চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪

সংকটে ঘুরপাক চামড়ার

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৮ আগস্ট, ২০১৯ | ২:৩১ পূর্বাহ্ণ

*পাওনা টাকার নিশ্চয়তা পেলে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করব : আড়তদার সমিতি  *কাঁচা রপ্তানি করা হলে চামড়া শিল্প হুমকিতে পড়বে : বিটিএ চট্টগ্রামে জোন স্থাপনের দাবি  *বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কার্যালয়ে বৈঠক আজ

কোরবানির চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণার পর তিনপক্ষের মধ্যে সংকট সৃষ্টি হয়। এখন ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে নারাজ আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, চামড়া রপ্তানি করা হলে এই শিল্পের উন্নতি হবে। অপরদিকে রপ্তানি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি করে আসছে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন। তাদের দাবি, কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে পাটশিল্পের মতো চামড়াশিল্পও ধ্বংসের পথে চলে যাবে।

কাঁচা চামড়া নিয়ে তিন পক্ষের মতানৈক্যের ফলে সৃষ্ট সংকট নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কাঁচা চামড়ার বাজার পর্যালোচনার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কার্যালয়ে আজ বিকেল ৩টায় এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখার সচিব, উপ-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা ও দেশের বিভাগীয় শহরের চামড়া ব্যবসায়ী-আড়তদারদের সংগঠন এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সৈয়দা নাহিদা হাবিবা ১৭ সংস্থা ও সংগঠনের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিদের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছেন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আবদুল কাদের পূর্বকোণকে বলেন, সারাদেশের আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকদের নিয়ে আজ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে শুধু চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। পাওনা টাকার সংকট নিরসন ও বর্তমান চামড়া বিক্রির পুঁজির নিশ্চয়তা পেলে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে রাজি থাকবে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা।
সরকারের চামড়া রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ পেলে আমরা উপকৃত হব। চামড়াশিল্প আলোর পথ দেখব, না হলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। আগের মতো ট্যানারি মালিকদের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে থাকব।

রপ্তানি প্রক্রিয়া তো সময়সাপেক্ষের বিষয়, এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল কাদের বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ কয়েক রাষ্ট্র কাঁচা চামড়া কেনার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ভারতে চামড়া সংকটের কারণে ৩০-৩৫টি অত্যাধুনিক ট্যানারি বন্ধ রয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলে ওমাসম (সাতপলদা) রপ্তানির মতো দু-তিন দিনেই রপ্তানির অনুমোদন দিতে পারে। বাংলাদেশে চামড়ার চাহিদার ৮০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় কোরবানির পশু থেকে। মৌসুমি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে এই চামড়া সংগ্রহ করেন। কোরবানির পশুর সংগৃহীত এসব চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের হাত ঘুরে যায় ট্যানারি মালিকদের কাছে।

চলতি বছর কোরবানির চামড়া নিয়ে নজিরবিহীন অস্থিরতা দেখা দেয়। চট্টগ্রামে প্রায় দেড় লক্ষাধিক কাঁচা চামড়ার রাস্তায় ফেলে দেয় মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। চসিক রাস্তা থেকে লক্ষাধিক পচা চামড়া সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্টেশনে পুঁতে ফেলেছে। এছাড়াও নগরী ও জেলায় বিভিন্ন মাদ্রাসা-এতিমখানা ও মসজিদে সংগ্রহকৃত চামড়া বিক্রি করতে না পেরে পুঁতে ফেলেছে। এতে এতিম-মিসকিনের ‘হক’ বঞ্চিত হয়। কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে নৈরাজ্যে কারণে কাঁচা চামড়া রপ্তানির ঘোষণা দেয় সরকার। সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘ট্যানারি মালিকেরা চামড়া কেনার জন্য চট্টগ্রামে আসার কথা ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের কারণে হয় তো আসেনি। বৈঠকের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।’

কোরবানির চামড়ার গুণগতমান ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোরবানির গরু হৃষ্টপুষ্ট দেখেশুনে কেনা হয়। চাহিদার ৮০ শতাংশ চামড়ার কোরবানির চামড়া থেকে সংগ্রহ করা হয়। ট্যানারি মালিকদের কারণে চামড়ার বাজার ধস নেমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘কাঁচা চামড়া (ওয়েট ব্লু) রপ্তানির বাজার উন্মুক্ত করা হলে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা সুফল পাবে না। পুঁজি বা মূলধনের নিশ্চয়তা পাবে। একই সঙ্গে সাধারণ-মৌসুমী ব্যবসায়ী ও এতিমখানা-মাদ্রাসাগুলোও সুবিধা পাবে। কারণ অনেক মাদ্রাসা ও এতিমখানা চামড়ার টাকার উপর নির্ভরশীল। চামড়া আড়তদারদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশন ট্যানারি মালিকরা তাদের বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত কাঁচা চামড়া বিক্রি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি হাজি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রায় ৪শ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ট্যানারি মালিকরা এই বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় এবারের কোরবানিতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা যায়নি। এতে কোরবানির বিপুল চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে।

রপ্তানির বিষয়ে তিনি বলেন, সরকার রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু অনুমোদন পেতে কয়েক মাস সময় লাগবে। লবণজাত চামড়া সর্বোচ্চ তিন-চার মাস সংরক্ষণ করা যাবে। টাকার নিশ্চয়তা পেলে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রির বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন তিনি। এবার সরকারের চাপে অনেকটা নমনীয় হয়েছেন ট্যানারি মালিকেরা। তবে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর নড়েচড়ে বসেন ট্যানারি মালিকরা। বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এন্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) ইতিমধ্যে চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ দাবি করেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানি করা হলে চামড়াশিল্প হুমকিতে পড়বে। কারখানাগুলো কাঁচা চামড়ার অভাবে অকেজো হয়ে পড়বে। কারসাজির বিষয়ে ট্যানারি মালিকদের কোনো হাত নেই দাবি করে তিনি বলেন, কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করেন আড়তদার, ব্যবসা ও মহাজনেরা। তারা একজোট হয়ে প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ঠকিয়েছেন। চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকার মদিনা ট্যানারি মালিক হাজি আবু মোহাম্মদ পূর্বকোণকে বলেন, ‘চামড়া ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানিশিল্প। সরকারের যথাযথ উদ্যোগ আর পরিকল্পনার অভাবে সেই খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। কোরবানির চামড়া নিয়ে নজিরবিহীন বিপর্যয় ঘটনা ঘটে গেল। চামড়া রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। স্বর্ণ কেন রাস্তায় ফেলে দেবে, মাটিতে পুঁতে ফেলবে ?’

নগরীর আতুরার ডিপোর ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান পূর্বকোণকে বলেন, লবণ দেয়া কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ করে দিলে ব্যবসায়ী, আড়তদারসহ সকলে লাভবান হবে। এককভাবে ট্যানারি মালিকদের উপর জিম্মি হয়ে থাকতে হবে না। জানা যায়, এক সময়ে চট্টগ্রামে ৩০টি ট্যানারিশিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। স্বাধীনতার পরেও ২২টি ট্যানারি ছিল। বর্তমানে টিকে রয়েছে দুটি। তারমধ্যে ইটিপি না থাকায় মদিনা ট্যানারি বন্ধ করে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। শুধুমাত্র চালু রয়েছে রিফ লেদার ট্যানারি। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঢাকা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। ট্যানারি মালিক হাজি আবু মোহাম্মদ পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত ট্যানারি না থাকায় চামড়ার চাহিদা নেই। ঢাকা নির্ভর হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামে অনেক শিল্পজোন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকার মতো চট্টগ্রামেও ট্যানারি জোন স্থাপনের দাবি করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে দেশীয় এই শিল্পটি আগের মতো সুদিন ফিরে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট