চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

এখনো গেল না আঁধার

ছন্দা দাশ

২৪ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৪ পূর্বাহ্ণ

অনেকদিন পর আকাশ চিরে বৃষ্টির ফোটা নেমে এলো। অসহ্য গরমে জীবন বিষময় হয়ে উঠেছে সবার। কিছু বৃষ্টি ধারা এত ক্ষীণ তাতে গরমে যেন জীবন আরো অসহনীয়। তবুও প্রথম আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টির ধারাপাত। মনে তো তার সুর বাজবেই। নব মেঘের রূপ দর্শনে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসেছি। চোখে পড়লো খবরের কাগজের পাতায়। আজকাল খবরের কাগজও যেন আগের মতো টানে না। সেই একই খবর খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস। চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি হেড লাইনের উপর। হঠাৎ এক জায়গায় এসে চোখ হোঁচট খায়। পঞ্চাশ বছরের বুড়োর সাথে পনের বছরের শিশুর বিয়ে। এবং যৌতুকের জন্য বধু নির্যাতন। ধাক্কা খেলাম। এখনো কি আমরা সেই যুগে পড়ে আছি? তাহলে কি আমাদের অগ্রগতি? এই যে এত যে প্রগতির এত জয় জয়কার তার প্রমাণ কি এটাই? হয়তো অনেকের অভিমত এমন তো দু’একটা হবেই। কিন্তু এই ডিজিটাল সময়ে একটাই বা হবে কেন? সকালের প্রথম বর্ষার প্রথম বৃষ্টি দেখার সুখটুকু আমার আর হলো না। মনের ঘরে তখন এসে ঢুকেছে বাল্য বিবাহের মতো একট অভিশপ্ত নারী জীবন। এত প্রচার এত প্রসার, এত জনসচেতনতা। তবু কেন আজও রোধ করা গেল না বাল্য বিবাহ প্রথা। এর কারণ কি? (১) অশিক্ষা, (২) দরিদ্রতা, (৩) ধর্মীয় গোড়ামী, (৪) সামাজিক অবক্ষয়ও এর একটি কারণ। এককভাবে কোন কারণকে চিহ্নায়িত করা যাবে না। এর প্রত্যেকটি কারণই সমানভাবে দায়ী। অশিক্ষা এই অভিশপ্ত জীবনের জন্য মুলতঃ প্রধান দায়ী। এরা জানে না এর কুফল কতটা। অবশ্য জনসংখ্যাও এর মধ্যে নিহিত আছে। তথাপি একজন শিক্ষিত মা-বাবা কখনো তার কন্যাটিকে অসম বয়স বৃদ্ধ লোকের হাতে সমর্পণ করবেন না। তখন দেখা যায় অন্য কারণে অনেক সময় দিতে বাধ্য হয়। তার মধ্যে পড়ে দরিদ্রতা। দরিদ্রতার কারণে অনেক পিতামাতা স্বচ্ছল পাত্রের হাতে নাবালিকা মেয়েটিকে পাত্রস্থ করেন এই কারণে তার সন্তান অন্তত খেয়ে পড়ে বাঁচবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্য দেখা গেছে লোভ ও মানুষের এই অসঙ্গতি সম্পর্কে হাতছানি দেয়। অবশ্য তার কারণ ভিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে, শহরতলীতে, শহরে বাতাসের মধ্যে এই অসম বিবাহের ঢল দেখা যায়। তার পরে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামি। ধর্মের প্রতি সাধারণ মানুষের মন দুর্বল। তাই যে কোন অসঙ্গতিপূর্ণ কাজের জন্য সমাজের কতগুলো লোভী, কূটসম্পন্ন মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে এমন কতগুলো রীতিনীতি তৈরি করেছে যা থেকে অশিক্ষিত মানুষ অন্যায় জেনেও মেনে নিতে বাধ্য হয়। অথচ সঠিকভাবে জানলে দেখা যাবে ধর্মে কখনও এইসব রীতির কথা লেখা নেই। বাল্যবিবাহের কুফল যে কত মারাত্মক তা প্রত্যেক অভিভাবকের জানা খুবই প্রয়োজন। প্রথমত একজন নারী বা শিশুকে যখন পাত্রস্থ করা হয় দেখা যায় সে শারীরিক বা মানসিক কোনভাবেই বিয়ের উপযুক্ত নয়। এমতাবস্থায় যখন তাকে বিয়ের কনে করে নেওয়া হয় প্রথম নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া যেমন তার পক্ষে সম্ভব নয় তেমনি দাম্পত্য সম্পর্কও তার জন্য এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। এই ভীতিজনক সম্পর্ককে সে সারাজীবনেও ভুলতে পারে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের একে “মেন্টাল ট্রমা” বলে। আর অসম্পূর্ণ শরীরে সে যখন মা হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে মৃত্যুর ঝুঁকি। অপুষ্টিতে শরীরে নেমে আসে অকাল বার্ধক্য। তখন তার “জন্মই আমার আজন্ম পাপ”। এই সত্যতা প্রকটিত হয়ে থাকে। এছাড়া অপুষ্ট মায়ের সন্তানের থাকে মৃত্যুর ঝুঁকি। শিশুর মানসিক এবং শারীরিক বিকাশেও বাধাগ্রস্ত হয়। তখন সে হয় পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য সর্বোপরি দেশের জন্য বাধা স্বরূপ।
যদিও বাল্যবিবাহ প্রথার সংখ্যা অনেক কমে আসছে। কিন্তু এখনো আমরা বলতে পারি না এ অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। কাজেই এখনো আমাদের সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক দায়িত্ব রয়ে গেছে। এজন্য আমাদের যেসব কাজ করতে হবে তাহল সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেজন্য আপনার ঘরের কাজের বুয়া থেকে গ্রামাঞ্চলের সেই সব অশিক্ষিত মায়েদের এই বিষয়ে সচেতনতা নেই। নিজ উদ্যোগে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে এর ভয়াবহ পরিণতির দিকটি। সরকারিভাবে তো করবই, সামাজিকভাবে সভা সমিতি, মাজার সমজিদেও এর জন্য
প্রচারাভিযান চালানো দরকার।
সরকারের উচিৎ এ জন্য একটা বিধিবদ্ধ আইন তৈরি করা। যে আইন বাল্য-বিবাহ রোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে স্কুলে ভর্তির সময়ে জন্মগত সার্টিফিকেট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর ফলে এখন আর বয়স লুকানোর কোন উপায় থাকে না। এতে বাল্য-বিবাহ রোধের ক্ষেত্রে এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। এর সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তকে যদি বাল্য-বিবাহের কুফল নিয়ে সিলেবাস অর্ন্তভূক্ত করা হয় তাহলে ছাত্র-ছাত্রীরাও সচেতন হবে। নিজেরাই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবে। আমাদের মনে রাখা উচিত বাল্য বিবাহও কিন্তু এক রকম শিশু ধর্ষণ। যুগ যুগ ধরে এই ধর্ষণ বা অবিচার চলে আসছে। প্রতিবাদহীন হয়ে। শুধু আইন করে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই আসুন নারী তার নিজের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসুক ‘আমার জীবন আমার’। এই জীবন সুন্দর, সুরক্ষা করার দায়িত্বও আমার। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে আজ এখুনিই “বাল্য বিবাহ রোধে” এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট