চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

আপিল শুনানির পেপারবুক তৈরির কাজ চলছে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা অফিস

২১ আগস্ট, ২০১৯ | ২:২৯ পূর্বাহ্ণ

আজ ২১ আগস্ট। দেড় দশক আগে এইদিন বিকালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালায় তদানিন্তন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদপুষ্ট হরকাতুল জিহাদের একদল জঙ্গি। যা ছিল, শেখ হাসিনাকে হত্যার ধারাবাহিক চেষ্টার এক চূড়ান্ত রূপ। মূলত, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নৃশংসতম এই গ্রেনেড হামলার মদদ যোগায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্তরের কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বেগম আইভি রহমান ও অপর ২৪ জন সেদিনের হামলায় নিহত হন। এছাড়াও এই হামলায় আরও অন্তত ৪শ’ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আকস্মিক গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারাত্মক বিশৃংখলা, ভয়াবহ মৃত্যু ও দিনের আলো মুছে গিয়ে এক ধোয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

ঢাকার তৎকালিন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাৎক্ষণিকভাবে এক মানব বলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন। বর্বরোচিত এই গ্রেনেড হামলায় নিহতদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব:) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা). মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন ও ইসাহাক মিয়া। মারাত্মক আহতরা হলেন শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রায়ত আব্দুর রাজ্জাক, প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, এডভোকেট সাহারা খাতুন, মোহাম্মদ হানিফ, সাবের হোসেন চৌধুরী, এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, এডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দিপ্তী, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক প্রমুখ।
এই মর্মান্তিক ঘটনার বিচারকে ভিন্নদিকে নিয়ে যেতে তদানীন্তন বিএনপি জামায়াত সরকার নানামুখী অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে তার মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করে ভারতকে এই হামলার জন্য নেপথ্য মদদকারী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি, ভারত থেকে ঢাকায় এসে একদল খুনি এই হামলা পরিচলনা করে ফের ভারতে ফিরে গিয়েছে বলেও প্রচার করা হয়। জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যে বিএনপির সাংসদরা দাবি করেন, শেখ হাসিনা নিজে তার ব্যবহারিক ব্যাগে করে বোমা নিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন।

পরে, দীর্ঘ তদন্ত ও পুণ:তদন্ত শেষে সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ ২০১১ সালের ৩ জুলাই তিনি বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র বিচারিক আদালতে জমা দেন। মামলার দীর্ঘ শুনানী শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। অন্যান্য আসামিদের দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-। মামলাটি বর্তমানে আপিল শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে। জানা গেছে, শুনানীর জন্য বর্তমানে পেপারবুক তৈরীর কাজ চলছে।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পরদিন অর্থাৎ ২২ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার মতিঝিল থানার এসআই ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। এরই সাথে আরও দুটি মামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী। এ সব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। এক মাস দশ দিন পর অর্থাৎ একই বছরের ২ অক্টোবর সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এ সব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল।

পরে, ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে আটক করা হয় একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের এক আলোচিত চরিত্র জজ মিয়াকে। আটকের পর তাকে নেওয়া হয় সেনবাগ থানায়। পনেরো দিন সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর গ্রেনেড হামলার মামলায় জজ মিয়া ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দেন। জজ মিয়ার ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ পুলিশের সাজানো ঘটনা এমন প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে চারিদিকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। প্রতিবেদনে তাকে আসামি করার বদৌলতে তার পরিবারকে টাকা দেয়ার বিষয়টিও গণমাধ্যমে উঠে আসে। ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালতও এ মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে খালাস পান পুলিশের সাজানো নায়ক জজ মিয়া। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির। ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এরপর মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ। ২০১১ সালের ৩ জুলাই তিনি বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন। গ্রেনেড হামলার ঘটনার মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। চার্জশিটে নাম উঠে আসে তারেক-বাবরের। সেদিন বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্বাক্ষরিত চার্জশিটটি দাখিল করেন এসআই গোলাম মাওলা। দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা চার্জশিটে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগের চার্জশিটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিযুক্তদের তালিকায় নতুনভাবে যাদের যোগ করা হয় তাদের মধ্যে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ উল্লেখযোগ্য। অন্য মামলায় জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও জেএমবি সদস্য শহিদুল আলম বিপুলের মৃত্যুদ- ইতোমধ্যেই কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ যায়। এ পর্যন্ত ২১ আগস্ট হামলা মামলার মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক রয়েছেন। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন ২৩ জন এবং জামিনে ছিলেন ৮ জন। জামিনে থাকা আট জনের জামিন বাতিল করে আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে জানান, ওই হামলার আগে ঢাকায় ১০টি বৈঠক হয়। এ সব বৈঠকে তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হারিছ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। টাকা ও গ্রেনেড আসে পাকিস্তান থেকে।

আইনজীবীরা বারবার বলেছেন যে, তারা মনে করেন ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা। হামলার কাজে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের আবদুল মজিদ বাট বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। বাংলাদেশে হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আরো অনেকের নাম আসে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে এসব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা মনে করেন মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছে।
বলা বাহূল্য, হামলার প্রথম সাত বছরের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় মোট ছয়বার। প্রথম তদন্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। সে সময় কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগ পত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতাদের সনাক্ত করা হয়নি। বর্তমান সরকার আমলে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর আদালত মামলার বর্ধিত তদন্তের আদেশ দেন। ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেয়ার মধ্য দিয়ে গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত শেষ হয়। ২০১২ সালের ২৮ মার্চ মামলার বিচার শুরু হয়। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয় ২০১২ সালের ২৮ মার্চ। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল একই বছর ৯ এপ্রিল পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়। এর আগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিশেষ ট্রাইবুনালে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। বহুল আলোচিত এ মামলায় ৫১১ সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। আরও ২০ জনের সাফাই সাক্ষ্য নেওয়া হয়। তবে মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা পরস্পরকে দায়ী করেন। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শেষ হয় বিচার প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ ও আসামিপক্ষ ৮৯ কার্যদিবস ব্যয় করেছে। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট