চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রাহমানের কবিতা

পুরাণের আবরণে

কুমার দীপ

১৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪২ পূর্বাহ্ণ

মিথকে বাংলায় বলা হয় পুরাণ। মিথ এক ধরনের গল্প কিংবদন্তি। রিচার্ড চেজ বলেছেন, ‘মিথ হল জ্ঞান অবধারণের একটি মাধ্যম, চিন্তনের একট প্রক্রিয়া, জীবনের একটি দিক, ঠিক যেমনটি শিল্পকলা।’ (মিথচর্চার প্রসঙ্গ/নূরুল আলম আতিক সম্পাদিত ‘নৃ’)। মার্ক শোয়ার আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, ‘মিথেরা হল এমন ধরনের সরঞ্জাম, যা দিয়ে আমরা সবসময় পরস্পরের কাছে নিজেদের অভিজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টায় রত। সাধারণ জীবনের বাস্তবতাকে দার্শনিক অর্থদান করে মিথ, যা এক ব্যাপক নিয়ন্ত্রণকারী চিত্রকল্প।’ মিথ বিষয়ের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক জোসেফ ক্যাম্পবেল মিথের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে জানান, মিথ আপনাকে অন্তর্মুখী হতে শেখাবে, তখন দেখবেন ধীরে ধীরে প্রতীকের বাণী শুনতে পাচ্ছেন। (মিথের শক্তি/বিল ময়াসের সঙ্গে কথোপকথন/খলীকুজ্জমান ইলিয়াস অনূদিত।) তার মতে, মিথ বিশ্বকে রহস্যের মাত্রা পরায়, সব রকমের সাকারের পেছনে যে রহস্য থাকে তা মানুষকে উপলব্ধি করায়।
সাহিত্যে, বিশেষত কাব্য সাহিত্যে মিথের প্রয়োগ অনেক বেশি। একটি শক্তিমান মিথ মানুষের অভিজ্ঞতাকে বোধগম্য এবং সংঘবদ্ধ করে, যা থেকে বিশেষ বিশেষ গল্প কাহিনী বেরিয়ে আসে এবং এসব কাহিনীও সেই অভিজ্ঞতা থেকে অর্থবহ হয়ে ওঠে। শামসুর রাহমানের কবিতায় মিথ; বিশেষত গ্রিক মিথের অসাধারণ তৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। টেলে মেকাস, আফ্রোদিতি, ইকারুস, ইলেক্ট্রা, ডেডেলাস, অ্যাগামেনন, অ্যাকিলিস প্রমুখ গ্রিক পৌরাণিক চরিত্রসমূহ রাহমানের নন্দন ভাবনায় নবতর রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন- ‘ইকারুসের আকাশ’ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা ‘ইলেকট্রার গান’ গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত অ্যাট্রিয়ুস রাজবংশের বিখ্যাত বীর অ্যাগামেনন ও তার কন্যা ইলেকট্রার ছায়াবলম্বনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (অ্যাগামেনন) ও কন্যা শেখ হাসিনাকে (ইলেকট্রা) কেন্দ্র করে রচিত। পার্থক্য এই যে, ট্রয় জয়ের মহাসেনানী বীরের ধর্ম বজায় রাখতে গিয়ে নিজের দুই কন্যার একজন, ইফিজেনিয়াকে হত্যা করেন। ফলত, ক্ষুব্ধ ও হিংস স্বভাব স্ত্রী ক্লাইমেনেস্ট্রা কর্তৃক নিহত হন। অপর কন্যা ইলেকট্রা বাবার কবরের পাশে বিলাপ করতে থাকে পিতৃহত্যার প্রতিকারের আশায়। অতঃপর ভ্রাতা অরেস্টিসের হাতেই নিহত হন স্বামী হন্তারক জননী। অন্যদিকে শামসুর রাহমানের অ্যাগামেনন, বঙ্গবন্ধু, গ্রিক অ্যাগামেননের মতো শত্রু দেশে
(পাকিস্তানে) নিহত না হয়ে স্বদেশে ফিরে নিহত হলেও তা স্ত্রী নয়, তারই অধীনস্থ কতিপয় সেনা সদস্যের হাতে।
নন্দিত সেই নায়ক অমোঘ নিয়তির টানে/গরিয়ান এক প্রাসাদের মতো বিপুল গেলেন ধসে।/বিদেশী মাটিতে ঝরেনি রক্ত; নিজ বাসভুমে,/নিজ বাসগৃহে নিরস্ত্র তাকে সহসা হেনেছে ওরা।/নিহত জনক, অ্যাগামেনন্, কবরে শায়িত আজ।
তবে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, পদ্ধতির ভিন্নতা সত্ত্বেও রাহমানের ইলেকট্রাও বাবাসহ সবাইকে হারিয়ে একইভাবে অসহায় এবং প্রতিশোধের আগুনে জ্বলমান। কবির ভাষায়-
আমার উপমা দাবানলে-পোড়া আর্ত-হরিণী;/মৃতের মিছিল খুঁজি দিন-রাত, আঁধারে লুকাই মুখ।/করতলে কত গোলাপ শুকায়, ঝরে জুঁই বেলী;/আমার হৃদয়ে প্রতিশোধ জ্বলে রক্তজবার মতো।
গ্রিক পুরাণের আরও এক দিগি¦বিজয়ী বীর অ্যাকিলিস, যিনি কি না গোড়ালি ছাড়া সব শরীরের জন্য আঘাত অযোগ্য বর পেয়েছিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ী হয়েও গোড়ালিতে আঘাত পাওয়ার কারণেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। সেই আদলে সম্ভবত নিজেকেই উপস্থাপন করতে চেয়েছেন শামসুর রাহমান, যিনি গোড়ালিতে আঘাত পাওয়ার আশঙ্কায় অর্থাৎ মৃত্যুচিন্তায় শঙ্কিত। যদিও যকৃৎ তুখোড়, শরীর সুস্থ, তবু কবির মনে হয়, ‘যম/অসৌজন্যমূলক ভ্রুকুটি হেনে ঈশ্বরের স্তব্ধতার মতো/প্রাচীনতা নিয়ে হাসে,’ (অ্যাকিলিসের গোড়ালি/ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই)। অনুরূপভাবে পিতৃনিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আকাশে উড্ডয়নে উদ্ধত, অতঃপর নিহত ইকারুসকে নিয়ে কবিতা ‘ইকারুসের আকাশ’। নিষিদ্ধ রৌদের সমু¯্রে উড্ডীয়মান রক্ষাকবচহীন ইকারুসের অমরত্বময় শিহরণের ছবি আঁকতে গিয়ে সাধের আকাশে সদা-উদ্ধত মানুষের চরম পরিণতি নিয়ে দার্শনিক সত্য উচ্চারণ করেছেন রাহমান- ‘কখনো মৃত্যুর আগে মানুষ জানে না/নিজের সঠিক পরিণতি। পালকের ভাঁজে ভাঁজে/সর্বনাশ নিতেছে নিঃশ্বাস।’
ইকারুসকে নিয়ে শামসুর রাহমানের আরও একটি চমৎকার কবিতা আছে ‘শিরোনাম মনে পড়ে না’ কাব্যে। ‘ইকারুসের জন্ম’ নামক এই কবিতাতেও কবি ইকারুসের আকাক্ষায় আত্মচেতন। আবার ইকারুসের পিতা ক্রিট দ্বীপের বিখ্যাত কারিগর (‘বিশ্বকর্মা’ প্রকৃতির) ডেডেলাসের প্রতিচ্ছবি নিয়ে রচিত হয়েছে শামসুর রাহমানের ‘ডেডেলাস’ কবিতাটি। এখানে কবি নিজেই ডেডেলাস, যিনি একটি পুত্রকে ইকারুসের মতো আকাশে না হলেও পানিতে ডুবে মরার শোকে সন্তাপিত।
পিতা আমি, তাই সন্তানের আসন্ন বিলয় জেনে/শোকবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ পাখির মতন দিশাহারা;/শিল্পী আমি, তাই তরুণের সাহসের ভস্ম আজ/মৃত্যুঞ্জয় নান্দনিক সঞ্চয় আমার। ( ডেডেলাস/ইকারুসের আকাশ)
বিশ্বখ্যাত গ্রিক মহাকাব্য ওডিসি’র শ্রেষ্ঠতম বীর ওডিসিউসের পুত্র টেলেমেকাসের পিতৃ প্রতীক্ষার বেদনা নিয়ে রাহমানের কবিতা ‘টেলেমেকাস’।
ষাটের দশকের স্বদেশ যখন দখলদার পাক-বাহিনী ও তাদের মিত্রবর্গের মাতাল-শোষণে পর্যুদস্ত, তখন শামসুর রাহমান ওডিসিউসহীন ইথাকার বিপর্যস্ততার শরীরে বসিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। ওডিসিউসের মতো কোনো বীরের অপেক্ষায় কবি বলেন, ‘ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/দরজা আগলে, পিতা অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।’
আফ্রোদিতি গ্রিকপ্রেমধিষ্ঠাত্রী দেবীকে নিয়ে অনেক পঙ্ক্তি ব্যয়িত হয়েছে বাংলা কবিতায়। রাহমানেরও একাধিক কবিতায় আফ্রোদিতির উপস্থিতি থাকলেও এককভাবে তাকে নিয়ে লিখিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’র ‘নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতি’ কবিতাটি। পঁচাত্তর-পরবর্তী ব্যর্থ বাংলাদেশে একজন ব্যর্থ ব্যক্তি মানুষের মনোবেদনার চিত্রকল্প তৈরি করেছেন কবি।
দেবতাদের বাইরে, যাকে পৃথিবীর সম্রাট হিসেবে দেখানো হয়েছে সেই বংশীবাদক অর্ফিয়ুসের বেদনার্ত হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি নিয়ে শামসুর রাহমানের কবিতা ‘যেন অর্ফিয়ুস’। তবে অর্ফিয়ুসের অসীম বেদনা নয়, তার বাঁশির মতোই জীবনের জাগরণের কথা বলেছেন কবি। বলছেন, ‘ভস্মের আড়াল থেকে/নতুন গোলাপ নিয়ে’ জীবনের নেচে ওঠার কথা।
গ্রিক নাট্য-মহীরূহ সফোক্লিসের বিখ্যাত ‘আন্তিগোনে’ নাটকের প্রধান চরিত্র আন্তিগোনেকে নিয়ে ‘বন্দী শিবির থেকে’র স্বরমাত্রিক কবিতা ‘আন্তিগোনে’। থিবিস বংশের রাজপুত্র, পিতৃঘাতী ও মাতাকে পত্নীরূপে গ্রহণকারী অভিশপ্ত রাজা ইডিপাসের কন্যা আন্তিগোনে।
অন্তর্বতীকালীন রাজা ক্রেয়নের স্বৈরতান্ত্রিক আদেশে যখন যুদ্ধাহত ভ্রাতা পলিনাইসিসের লাশ সৎকারহীন পড়ে থাকে, তখন মৃত্যুদ-াদেশ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায় অকুতোভয় আন্তিগোনে। সৎকার করে লাশ। এই আন্তিগোনেকেই কবি আহ্বান করেছেন একাত্তরের বাংলাদেশে; যেখানে অগণিত যুদ্ধাহত স্বদেশী ভ্রাতার সৎকারহীন মৃতদেহ শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কবির ভাষায়-
আন্তিগোনে দ্যাখো চেয়ে-/একটি দুটি নয়কো মোটে,/হাজার হাজার মৃতদেহ/
পথের ধুলোয় ভীষণ লোটে।
‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’র ‘ট্যান্টেলাস’ কবিতাটি গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত রাজা ট্যান্টালাস-এর বেদনাবিধূর জীবন পরিণতি নিয়ে রচিত। ট্যান্টেলাসের মতোই আজীবন ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার আগুনে নিমজ্জিত কোন চরিত্রের চরম অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি বয়ান করেছেন রাহমান।
মিসরীয় কিংবদন্তির বিখ্যাত ফিনিক্স পাখির জীবন ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত হয়েছে ‘মাতাল ঋত্বিক’র ‘ফিনিক্সের গান’ এবং ‘হরিণের হাড়’র ‘পুরাণের পাখি’ কবিতা দুটি। ফিনিক্স পাখি, যে কিনা নিজের জ্বালানো আগুনে আত্মাহুতি দেয় আবার সেই ভস্মরাশি থেকে পুনর্জন্ম লাভ করে। এবং জীবনযাপন শেষে পুনঃপুন একই কাজ করে সে। এই ফিনিক্স পাখিকে কবি প্রতিস্থাপন করেছেন নব্বই দশকের প্রগতিশীল আন্দোলনে নিহত ছাত্রনেতা রাজুর চরিত্রে। নিহত হলেও রাজুর মতো প্রতিহিংসার আগুনে পোড়া মানবতার পূজারী ফিনিক্স পাখিরা বারবার ফিরে আসে পৃথিবীতে। রাহমান বলেন,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে, তুমি বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের পাখি। (পুরাণের পাখি/হরিণের হাড়)
‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’ গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘টাইরেসিয়াসের মতো’। টাইরেসিয়াস গ্রিক নাটকের বিখ্যাত ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা।
কিন্তু অন্ধ ত্রিকালজ্ঞ টাইরেসিয়াস নয়, টাইরেসিয়াসের মতো কোন এক জন্মান্ধ বৃদ্ধের গণ-অধিকার আদায়ের মিছিলে যোগদানকে তার জ্ঞাত ভবিতব্য হিসেবে বোঝাতে টাইরেসিয়াসকে টেনে এনেছেন কবি। এই টাইরেসিয়াস আসলে বাংলাদেশের শুভ আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা।
ভারতীয় পুরাণের ব্যবহার রাহমানের কবিতায় বিশেষ প্রতিফলিত নয়। গ্রিক পুরাণের ঐশ্বর্যের প্রতি দুর্বলতার কারণেই হোক, আর হিন্দু-মুসলিম পুরাণের নৈকট্যের কিংবা সহজলভ্যতার কারণেই হোক কিংবা মুসলিম পুরাণ ব্যবহারের বিপজ্জনক স্পর্শকাতরতার ভয়েই হোক; প্রতীচ্য পুুরাণের নান্দনিকতাতেই আস্থাশীল ছিলেন আধুনিক মননের শামসুর রাহমান। তবু প্রাচ্য পুরাণ বা পুরাণসদৃশ যে দু-একটি চরিত্রের প্রতি রাহমানের দুর্বলতা ছিল তাদের মধ্যে চাঁদ সদাগর প্রধানতম। মাইকেল মধুসূদন দত্তের যেমন রাবণ চরিত্র, শামসুর রাহমানের তেমনি চাঁদ সদাগর। মধুসূদন ‘রামায়নের প্রথাগত চেতনার বাইরে গিয়ে অমরত্ব দিলেন রাবণকে, আর রাহমান মনসামঙ্গলের আপাত পরাজিত চাঁদ সদাগরকেই করলেন মানব চেতনার ধারক। দু’জনেই নিয়তির শিকার হলেও আমৃত্যু দৃঢ়, প্রবল ব্যক্তিত্ববান এবং অন্যায় দৈবশক্তির বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সংগ্রামরত। সার্থক বাংলা মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ মাইকেল মধুসূদন দত্তের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি; আর ‘চাঁদ সদাগর’ শামসুর রাহমানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পসফল দীর্ঘ কবিতা। চাঁদ সদাগর ও রাবণ উভয়ই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দুটি আত্মপ্রত্যয়ী চরিত্র। চাঁদ সদাগরের সাত-সাতটি পুত্র সর্পদেবী মনসার প্রতিহিংসার বিষে মৃত। সপ্তডিঙা নৌবহর ডুবে সহায়-সম্বলহীন সদাগর নিঃস্ব, রিক্ত, ক্লান্ত। অভুক্ত ও হৃতদীপ্ত সদাগর তবুও ক্ষমতাধর দু’জন, মনসার কাছে মাথানত করতে রাজি নন। বরং নব উদ্যমে আত্মশক্তি পুনরুদ্ধারের প্রত্যয়ে তিনি অহংদীপিত। চাঁদ সদাগরের এই অতি মানবীয় ঔজ্জ্বল্যকে পুঁজি করে বাংলাদেশের স্বৈরশাসন ও স্বৈরনিয়ন্ত্রিত সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন শাসসুর রাহমান।
এখন বাছে না/ঠগ কেউ, পাছে গাঁ উজাড় হয়ে যায়, উপরন্তু/নারীর শ্লীলতাহানি করে না অবাক কাউকেই।
সৎ-অসতের ভেদাভেদলুপ্ত সমাজে, যেখানে বিদ্বানেরা প্রভাবশালীর কৃপালোভে ভিক্ষাজীবী; আদর্শ যেখানে বিনষ্ট ফলের মতো নর্দমায় ভাসমান, সেখানে কবি একাই যেন ডিঙির মতন ভাসছেন দুঃখের সাগরে। চারদিকে এমনই অবস্থা, যেখানে চেনা সব কিছুই অচেনা লাগছে। ‘যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোন ধ্বনি নেই; ‘নাগিনী ছাড়া অন্য কোন প্রাণী নেই’; ‘যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কবির অভীষ্ট/কোন জয়গাথা নেই, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রেত ছাড়া/অন্য কোন বাসিন্দার আনাগোনা নেই।’ তবুও চাঁদ সদাগরের মতোই দৃঢ় কবিমন। অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে পিছিয়ে যেতে নারাজ। চাঁদ সদাগরীয় আবেশে কবির স্পন্দনশীল উচ্চারণ-
যতদিন হিন্তাল কাঠের/লাঠি আছে হাতে, আছে/ধমনীতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে/আমার মুহূর্তগুলি ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে/নিমেষে উঠবে ভেসে কোন শোভাযাত্রার মশাল,/করবো না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন,/যতই দেখাক ভয় একশীর্ষ, বহুশীর্ষ নাগ,/ভিটায় গজাক পরগাছা বারংবার, পুনরায়/ডিঙার বহর ডোবে ডুবুক ডহরে শতবার,/গাঙুড়ের জলে ফের ভেসে যাক লক্ষ লখিন্দর।
এরকম আকাশস্পর্শী আত্মঅহমিকাপ্রবণ মানসতায় আর কোন ভারতীয় মিথকে বা মিথিক্যাল চরিত্রকে নিয়ে রাহমানের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের মতো গভীরতর শূন্যতাবোধের কথা কিংবা মেঘদূত কাব্যের অলকাপুরীর মতো বিখ্যাত স্থানের অপরিসর উল্লেখ আছে। আছে যিশু-ওসমানদের মতো দু’একজন ধর্মমানুষের কথা। এছাড়াও প্রতীচ্যের রবিনসন ক্রশো, আরাগঁ, হোমার, লোরকা, পাস্তারনাক, অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখের মতো ব্যক্তি, ‘হ্যামলেট; ‘দাস ক্যাপিটাল’র মতো সাহিত্য এবং প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ প্রমুখের মতো ব্যক্তি, ‘গীতাঞ্জলি; ‘বনলতা সেন’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’র মতো সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়গুলো মিথিক্যাল মর্যাদায় প্রতিস্থাপিত হয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। এবং এটা বলাই বাহুল্য যে, মিথ বিশেষ গ্রিক মিথ, রাহমানের কবিতার একটি অংশকে অসাধারণ নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ করেছে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট