চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শোলের গব্বর সিং অতঃপর

রফিকুল আনোয়ার রাসেল

৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সিনেমা চর্চার মানুষ তাই হয়তো পুরো পৃথিবীকে সিনেমা’র চোখ দিয়ে দেখতে ভালোবাসি। গত শতাব্দীর শেষদিক থেকে পৃথিবীর সিনেমা জগতের কর্মী, কলা-কুশলীরা একদিকে যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে মানুষকে বিনোদিত করেছেন, তেমনি পৃথিবীর অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমাজ বাস্তবতার অনেক দৃশ্যগত ধারনা, ভাবনা বা প্রশ্নের অভিজ্ঞতাও দিয়েছেন।
আমি ভারতের সত্তর দশকে নির্মিত ‘শোলে’ (১৯৭৫) ছবিটির একটি বিশেষ দৃশ্য মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করবো। রমেশ সিপ্পি পরিচালিত এই ছবিটি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আমরা জানি এর কাহিনী’র থিম বিশ্বের অনেক ছবি থেকে নেয়া । আমাদের দেশেও পরবর্তীতে এই ছবির অনুকরণে ‘দোস্ত-দুশমন’ নামে একটি ছবি নির্মিত হয়। কিন্তু অনেক কারণে ‘শোলে’ সারা ভারতে তো বটেই, সারা পৃথিবীর সিনেমা জগতে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে ।
‘শোলে’ ছবিতে ঠাকুর বলদেভ সিংহ ‘রামগর’ গ্রামের একজন জমিদার লোক। তিনি নিজে বিপদ মোকাবেলায় সাহসী একজন মানুষ বলে দেশ ও আইন রক্ষায় পুলিশে চাকরি করেন, টাকার জন্য নয়। একদা তিনি সাহসিকতার সাথে জনপদের মূর্তিমান আতঙ্ক ডাকু সর্দার গব্বর সিং’কে ধরে ফেলেন, জেলে পুরে দেন। কিন্তু ধূর্ত গব্বর সিং জেল থেকে পালিয়ে ঠাকুরের পুরো পরিবারকে (একমাত্র ছোট পুত্রবধূকে ছাড়া) হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। পরিবার হারিয়ে ক্রোধে উন্মত্ত ঠাকুর গব্বরকে ধরতে গিয়ে নিজেই ধরা পরে দু’হাত হারান। অসহায় জীবনেও তিনি গব্বর সিং-এর উপর প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা ছাড়েন না। এই কারণে তিনি ভাড়া করেন সাহসী বিপজ্জনক দুই তরুণ ভিরু এবং জয় । এরপর মারামারি, গোলাগুলি চলতে থাকলো ডাকু গব্বর সিং আর ঠাকুরের লোকের সাথে। আপাত অর্থে এ লড়াই কাহিনীতে সকলের শামিল হবার চক্রটা আমরা ধরি এভাবে ঠাকুর গব্বরকে জেলে পুরেছে তাই গব্বর খুন করেছে ঠাকুরের পুরো পরিবার, কেটে নিয়েছে হাত প্রতিশোধ নিতে ঠাকুর বেপরোয়া ভাড়াটে লোক এনেছে গব্বরকে ধরতে। ভিরু-জয়দেবও টাকার জন্য গব্বরকে জীবন্ত ধরবে আর সবশেষে ঠাকুর গব্বরকে নিজ হাতে মেরে প্রতিশোধ চরিতার্থ করবেন। এরমধ্যে আছে হাসি-ঠাট্টা-নাচ-গান এবং বানজারান । দর্শক হিসেবে আমরা দারুণ উত্তেজিত, ‘মারমার কাটকাট’ সময় কাটানো যাবে। এ পর্যন্ত আমরা ঠাকুর-গব্বরের খেলায় কিন্তু দর্শক। রামগরবাসীদের প্রতি আমাদের করুনা আছে, কিন্তু আমরা দর্শক হিসেবে একটা জমজমাট ফাইট দেখতে চাই। ভিরু-জয়দেবের বীরত্ব দেখতে চাই। কাহিনীর গ্রামবাসীদের মতো আমরা নৈতিক ভাবে ঠাকুরের পাশে নেই। তার সংগ্রাম আমাদের সংগ্রাম এক নয়। যদিও তিনি একই সাথে রামগরবাসীদেরও মুক্ত করতে চান, এই পিশাচ ডাকাতের হাত থেকে। কারণ তারাও গব্বরের হাতে অসহায়। নিজেদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল তাদের গব্বরের হাতে তুলে দিতে হয়। নচেৎ অত্যাচার ও নির্যাতন অনিবার্য। কিন্তু এই কৃষাণ-মজুর মানুষগুলো ঠাকুরের মতো সাহসী ও প্রতিশোধ পরায়ণ নয়। তারা ভীতু, তারা বাঁচতে চায়।
আমরাও তাদের মতো, ভীরুতার সাথে বাঁচতে চাই। শত্রুতা তো ঠাকুর আর গব্বরের মাঝে । আমাদের তাতে কি ? রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়, আর তাতে (আমাদের মতো) উলুখাগড়ার প্রাণ যাবে কেন ? দর্শক হিসেবে থাকাটা নিরাপদ মনে করি। কিন্তু বাদ সাধল একটি দৃশ্য ।
“রামগর গ্রামের একমাত্র মসজিদের ইমাম সাহেব ‘রহিম চাচা’ আর তাঁর ছেলে ‘এহমেদ মিয়া’। বিপত্নীক এই ধর্মপ্রাণ মৌলানাটির একমাত্র কিশোর ছেলেটি বাদে আর কেউ নেই। তিনি অন্ধ, যদিও সারা গ্রামের সবাইকে তিনি সহায় মনে করেন। একেবারে নিরীহ এই মানুষটির স্বপ্ন তার ছেলে ‘এহমেদ মিয়া’ শহরে গিয়ে কারখানায় কাজ করবে। অনেক টাকা বেতন পাবে, সচ্ছল হবে। কিন্তু ছেলে অন্ধ বাবাকে একা ফেলে যেতে রাজি নয়। ‘এহমেদ মিয়া’ পড়াশুনা জানে, তাই সবাই তাকে বৃদ্ধ পিতার কথা অনুযায়ী গ্রামে জীবনটা নষ্ট না শহরে গিয়ে সফল হতে বলে। অতঃপর এহমেদ মিয়া একদিন পিতার কাছ থেকে দোয়া ও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । কিন্তু পথে সেই দুর্গম রামগরের পাথুরে অঞ্চল যেখানে রাজত্ব করছে ডাকু গব্বর সিং। তার লোকেরা দেখে, রামগরের এক কিশোর ঘোড়ার পিঠে চড়ে শহরের উদ্দেশে চলেছে। তারা গব্বরকে জানায়, এই ছেলেটি রামগর থেকে আসছে। আমরা পরের দৃশ্যে দেখি, ঘোড়ার পিঠে চড়ে এহমেদ মিয়ার লাশ ফিরে এলো গ্রামে। পুরো গ্রাম শোকাহত। লাশের সাথে গব্বরের হুঁশিয়ার বাণী তার কথা না শুনলে গ্রামের সবার ছেলেমেয়ের এই পরিণতি হবে। এরমধ্যে অন্ধ ইমাম সাহেব সকলের মাঝে এসে জানতে চান, “এ তো নিস্তব্ধতা কেনো ভাই?” এমন বিপদ ডেকে আনার জন্য একজন গ্রামবাসী ঠাকুরকে দায়ী করেন। তারা পরিষ্কার জানায়, ঠাকুরের জন্য তারা বিপদের এই বোঝা ঘাড়ে নিতে রাজি নয়। তখন বৃদ্ধ ইমাম সাহেব সবার উদ্দেশ্যে বলেন, “পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন বোঝা হলো, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। আমি যদি একজন বুড়ো মানুষ হয়ে এই বোঝা তুলতে পারি, তাহলে তোমরা কেন বিপদের বোঝা কাঁধে নিতে পারছো না?” গ্রামবাসী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে লাশটিকে ঘিরে।
সিনেমা’র এই দৃশ্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । ঘটনাটি এতোই মর্মান্তিক যে দর্শক, গ্রামবাসী, ঠাকুর, জয়, ভিরু সকলকে এক সারিতে নিয়ে আসে। ডাকু ‘গব্বর সিং’ দের হাতে তবে সিনেমা’র ভিতরে-বাইরের কোনো মানুষই নিরাপদ নয়। ধীরে ধীরে ক্রোধ আর প্রতিশোধের আগুন পর্দার বাইরে এসে লাগে দর্শকের হৃদয়ে। এহমেদ মিয়ার মৃত্যু যেন, একটি আশার মৃত্যু, নিরীহ মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু। মন্দ নিপাত যাক, ভালোর জয় হোক। ইতিহাসের একটা মৌলিক আকাক্সক্ষায় এসে সিনেমার কাহিনী, চরিত্র ও দর্শক সবাই এক হয়ে পড়েন। সবার একটাই চাওয়া “ডাকু গব্বর সিং এর মৃত্যু চাই, সে ধ্বংস হোক”। এরপর গব্বর ধ্বংস হলো। এখানেই ‘শোলে’ চলচ্চিত্রের সার্থকতা।
আমার আলোচনা এখানে শেষ নয়। সবাইকে দৃষ্টিপাত করতে ১০ মার্চ,২০১৩ ঘটে যাওয়া নারায়ণগঞ্জের একটি হত্যাকা-ের দিকে। জনৈক কিশোরের লাশ পাওয়া গেছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। তার শরীরে অনেক ক্ষত ছিল, যাতে বোঝা যায় কিশোরটিকে ভয়ানক যন্ত্রণা ও আঘাত করে মারা হয়েছে। দু’দিন আগে ৮ মার্চ, ২০১৩ সালে কে বা কারা তাকে অপহরণ করে। পাপ যেমন চাপা থাকে না, তেমনি তানভিরের লাশও সবাইকে অবাক করে ‘সত্য’ নিয়ে এলো আমাদের কাছে। তিনি আরো জানালেন কারা করেছে। হয়তো তিনি সন্তানের লাশের বিনিময়ে ঘৃণ্য রাজনীতির ফায়দা লুটতে চাননি।
‘শোলে’ ছবির রামগরবাসীর মতো স্থানীয়রা জানে এখানের ‘গব্বর সিং’-কে বা কারা। হয়তো মৃতের নিষ্পাপ চেহারা মানুষকে নাড়া দিয়েছিল, তাই পত্রপত্রিকায় বিষয়টি নতুন করে আলোকপাত করে। এ কোনো দুর্ঘটনা নয়, এ মৃত্যু যেন একটি আশার মৃত্যু। মৃত ছেলেটির নিষ্পাপ চাহনি যেন বলছে, “আমার বাবা তো আমার লাশের বোঝা বইলো, আপনারা কি তবে এই বিপদের বোঝা মাথায় নিয়ে প্রতিবাদ করবেন না ?”

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট