চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম কলেজ

মোহাম্মদ বেলাল হোসেন

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮ | ৮:৪০ অপরাহ্ণ

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে রক্ত¯পাত বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রামের বাতিঘর চট্টগ্রাম কলেজ। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এতদঞ্চলের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রগতিশীলতা, বুদ্ধিবিৃত্তিক চর্চা ও সংকটে-সংগ্রামে এই প্রতিষ্ঠান পালন করেছে উপযুক্ত ধাত্রীর ভূমিকা। ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ও পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুক্তিলাভের জন্য বাঙালি জাতির যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের তীর্থভূমি ছিল চট্টগ্রাম। আর যে ক্যাম্পাসকে ঘিরে পুরো চট্টগ্রামে প্রতিরোধের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠত সেটি হল চট্টগ্রাম কলেজ।
১৯২৬ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ১৯২৯ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহেরু, ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের কলেজ ক্যাম্পাসে আগমন ও বক্তব্য প্রদান ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার উৎস। ফলে ১৯৪৭ সাল হতে ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালি জাতির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে এই কলেজের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ও ২৪ মার্চ কার্জন হলে পাকিস্তানের গর্ভনর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা ঘোষণা দিলে, এর প্রতিবাদে চট্টগ্রাম কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ফেরদাউস খান ‘The Language problem of Today : A comparative Study of three scripts’ নামে গবেষণা পুস্তক প্রকাশ করেন এবং ১৯৪৯ সালের ৯ এপ্রিল দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘বাংলা বনাম আরবি হরফ’ নামক প্রবন্ধ লিখেন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান কলেজ পরিদর্শনে আসলে ছাত্ররা খোলা চিঠি লিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানান। কলেজের তৎকালীন ছাত্র কবি মাহবুবুল আলম চৌং (কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবিতার রচয়িতা), আবদুল্লাহ আল হারুন, এজহারুল হক, ফরমান উল্লাহ, শামসুদ্দিন মো. ইসহাক প্রমুখ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ভাষা আন্দোলন পরবর্তী ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন ও ৬৬ সালের ৬ দফাকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে চূড়ান্ত স্বাধীনতার সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম এই কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের অনেক গোপন পরিকল্পনা, মিছিল, সমাবেশ, প্রশিক্ষণ কলেজ ক্যাম্পাসে হয়েছিল। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। কয়েকটি গ্রন্থ ও প্রবন্ধে লিখার অংশ বিশেষ হিসেবে স্থান পেলেও, চট্টগ্রাম কলেজ শিরোনামে কোন লিখা প্রকাশ না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে এই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটা অজানা হয়ে আছে। তাই এই লিখা সেই সংগ্রামী দিনের গৌরবগাথা কিছুটা তুলে ধরার প্রয়াস। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে এসে প্রথম সমাবেশ করেন। তিনি জনসভা শেষে তৎকালীন শীর্ষ ছাত্রনেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের তুখোড় নেতা এস. এম. ইউসুফ সভায় বক্তব্য রাখেন।
পরবর্তীতে তিনি ৬ দফাকে ম্যান্ডেট ঘোষণা করে ১৯৬৬ সালে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তবে নানা ষড়যন্ত্রের কারণে পরাজিত হন। কিন্তু তিনি দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। ইতিমধ্যে তার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগ, তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখনের সাথে যোগাযোগ করে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গঠন করে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’। এস. এম. ইউসুফসহ নিউক্লিয়াসের শীর্ষ নেতা ছিলেন কলেজের ছাত্র শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, জালাল উদ্দিন আহমদ, মিয়া শাজাহান কবির (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) রেজাউল করিম প্রমুখ। নিউক্লিয়াসের অফিস ছিল চট্টগ্রাম কলেজ শেরেবাংলা ছাত্রাবাসের ৪৪নং কক্ষ। ১৯৬৯ সালে নিউক্লিয়াসের অন্যতম নেতা মিয়া শাহজান কবির ও রেজাউল করিমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘শার্দুল গোষ্ঠী’। এটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এই সংগঠনের মূল কাজ ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গোপনে কাজ করা। শার্দুল গোষ্ঠীর গোপন তৎপরতার অন্যতম উদাহরণ ১৯৭০ সালে সাহিত্য সংকলন ‘বাংলাদেশ’ পুস্তিকা প্রকাশ করা। মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম (সম্পাদিত) ‘ছাত্রলীগ ষাটের দশকে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ আছেÑ“পূব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে গঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস এর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে চট্টগ্রাম কলেজের নিউক্লিয়াসপন্থী ছাত্রনেতারা প্রকাশ করে সাহিত্য সংকলন ‘বাংলাদেশ’। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ মিয়া শাহজান কবিরের সম্পাদনায় প্রকাশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ইমামুল ইসলাম লতিফি, প্রদীপ কুমার খাস্তগীর, নিজামুল হক, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, মাহফুজুর রহমান, রওশন আরা বেগম (আনার) অন্যতম।”
৭১ এর মার্চ মাসের প্রতিটি দিন ছিল উত্তাল ও উৎকণ্ঠাময়। চট্টগ্রাম কলেজের (প্যারেড মাঠ), লালদীঘি মাঠ ও কলেজ ক্যাম্পাসের লিচুতলা ছিল প্রতিদিন মিছিল সমাবেশ ও শ্লোগানে মুখরিত। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হায়েনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা চালায়, যা থেকে বাদ পড়েনি চট্টগ্রাম শহর। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাওয়ার সাথে সাথে কলেজের ছাত্রনেতার চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রেজাউল করিম সম্পাদিত ‘ছাত্রলীগ ষাটের দশকে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেনÑ“মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে নিয়ে তৎকালীন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি জালালউদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেলকে যোগাযোগ এর কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। ইপিআর, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা চট্টগ্রাম কলেজ হোস্টেলকে একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। এদিকে চট্টগ্রাম শত্রু বাহিনীর দখলে চলে গেলে ২ মে ছাত্র সংসদের জিএস মনিরুজ্জামান মিন্টুকে সাথে নিয়ে তিনি ভারতের হরিণা ক্যাম্পে যায়। ফিরে এসে ১নং সেক্টরে বিভিন্ন স্থানে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে কাজ শুরু করে।” চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ডা. মাহফুজুর রহমান ভারতের দেরাদুন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মাঠ ও প্যারেড মাঠে তরুণ শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে শহীদ হন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মুরিদুল আমল খান, প্রাক্তন ভিপি আবদুর রব, মিয়া শাহাজান কবিরসহ আরো অনেকে।
মুক্তিযুদ্ধে কলেজের ছাত্ররা যখন মর্টার ও গ্রেনেড হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর মোকাবেলা করছে, তখন কলম ও চিন্তাশক্তি দিয়ে পাকহানাদারদের প্রতিরোধের ঘোষণা দেন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকরা। তৎকালীন চ.বি. শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামান তাঁর আমার একাত্তর বইতে লিখেছেন, “৮ মার্চ ১৯৭১ বিশিষ্ট লেখক আবুল ফজলের বাসভবন সাহিত্য নিকেতনে একসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘শিল্পী সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘ’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ সভায় উপস্থিত ছিলেন ও বক্তব্য দেন। ৯ মার্চ চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান এর সভাপতিত্বে কলেজ প্রাঙ্গণে একসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষকরা স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতি নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেন।” বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ শুধু মেধাবী শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন খ্যতিমান নাট্যকার ও অভিনেতা। তিনি ৭ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। অল্পসময়ে ছাত্রদের মাঝে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি রচনা করেন তিনটি নাটক-(১) স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, (২) এবারের সংগ্রাম, (৩) স্বাধীনতা সংগ্রাম। জামাল উদ্দিন রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “১৫ মার্চ ১৯৭১ লালদিঘী ময়দানে শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিসেবী প্রতিরোধ সংঘের উদ্যোগে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মমতাজ উদ্দিন আহমদ জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করেন। ছাত্রদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন চাকসুর জিএস আব্দুর রব ও ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মাহবুবুল হক। সমাবেশ শেষে পরিবেশিত হয় নাটক ‘এবারের সংগ্রাম’ প্রায় কয়েক লক্ষ দর্শক নাটকটি উপভোগ করেছিল।” ১৯৭১ সালে ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতির উদ্যোগে কলেজের প্যারেড ময়দানে পরিবেশিত হয় নাটক “স্বাধীনতার সংগ্রাম”, দর্শক ছিল প্রায় ৮০ হাজার। মমতাজ উদ্দীন আহমদ নিজের বর্গীওয়ালা চরিত্রে অভিনয় করেন। নাকট চলাকালীন ছাত্রনেতা তাহের সোবহান খবর নিয়ে এলেন যে, বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে বাধা দিচ্ছে সাধারণ জনতা। তাই পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালাচ্ছে। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে পুরো মাঠে এবং নাটক শেষে প্রায় দশ হাজার দর্শক স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে মিছিল করে ছুটে গিয়েছিলেন বন্দর প্রতিরোধে অংশ নেওয়ার জন্যে। মুক্তিসংগ্রামের উত্তাল দিনে সবার প্রিয় মমতাজ উদ্দীন স্যারের নাটক ছিল ছাত্র জনতার কাছে প্রেরণার উৎস। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার যে বার্তা কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে পাঠ করা হয় এটি অনুবাদ করেন অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ। মুহাম্মদ শামসুল হক রচিত ‘স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায় বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য (৪৭-৭১)’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “কালুরঘাট যে রেডিও স্টেশন ছিল, সেটি ছিল ট্রান্সমিটিং স্টেশন। সেখানে ঘটনাক্রমে সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান এসেছিলেন। কোত্থেকে এসেছেন, কে তাকে নিয়ে এসেছিলেন তা আমি জানতাম না। ২৭ তারিখে আমি সেখানে ছিলাম। আমার ছাত্র আবুল কাসেম সন্দ্বীপ ও বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন। সেখানে একটি ইংরেজি বক্তব্য বাংলা করার প্রয়োজন হয়েছিল। আমি মুখে মুখে অনুবাদ করি। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ সেটি লিখে নেয়।”
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাক হায়েনাদের হাতে জীবন উৎসর্গ করেন চট্টগ্রাম কলেজের দর্শন বিভাগের মেধাবী শিক্ষক অবণী মোহন দত্ত। কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলায় জন্মগ্রহণকারী অবনী মোহন দত্ত ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষকতা জীবনের শুরু করেন রাজশাহী কলেজ যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে বদলী হয়ে আসেন এবং বিভাগীয় প্রধানে দায়িত্ব নেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর কয়েকদিনের মধ্যে চট্টগ্রাম শহর পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। এ সময় শহরে ব্যাপক হত্যার ঘটনা ঘটে। ফলে সহকর্মীরা অবণী বাবুকে গা ঢাকা দিতে বলেন। কিন্তু তিনি তা গ্রাহ্য করেননি। তিনি বলেন, আমার সাথে তো কারো শত্রুতা নেই। কিন্তু পাকসেনা ও তাদের দোসরদের কাছে তিনি ছিলেন অপরাধী, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কাজ করতেন ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরী (সম্পাদিত) ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘‘১৯৭১ সালের ৮ মে পাকসেনারা তার বাসভবন চট্টগ্রাম কলেজের পশ্চিম পার্শ্বে পার্সিভাল হিল প্রফেসর’স কোয়ার্টারে অভিযান চালায়। দুপুর বেলা, হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খোলেন তার স্ত্রী মনিমালা দত্ত। পাক সৈন্যদলের নেতা উর্দুতে জিজ্ঞেস করেন অবনী মোহন দত্ত কে? আত্মভোলা দার্শনিক নির্ভয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। তখন পাক কমা-ার বললেন, ব্রিগেড কমান্ডার আপনাকে ডেকেছে, সার্কিট হাউজে যেতে হবে। তারা টানাহেঁচড়া শুরু করলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে তার স্ত্রী ও সন্তানরা। কিন্তু কিছুতেই শেষ রক্ষা হলো না। সে যে গেলেন অবনী মোহন দত্ত আর ফিরে এলেন না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে সন্তানরা তাঁর খোঁজ পায়নি। ধারণা করা হয়, সার্কিট হাউজ নির্যাতন কেন্দ্রেই তাকে হত্যা করা হয়।”
মুক্তিযুদ্ধে কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা একাত্ম হয়ে, যে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। কলেজের শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস, প্যারেড মাঠ, লিচু তলাসহ প্রতিটি স্থান আজও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। জীবন ঝুঁকি ছিল, কিন্তু ক্যাম্পাস ছেড়ে যাননি শহীদ শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত। নাটককে মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন মমতাজ উদ্দীন আহমদ স্যার। জীবন উৎসর্গ করে কলেজের ছাত্র শিক্ষকরা নতুন প্রজন্মকে রক্তঋণে আবদ্ধ করেছেন, যা কখনও শোধ হবার নয়। সার্ধশত বছরের প্রাচীন এই কলেজের ইতিহাস যখনই লিখা হবে তখনই বার বার ফিরে ফিরে আসবে এই নামগুলো। বিজয়ের ৪৮তম বার্ষিকীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট