চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রিজিয়া রহমানের

আলবুর্জের বাজ প্রসঙ্গ

বদরুন নাহার

২৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০১ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব কল্পনাশ্রিত জগতে পাঠকে যুক্ত করাকে সৃজনশীল লেখকের উদ্দেশ্য ধরা যেতে পারে। তাত্ত্বিকদের মতে, ফিকশনের নানা ধারা বিদ্যমান, যার একটি ধারা আছে রিয়ালিস্টিক। কিছুদিন আগে দি আর্ট অব ফিকশন নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে মাথায় জেঁকে বসল প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমানের ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটি। হয়তো সমসাময়িক দেশ ও বিশ্ব-বাস্তবতার কারণেই তা ঘটল। কেননা, এই বইটির আখ্যানভাগ অতীত হলেও তা বর্তমান বাস্তবতার ছকে ফেলে অনুধাবন করার বিস্তর অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যাবে। গল্পের শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে উপন্যাসটির ভিন্নতা রয়েছে, সে বিষয়টি উপন্যাস পাঠের পর্বে পর্বে স্পষ্ট হয়। ‘আলবুর্জের বাজ’ বইটি আমার পাঠাভ্যাসের ক্ষেত্রে একেবারেই কাকতালীয়ভাবে সংযুক্ত হলো। কেননা, বইটির নামই জানা ছিল না। প্রথম যেদিন প্রিয় লেখক রিজিয়া রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সেদিন বইটি হাতে পেয়েছিলাম। এই প্রথম কোনো উপন্যাস, যা পাঠের আগেই স্বয়ং লেখকের সঙ্গে উপন্যাসটি প্রসঙ্গে কথা শুরু হয়েছিল।

কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের লেখক-সত্তাকে জেনেছিলাম নানাভাবে। তার ‘বং থেকে বাংলা’, ‘রক্তের অক্ষরে’, ‘একাল চিরকাল’, ‘সূর্য সবুজ রক্তে’সহ আর দু-একটি বই পড়া ছিল। পত্রিকায় গল্প এবং তার আত্মজীবনীমূলক লেখা থেকে জানা খানিকটা। এ ছাড়া অন্যের পাঠ অভিজ্ঞতার আলোচনায়ও তো জানা হয় খানিক। এসব মিলে ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান সম্পর্কে মনে একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল। ফলে তাকে নিয়ে আগ্রহও ছিল প্রচ-। তার লেখায় বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় পাই নানা আঙ্গিকে, সেখানে রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি যেমন দৃশ্যত, তেমনি জীবন ও মূল্যবোধের জায়গাটি স্পষ্ট। ইতিহাস নিয়ে তিনি যেমন কাজ করেছেন, তেমনি ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট নির্মাণে তার সাফল্য সাহিত্য পরিম-লে আলোচিত। কিন্তু কেন এই ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাস এবং সে শিল্পের অনুসন্ধান, তা খানিকটা ভূমিকা যুক্ত করলে অনেক বেশি খোলাসা হয়ে উঠবে। আর এই লেখাটির ক্ষেত্রে উপন্যাসের সঙ্গে প্রসঙ্গত হয়ে থাকবেন লেখক নিজেও। কারণ, এই পাঠ এবং পাঠোত্তর লেখকের সঙ্গে আলাপের বিষয়টি গুরুত্বের বলে মনে করছি।

রিজিয়া রহমানের সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয় টেলিফোনে, সম্ভবত ২০১০ সালের দিকে। সেই আলাপও ছিল বেশ নাটকীয়। সে কথার সবিস্তার এখনে আনার নয়। তবে সশরীরে তার সঙ্গে প্রথম দেখা ২০১৫ সালে, সম্ভবত নভেম্বর মাস সেটা। আগেই বলেছি, তাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন একজন লেখক বলে মনে হয়েছে আমার। প্রথম সাক্ষাতে তার প্রগতিশীল চিন্তার পরিচয়ও পেলাম। কথা বলতে বলতে বুঝতে পারছিলাম, তিনি খুব স্পষ্টভাষী মানুষ। শুধু লেখায় নন, কথা বলার ক্ষেত্রেও রিজিয়া রহমানের অনন্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। নিভৃতে থাকা এই লেখক সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানেন না যে তার সঙ্গে আড্ডা যেমন আনন্দের, তেমনি নিজেকে সমৃদ্ধ করার মতো। এ সময়কার তরুণদের লেখা পাঠে তার মনোযোগ উল্লেখ করার মতো। নানা প্রসঙ্গে কথা হতে থাকে, দেশ এবং বর্তমান বিশ্ব নিয়ে। উঠে আসে জঙ্গিবাদের বিষয়টিও। ২০১৩ থেকে বাংলাদেশে প্রবলভাবে ইসলামী জঙ্গিবাদীদের দ্বারা হত্যার ঘটনাসহ সিরিয়া ও আরব বসন্তের বিষয়। আল কায়দা থেকে আইএস প্রসঙ্গ। তিনি জানান, এই জঙ্গিবাদের শুরু এখন নয়, পৃথিবীতে এই জঙ্গিবাদের শুরু হয়েছিল বহু আগেই। তিনি আরও বলেন, এ প্রসঙ্গে আমার একটি উপন্যাস আছে। নাম ‘আলবুর্জের বাজ’।

তার সংগ্রহ থেকেই আমার হাতে তুলে দিলেন বইটি। এই উপন্যাস পাঠের প্রায় বছর পেরিয়ে গেলে আবার কথা হয় লেখকের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে হয়তো পরে আসব। তো, হাতে করে ফিরছি ‘আলবুর্জের বাজ’। উপন্যাসের শুরুতেই লেখক এক দীর্ঘ ভূমিকা দিয়েছেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এর স্থান, কাল, পাত্র ও ঘটনাবলি যেমন দূর অতীতের; তেমনি এর ভাষা, সংস্কৃতি ঐতিহ্য, চরিত্রগুলোর ভিনদেশজ অবয়ব ছিল আমার আয়ত্তবহির্ভূত, অচেনা দেশের অজানা বিষয়।

এত সব অজানা বিষয় নিয়ে কেন তিনি এ উপন্যাস লিখতে বসলেন, সে প্রসঙ্গে ভূমিকায় জানিয়েছেন। তা নতুন করে বলা বাহুল্য। বরং বর্তমানের সঙ্গে অতীতের মেলবন্ধন খুঁজে দেখা যেতে পারে। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট মুসলিম সাম্রাজ্যের আব্বাসীয় খেলাফতের প্রায় শেষভাগের। ঘটনাকাল সম্পর্কে লেখক জানান, দশম শতকের শেষার্ধে থেকে একাদশ শতকের মধ্যে বিস্তৃত। তিনি আরও বলেন, “উত্তর ইরানে আলবুর্জ পর্বতমালায় অবস্থান গ্রহণকারী শিয়া-ধর্ম সম্প্রদায়ের একটি উপদল কীভাবে গুপ্তহত্যাকারী, আত্মঘাতী দল গঠন করে ইতিহাসে চরমপন্থি সন্ত্রাসের প্রবর্তন করে- এ উপন্যাসে সেই কাহিনীকে তুলে আনা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এদের কৌশল ও মতাদর্শের সঙ্গে আজকের দিনের ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ বা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের সন্ত্রাসী পদ্ধতির যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়? ‘ইতিহাসের পথ ধরে অতীতের পুনরাবির্ভাব’ ঘটতেও পারে হয়তো।”
বর্তমান বিশ্ব-বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাস অনুসন্ধানের পাঠ হিসেবে ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটি এক রিয়েলিটির আর্ট হিসেবে ধরা যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে আলো আর অন্ধকার যেন চক্রাকারেই ঘুরছে। অন্ধকারের পর যেমন আলো আসে, তেমনি আলোর পরও অন্ধকার আসতে দেখা যায়। মুসলিম বিশ্বে আব্বাসীয় আমলেই মুসলিম রেনেসাঁ এসেছিল, অথচ কয়েক বছর পর আব্বাসীয় খেলাফতের প্রায় শেষভাগেই আবার অন্ধকার নেমে এলো। যে শিল্প রচনা করতে রিজিয়া রহমান নিয়েছিলেন বিখ্যাত ভেনেসীয় পর্যটক মার্কো পলোর ভ্রমণকাহিনী ‘দ্য ট্রাভেলস অব মার্কোপলো’ বইটির আশ্রয়। তিনি ইতিহাসের নানা অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাঠকের জন্য তৈরি করেছেন উপন্যাসটি, যা সেই ইতিহাসের এক গল্প হয়েই ধরা দেবে পাঠকের মনে। যা ইতিহাস নয়, ইতিহাসসম্মত উপন্যাস। যেখানে আমরা আমাদের জাতীয় কিছু সমস্যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি। ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসের ক্ষেত্র সুদূর ইতিহাসের, দেড় শতাধিক বছর ধরে চলা আলবুর্জের পর্বতমালার ধর্মীয় সন্ত্রাসী দলের আখ্যান নির্মিত হয়েছে মাত্র শত পৃষ্ঠায়, যা খুব সহজ কাজ বলে ধরে নিলে বোকামি হবে। কিন্তু শিল্পের বিস্তৃতি কেবল তার নির্মাণের আকারেই থাকে না; বরং এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যেও থাকে। বড় কোনো ইতিহাস, যার রূপ-রস-গন্ধ আপনি একশ’ পাতাতেই হাজার বছরকে অনুধাবন করতে পারবেন। যেমনটা আমি অনুভব করেছি এই উপন্যাস পাঠে। এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি একটি বইয়ে লিখেছিলেন, এ কথা সত্য যে যা পরিবর্জিত হয়, অর্থাৎ যা নেই, তার তাৎপর্য যা পরিগৃহীত থাকে, অর্থাৎ যা আছে, তার বিন্যাস থেকে রসিক পাঠক বা দর্শক অনুধাবন ও উপভোগ করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বিকৃতি-অনুকৃতির দৈশিক কালিক দিকের তুলনায় আত্মিক বা মানসিক দূরত্বের দিকটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা দেখানো যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে অদ্ভুতভাবে অনুভব করলাম, এই কাহিনীর সঙ্গে আমাদের কেমন আত্মিক আর মানসিক নৈকট্য স্থাপিত হয়। আজ সিরিয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিতে পরিবার ফেলে অথবা পরিবারসহ কত মানুষ পালিয়ে যাচ্ছে? তারা ধর্মের নামে প্রকৃতপক্ষে কী করে চলেছে? কেন? কাদের বিরুদ্ধে? এসব প্রশ্নে নিজেদের জর্জরিত করতে পারি। আমরা আজ আতঙ্কিত হই। বিহ্বল হয়ে পড়ি ভিন্ন মতবাদের মানুষ হত্যা, লেখক-প্রকাশক-ব্লগার হত্যা দেখে। হলি আর্টিসানের মতো ঘটনায়, শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজের হামলায় আমাদের জীবনবোধ শঙ্কিত। আবার আমাদের রাগ হয় যখন দেখি উন্নত বিশ্ব শরণার্থী নিতে চাইছে না! অথচ আমরা কি ভেবে দেখব না যে শরণার্থীরা বিধর্মী রাষ্ট্রে আশ্রয় পেতে চাইছে, দু’দিন বাদে সেই আশ্রয়দাতাকেও হামলা করে বসছে! এসবই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। বিশ্ব রাজনীতি এসবের পেছনে ইন্ধনদাতা। তবুও ভেবে দেখুন, ইসলামী সন্ত্রাসবাদকে মদদ দেওয়া যাচ্ছে! কেন এত তরুণ এমন সহিংস? কিসের আশায়? ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাস পাঠে ফিরে দেখা যাবে সেই সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস, তার নির্মাণ-কৌশল। হাশাশিনদের কথা, যেখানে ইতিহাসে প্রথম গুপ্তহত্যাকারী নির্মাণকে এক শৈল্পিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আজ বাংলাদেশে নাস্তিক হত্যা করার জন্য ধর্মের রক্ষাকর্তা হিসেবে যারা নিজেদের জাহির করছেন, তারা কি জানেন না ইতিহাসে অ্যাসাসিনদের হশাশিন বা হাশিশ সেবনকারী নাস্তিক্যবাদী বলে অভিহিত করা হয়েছে। আজ এই যে আইএস বা অন্যান্য স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন আসলে কোন নেশায় মত্ত? উপন্যাসের এই বাস্তবতা আজ আমাদের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কত শত বছর আগের গুপ্তহত্যা নতুন রূপে ফিরে আসে। শিল্প নির্মাণের প্রসঙ্গে এত বছর পরও রিজিয়া রহমানের ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটি সত্যিকার অর্থে লেখকের কল্পজগতের ক্ষমতার প্রকাশ, তা স্বীকার করতেই হয়। ফিকশন হিসেবে এই কাজটি গুরুত্বের দাবি রাখে। মনে রাখতে হবে, আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের এপ্রিলের দিকে, রিজিয়া রহমানের এ উপন্যাস প্রকাশ পায় ২০১০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১৩ সালে আইএসের গুপ্তঘাতকের দল নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে একাদশ শতকের ইরানের আলবুর্জ পর্বতমালায় স্থাপিত সুউচ্চ আলমুত গুহার দুর্গকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী বাহিনীর কথা। খোরাসানে জন্মগ্রহণকারী হাসান বিন সাব্বাহ ছিলেন যার নেতৃত্বে। তিনি শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। তার সাংগঠনিক ক্ষমতাও অসাধারণ। তিনি দুর্গে তৈরি করেছিলেন নকল বেহেশত। আশপাশের অঞ্চল থেকে ১২-২০ বছর বয়সের তরুণদের তুলে আনতেন। গুপ্তঘাতক তৈরির কর্মসূচি এটা, তেমনি অল্প বয়সের তরুণদের আজও আমরা খুঁজে পাই সুইসাইড স্কোয়াডে। আলমুত পর্বতের গুহায় শুধু তরুণদের নয়, সেখানে তরুণী ও যুবতীদের এনে রাখা হতো, যারা নৃত্য-গীতে পটিয়সী ছিল। এসব নারীকে বেহেশতের হুর হিসেবে উপস্থাপন করা হতো সেসব তরুণের সামনে, যারা হাশিশের নেশায় বুঁদ। তাদের আসক্ত করে নিতেন হাসান বিন সাব্বাহ। এদের সাসিক বা নবদীক্ষিত আখ্যা দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য হিসেবে নির্মাণ করা হতো, যার প্রধান শায়খ-উল-জাবাল হিসেবে উপন্যাসে আমরা পাই হাসান বিন সাব্বাহকে। তিনি এই সন্ত্রাসী বাহিনীকে শহীদ বা গাজি হওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করতেন। এই কার্যক্রমকে ধর্মের জন্য যুদ্ধ বা জিহাদ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তিনি সাসিকদের পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জিহাদের সঙ্গে এই সন্ত্রাসী কর্মকে তুলে ধরতেন নিজস্ব কৌশলে। সে লক্ষ্যে নকল বেহেশতের উদ্যান তৈরি করেছিলেন। যেখানে খোজা দাসদের সেবার জন্য রাখা হতো। রিজিয়া রহমানের ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটি এক অন্ধকার অধ্যায়ের শিল্পরূপ। যদিও শেষ পর্যন্ত লেখক আলোর প্রত্যাশায় তার নায়ককে মুক্ত করেন। শিল্পের এই রূপ প্রসঙ্গে হারবার্ট রিডের একটি উক্তি উল্লেখ্য। তিনি জানান, শিল্প যে অকাট্য সুন্দর, এ কথাও সব সময় ঠিক জোর দিয়ে বলা যায় না। সমস্যাটিকে যদি আমরা ইতিহাসের দিক থেকে (অতীতে শিল্প যা ছিল) বা সমাজতত্ত্বের দিক থেকে (আজকের যুগে দুনিয়াজুড়ে শিল্পের প্রকৃত স্বরূপের কথা মনে রেখে) বিচার করি, তাহলে দেখতে পাব যে আজ এবং চিরকালই শিল্পকে নেহাত সুন্দর জিনিস বলে ঠিক বর্ণনা করা চলে না, বরং প্রায় তা সৌন্দর্যশূন্য।
কল্পিত কাহিনী নয়, অতীত ইতিহাস ঘেঁটে ভিনদেশি এই আখ্যান নির্মাণ করেছেন রিজিয়া রহমান। কিন্তু আপনি যদি এই অতীতের সত্য অনুসন্ধান না করেই উপন্যাসটি পাঠ করেন, তাহলেও তার শিল্প-রস আস্বাদনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। কিন্তু ঔপন্যাসিক চান আমরা ইতিহাসটাও জানি, সে লক্ষ্যেই হয়তো তিনি বইটিতে এক দীর্ঘ ভূমিকা দিয়েছেন, এমনকি টীকা এবং সহায়ক গ্রন্থাবলির একটা তালিকাও দিয়েছেন। এই প্রয়াস ফিকশন হিসেবে ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটির কোনো দুর্বল সৃষ্টি হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করতেই পারেন। আমি যখন এ উপন্যাসের খোঁজ পেলাম আর দীর্ঘ ভূমিকা পাঠ করলাম, তখন পর্যন্ত উপন্যাস নিয়ে কিছুই বলার ছিল না। কিন্তু যখন আমি উপন্যাস পাঠ শুরু করি, যেখানে শুরুতেই ছিল প্রশ্নের নাটকীয়তা।
‘কারা তুগান কোথায়?
কোথায় তুমি তুগান?’
এরপর উত্তর ইরানের দামাবন্ধ পর্বতশ্রেণির চূড়াগুলোর বর্ণনায় ঢুকে পড়ি। সত্যি বলতে, তখন মাথায় কোনো ইতিহাস ছিল না। আমি কারা তুগানের পিছু নিয়েছিলাম। এক তুর্কমানের খোঁজে, যে ছিল মাজেন্দ্রানে। যে আজ হয়ে গেছে চাউস মাহদী! আমি যাই মঞ্জিল-ই-খাতুনে, পৌঁছে যায় আলমুত দুর্গবাসী সেই হাশাশিনদের কাছে। খুঁজে পাই দুর্গের আশপাশে বসবাসকারীদের বিশ্বাসের অবস্থানটি, তাদের সেই জিনের কারবার। অচেনা এক ভুবনে পাঠক তলিয়ে যাবেন। যেখানে অতি সাধারণ নারী জালালের মা আছে, যে দুটো মাদি গাধার মালিক বলে দুঃখ করে, ‘আহা, আরও কয়েকটা গাধা যদি তোর বাপ কিনে রেখে যেত, আরও বেশি দুধ পাঠাতে পারতাম কিল্লায়। আরও সাওয়াব হাসেল হতো।’
পূর্ণ অর্জনের জন্য তার এই আফসোস! অন্যদিকে উপন্যাসের নায়ক তুর্কিমান কারা তুগান, যাকে দুর্গে এনে নাম দেওয়া হয় চাউস মাহদী, তাকে ইমাম মেহেদীরূপে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় উপন্যাসে। যে হবে শেষ মুক্তির দূত। এ ক্ষেত্রে কারা তুগান এক মিথিক্যাল চরিত্রও বটে। শেষ পর্যন্ত কারা তুগান অন্ধকারকে শিরñেদ করে বেরিয়ে এসেছিল। এও এক বিশ্বাসের জোর নয় কি? সে বেরিয়ে আসে আলবুর্জ ছেড়ে। এই যে দুর্গের নির্মাণ, গল্পের বুনন যেখানে রয়েছে সন্ত্রাসের করণকৌশল। তা যেমন ঘটে যাওয়া ইতিহাস ছিল। সেই সত্যের শিল্পোপাখ্যান পাঠে পাঠক-হৃদয় রোমাঞ্চিত হয়ে উঠবে এখনও।
উপন্যাস পাঠের প্রায় বছর খানিক বাদে আবারও রিজিয়া রহমানের সঙ্গে দেখা করতে তার বাসায় উপস্থিত হই। প্রসঙ্গত, ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটি ছিল আলাপের অনেকটা অংশজুড়ে। তখন তিনি জানিয়েছিলেন এই উপন্যাস রচনাকালের টানাপড়েনের গল্প।
তিনি বলেন, লেখার শেষের দিকে ঘর থেকে বের হইনি। হয়তো বিকেলে উঠলাম, ধুমধাম করে সন্ধ্যায় গোসল করে আবার লিখতে বসতাম। তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না।
এমনটাই বুঁদ হয়েছিলেন তিনি। জানান, উপন্যাসের ঘটনা তো মিডলিস্টের ব্যাপার। নর্দান ইরান। ওইখানে সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছিল ইরাকের বাগদাদ শহরের বর্ণনা লিখতে। খুবই কষ্ট হয়েছিল। এ বই-সে বই কিছুতেই খুঁজে পাই না। খুব টেনশনে আছি। বাগদাদ চিন্তা করি মনে মনে এ রকম হবে… ও রকম… হবে। তো তারপর একদিন (খুব হেসে উঠলেন) স্বপ্নে দেখি বাগদাদের রাস্তায় হাঁটছি। মানে এত বাগদাদ মাথায় ঢুকেছে যে আমি বাগদাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি! আমার মনে পড়ে গেল, জীবনে লেখক রিজিয়া রহমান কত না দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। হয়তো বয়সের কারণে এখন আর যেতে পারেননি। তিনি যখন এই কথাগুলো বলছেন, তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেই খুঁজে ফেরা লেখকের জগৎ, কত উজ্জ্বল আলো ফেলছে স্মৃতি রোমন্থনে।
তিনি আরও জানান, আলবুর্জ পর্বতমালা, যেটা নর্দান মাজেন্দার। ওই জিনিসটা দেখার আমার ইচ্ছা। যেটাতে ওদের ঘাঁটি ছিল। কেমন এলাকাটা? ওখানে ঘরবাড়ি-গ্রাম আছে কি-না? ইরানি টেলিভিশনে খুব ভালো ভালো সিনেমা দেখাত। হঠাৎ একদিন দেখি যে নর্দান ইরান। ইরানের যে মাউন্টেন অ্যারিয়াটা আছে না, ওটা দেখাচ্ছে। আমি আল্লাহ্র ওপর এত খুশি হলাম! এটার জন্য পাগল হয়ে ছিলাম। মাথার ভেতর কেবল ছিল ওই আলবুর্জের পর্বতমালা। বাগদাদ আর দামেস্ক। দামেস্ক তো আমি পেয়েছি ইবনে বতুতার বইতে। তারপর মার্কোপলোর বইতে আর ইতিহাস থেকে পেয়েছি। কিন্তু ওই আলবুর্জ পর্বত তো পাচ্ছিলাম না। তো টিভিতে একদম কালার ছবি! উঁচু পর্বত যার ঢাল বেয়ে নিচুতে গ্রিন ভ্যালি। দুম্বা চড়ছে, ছাগল চড়চ্ছে। বাড়ি আছে।
পাঠক এ থেকে খানিকটা উপলব্ধি করতে পারবেন যে লেখক যখন কোনো কাহিনী লেখেন, মূলত তখন তিনি সেই কাহিনীর ভেতরই বসবাস করতে চান। রিজিয়া রহমান তা পেরেছেনও বটে। ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাস পাঠে আমার মনে হয়েছে, ঔপন্যাসিক ওই সময়টাতে প্রকৃত অর্থেই যেন আলমুত পর্বতমালা এবং সেই সময়টিতে ফিরে যেতে পেরেছিলেন বা সময়কে স্পর্শ করেছিলেন। আর তাই উপন্যাসটি হয়ে ওঠে হৃদয়স্পর্শী। ‘আলবুর্জের বাজ’ উপন্যাসটিকে অন্ধকারের শিল্প, তা আগেও বলেছি। যা পাঠের মাধ্যমে পাঠক অন্য এক জগতে প্রবেশ করবেন, যা আমাদের অতীত ও বর্তমান সেতু সম্পর্কে এক অভিজ্ঞান দিতে সক্ষম। যাবতীয় অন্ধকারের সময়কে সহজেই পাঠক হৃদয় স্পর্শ করবে, তাদের অতীত ও নিকটবর্তী সময়ের ব্যাখ্যায় নতুন কোনো খোরাক জোগাবে। যেখানে বহুমাত্রিক ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান তার কলমে আন্ধকারের চিত্রকে মুক্তি দিয়েছেন আলোর পথে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট