার মাঝে জাগিয়ে তুলতে হবে। মানুষের মন- মনন ও মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।
একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি জাতি নিয়ে আমাদের সামাজিক অবস্থান। পারিবারিক বলয়ে সহিংসতা শব্দটি অত্যন্ত জটিল। সহিংসতার সাথে জড়িত ‘পারিবারিক বলয়’। ‘পরিবার’ একটি মধুরতম শব্দ এ শব্দটির সাথে সহিংসতা বা নির্যাতন শব্দটি জড়িত। পরিবার একটি দেশ ও সমাজের ভিত্তি। আর এ সমাজের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে একটি রাষ্ট্র। পরিবার-সমাজ-দেশ তথা এই ব্রহ্মা- নারী ও পুরুষের পাশাপাশি অবস্থানের পারস্পারিক সৌহাদ্য, ভ্রাতৃত্ব আর ঐক্যবোধের মাঝেই ক্রমবিকাশের পথ ধরে আধুনিক সভ্য সমাজের স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতি তখনই পূর্ণতা পাবে যখন এই ব্রহ্মা-ের নারী সমাজের, সামাজিক মুক্তি, অর্থনৈতিক মুক্তি, মানসিক মুক্তি মিলবে। সাথে মুক্ত হয়ে নিজস্ব বিবেক ও নিজস্ব ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে। নারী শুধু পরিবারের সম্পদ নয়, নারী হবে বিশ্বের সম্পদ। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে নিষ্পাপ শিশু সায়মাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে না পারলে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষের অধিক মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা পুরোপুরি অর্থহীন।

লেখক-সদস্য, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট