চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

শয়তানের চোখ

রহমান রনি

২৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০০ পূর্বাহ্ণ

কাল রাত থেকে বৃষ্টি পড়ছে। কখনো টুপটাপ, কখনো একদম ঝুপঝুপিয়ে। বৃষ্টি কার না ভালো লাগে। বৃষ্টি মানুষের ভেতরের একাকীত্বকে জাগিয়ে দেয়। এ একাকীত্বের মধ্যে মধুর কষ্ট লুকিয়ে থাকে। প্রচ- গরমের পর এমন বৃষ্টি সকলের জন্য স্বস্তি বয়ে এনেছে। তবে এখন আমি কিছুটা আতঙ্কিত। কারণ, অধিক বৃষ্টির ফলে পুরো চট্টগ্রাম শহর পানিতে তলিয়ে যাবে। মানুষের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না। কখন মানুষ এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে সেটা কেউ জানে না।

ভাড়া কমের জন্য চিলেকোঠায় বাসা নিয়েছি। বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় গরমে সিদ্ধ হয়ে যেতে হয়। শুধু বৃষ্টির দু’ তিন মাস নিজেকে খুব সুখী একজন মানুষ মনে হয়। তখন সব কিছুই ভালো লাগে। টিনের চালে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার শব্দ আমাকে কী যে আনন্দ দেয় সেটা বোঝানোর কোন শব্দ আমার কাছে নেই। তার মধ্যে যোগ হয়েছে প্রেম আনন্দ। প্রেম কিনা জানি না তবে মেয়েটিকে দেখতে আমার অনেক ভালো লাগে। একপলক দেখলেই শরীর মন দুটোই কেঁপে ওঠে। নিজের মনে শরীরে অদ্ভুত এক পরিবর্তন অনুভব করি। কিন্তু তার সাথে কথা বলার সাহস আমার নেই। আমি প্রচ- ভীতু মানুষ। সমাজে এতো এতো সাহসী মানুষের ভিড়ে আমি নগণ্য পোকামাকড়। প্রতিদিন দেশে সাহসীরা বেড়েই চলছে। প্রকাশ্যে তারা খুন করছে, ছিনতাই করছে, ধর্ষণ করছে। পুলিশ তাদের ধরছে, কারাগারে বন্দী করছে। কিছু ক্রসফায়ারে মারাও যাচ্ছে। তারপরও তারা অদৃশ্য কোন শক্তির ওপর ভর করে প্রতিদিন নতুন রূপে নতুন শক্তিতে ফিরে আসছে। এতো সাহস তারা কোথায় পায়? কিভাবে পায়? শুধু নিজের মধ্যে প্রশ্ন জাগে কেন আমি এমন ভীতু? একটি মেয়ের সাথে দু’টো কথা বলার সাহস যোগাতে পারি না। আর তারা সেখানে খুন, ধর্ষণ করে বেড়াচ্ছে! বৃষ্টি আরো জোরে এসেছে।

অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। থাক, ভিজে কাজ নেই। বরং চা পান করে বৃষ্টি দেখি, চোখ স্বর্গীয় সুখ লাভ করুক। চা বানিয়ে এনে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে আমার সমস্ত মন কেঁপে উঠেছে। মেঘ ডাকছে সেজন্য নয়, মেয়েটি ছাদে এসেছে। যখন আমি বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম তখন ছাদে পানির কল দেখে মেজাজ প্রচ- খারাপ হয়েছিলো। সকাল বিকাল মানুষ পানির জন্য আসে আর হৈচৈ করে। কিন্তু মেয়েটিকে যখন থেকে পানির জন্য আসতে দেখেছি তখন থেকে আমি বাড়িওয়ালার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাচ্ছি। মেয়েটি একদৃষ্টিতে কলসির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার অনেক অভিমান হলো নাম না জানা মেয়েটির ওপর। বৃষ্টির শব্দ, কলসিতে পানি পড়ার শব্দ, আমার চায়ের কাপের শব্দ ও মেয়েটির মৌনতা আমার ভেতর একজন শক্তিশালী কবির জন্ম দিলো। আমি মনে মনে তাকে নিবেদন করে অনেক প্রেমের কবিতা লিখে ফেলেছি। মেয়েটি কলসী নিয়ে চলে যাওয়ার সময় ডানে-বামে তাকালো না। এমনকি আমার দিকেও না। অতঃপর আহত চোখ দিয়ে তার চলে যাওয়া দেখেছি।

বিকালে যখন বাসা থেকে বের হচ্ছি, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মেয়েটি আমাকে দেখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে গেলো। তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সে দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছিল। সাহস করে বললাম, শোন- মেয়েটি থমকে দাঁড়ালো। আমার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি সাহস করে বললাম- তুমি আজ পায়ে নূপুর দাওনি? মেয়েটি তার সেলোয়ার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত তুলে নূপুর দেখালো। আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। মেয়েটি হয়তো ভাবলো, কথা বলার জন্য বাহানা করেছি। অথচ সত্যি আমি নূপুরের শব্দ শুনতে পাইনি। মেয়েটি চলে গেলো। আমি চেরাগীতে মনসুরের সাথে দেখা করতে আসলাম। মনসুর খুব প্রাণবন্ত মানুষ। বন্ধু হিসাবেও উত্তম। সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে সবসময় মেতে থাকে। তাকে দেখলে বোঝা যায় পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হয় শুধু মানুষের উপকারের জন্য। সমাজের জন্য তারা সবকিছু বিলিয়ে দেয় নিঃস্বার্থভাবে। চায়ের দোকানে বসে মনসুর দু’কাপ চা অর্ডার করলো। তারপর বুঝিয়ে দিলো কাল প্রেস ক্লাবের সামনে ধর্ষণ বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ কিভাবে হবে এবং কী কী আয়োজন করতে হবে। আমাকে কিছু স্লোগান লেখার দায়িত্ব দিল। আমি কাজ বুঝে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। ব্যস্ত সড়ক ব্যস্ত মানুষের ভীড় ঠেলে হাঁটছি আর ভাবছি সবকিছু কতই না স্বাভাবিক। কেউ খাচ্ছে, কেউ শপিংয়ে যাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথাও কোন সমস্যা নেই। সমাজের নরপশুরা যে ভেতরে ভেতরে আমাদের ছিঁড়ে খাচ্ছে, সেটা উপলব্ধি করার বোধ শক্তি হয়তো মানুষের কমে গেছে। বাসায় ঢুকে এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে আর্ট পেপারে কিছু স্লোগান লিখে ফেললাম। ‘ধর্ষকদের দ্রুত বিচার চাই’, ‘এ দেশে ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি। হঠাৎ চোখ তুলে দেখি মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম। আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটি বললো,

আপনাদের প্রতিবাদ সমাবেশ কখন হবে?
আমি বললাম, আগামীকাল।
আমি কি যেতে পারবো?
বিস্মিত হয়ে বললাম, অবশ্যই।
মেয়েটি ছলছল চোখে বললো, প্রতিবাদ সমাবেশ করলে কি নারীদের প্রতি নির্যাতন থেমে যাবে?
আমি চেয়ার থেকে উঠে বললাম, না। তবে, আমাদের কি উচিত নয় থেমে যাওয়ার জন্য আওয়াজ তোলা?
মেয়েটি চুপ করে রইলো।
তোমার নাম কী জানতে পারি?
আমার চোখ থেকে চোখ নামিয়ে বললো, অহনা।
অহনা, একটা প্রশ্ন করি?
করুন।
তুমি কেন প্রতিবাদ সমাবেশে যেতে চাইছো?
সে চোখ তুলে বললো, কারণ আমি প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছি।
তার কথা শুনে আমার মন বিষাদে ডুবে গেলো। তাকে আর কোন প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না। আমি জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলাম।

অহনা আমার কাছে এসে বললো, আমি যার বাসায় থাকি তিনি আমার দূর সর্ম্পকের আত্মীয় হন। তার ছেলে প্রতিদিন কোন না কোন ছলে আমার শরীর ছোঁয়ার চেষ্টা করেন। রাস্তায় বের হলে মনে হয় সবাই আমার শরীর দেখছে। সুযোগ পেলেই তারা আমাকে ছোঁবে। বাসে, টেম্পোতে, অফিসে সবখানে শত শত শয়তানের চোখ মেয়েদের শরীর চাটতে থাকে। অপেক্ষা করে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলার জন্য। আমি এই শয়তানের চোখ থেকে মুক্তি চাই।
তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমি একজন ভীতু মানুষ। কিন্তু প্রতিবাদ করতে আমি শিখে গেছি। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। অহনা আমার হাত ধরে বললো, এই প্রথম আমি শয়তানের চোখ নয়, একজন পুরুষের চোখ দেখছি। যার চোখে কাম নয়- আছে ভালোবাসা।
অহনাকে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। বৃষ্টি আরো বাড়ছে। মনে হচ্ছে সমস্ত নগরী আজ ডুবে যাবে। সবকিছু পানিতে তলিয়ে যাবে। শুধু আমি আর অহনা থাকবো একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট