চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের প্রবন্ধে

রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা

শাকিল আহমদ

৯ আগস্ট, ২০১৯ | ১:২০ পূর্বাহ্ণ

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) পনের/ষোল বছর বয়স থেকে মননশীল সাহিত্য প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। জীবনের প্রথম দিকে তিনি মূলত সৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচনা এবং তুলনামূলক সাহিত্যালোচনার মধ্য দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেন। ফাল্গুন ১২৮৪ বাংলা সনে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের উপর যে বিশদ বিশ্লেষণমূলক সাহিত্যালোচনা, এতো অল্প বয়সে প্রকাশিত হয়তো সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। এই লেখা থেকে সহজেই অনুমিয় এতো অল্প বয়সে রবীন্দ্রনাথের পাঠের ও লিখার গভীরতা কোন পর্যায়ে ছিল। পরবর্তীতে প্রবন্ধ সাহিত্যের এ-ধারা নানা মাত্রিকাতায় রূপ লাভ করে। সমাজের এমন কোন বিষয় বাদ পড়েনি যা তাঁর চিন্তা শক্তিকে বিদ্ধ করেনি। প্রবন্ধের মাধ্যমে তাঁর দর্শন ও বিশ্লেষণী চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন-সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও কৃষিসহ সমাজের প্রতিটি বিষয়ে।
বিশ শতকের শূন্য দশক থেকে রচিত প্রবন্ধাবলীকে যদি আমরা রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের রচনা হিসেবে বিবেচনা করি, তবে এতে দেখা যায়, জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো রয়েছে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫-১১), ইওরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ (১৯১২-১৯১৩), নোবেল পুরস্কার (১৯১৩), প্রথম বিশ^ যুদ্ধ (১৯১৪-১৮), স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা, সা¤্রজ্যবাদের আগ্রাসন ইত্যাদি।’ এসব ঘটনাবলী রাবীন্দ্রীক চিন্তায় গভীরভাবে রেখাপাত করে। তাঁর এই চিন্তাশ্রিত অধিকাংাশ প্রবন্ধই ‘কালান্তর’ (১৯৩৭) প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত হয়। আর এ-সমস্ত প্রবন্ধাবলীতে অধিকতর স্থান পেয়েছে তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিক বিশ্লেষণ। শত আলোচনার মাঝেও আজ শতাব্দীর পরিক্রমায় এসেও রবীন্দ্রনাথের এ-সমস্ত প্রবন্ধাবলী পুন আলোচনার দাবি রাখে বৈকী! তাঁর রাজনৈতি-সামাজিক চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিক আলোচনায় একটি বিষয় পরিষ্কার, তা হলো সময়ের বাঁক বদলের সাথে সাথে তিনি একই বিষয়ে সব সময় স্থির থাকতে পারেননি। সামাজিক-রাষ্ট্রিক বাঁক বদলের সাথে সাথে অনেক সময় তাঁর সময়োপযোগী মতেরও পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই পরিবর্তন হচ্ছে রাবীন্দ্রীক চিন্তায় প্রাজ্ঞতার ফসল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো তিনি নিজেই বলেছেন-‘নদী যেমন বাঁক ফের, সাহিত্যও তদরূপ গতি বদলায়, আর এই গতি বদলানোটাই হচ্ছে আধুনিক। ইংরেজীতে যাকে বলে গঙউঊজঘ।”
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ও সামাজিক মতামতকে সমাজ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতেন বলেই তাঁর এ-সব বিষয়ের ওপর লেখা-লেখি ও চিন্তা-ভাবনাগুলোকে কেন্দ্র করে কম আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা হয়নি। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্ধসায় অনেকের মনগড়া ব্যাখ্যার জন্য এসব বিষয় তাঁকে ক্ষণিকটা বিচলিত ও হতে দেখা গেছে। তাঁর মতে- “যখন খবর পাই, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি সম্বন্ধে আমার বিশেষ মত কী তা আমার রচনা থেকে কেউ উদ্ধার করবার চেষ্টা করছেন,তখন নিশ্চিত জানি, আমার মতের সঙ্গে তাঁর নিজের মত মিশ্রিত হবে। দলিলের সাক্ষ্যের সঙ্গে উকিলের ব্যাখ্যা জড়িত হয়ে যে জিনিসটা দাঁড়ায় সেটাকে প্রমাণ বলে গণ্য করা চলে না।” (রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত, ১৯২৯)।
রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক ও সমাজনৈতিক ভাবনাগুলো অত্যন্ত গভীর এবং খানিকটা জটিল ও মিশ্র চিন্তার বহিঃপ্রকাশও বটে। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে রাবীন্দ্রীক যুগটি ছিল ইংরেজি শাসিত ভারতবর্ষ এর সাথে স্বভাবতই যুক্ত ছিল পরাধিনতার যন্ত্রণা, জাতীয়তাবাদের সাথে বিপ্লবী আন্দোলনও। সামাজিকভাবে হিন্দু-মুসলিম বৈরিতাও ছিল চরমে। আর সমগ্র বিশ^জুড়ে সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন তো ছিলোই। এ-সব বিষয়াদী নিয়েই মূলত রবীন্দ্রীক চিন্তা-চেতনা নানা-মাত্রায় পল্লবিত হয়ে ওঠে বিশেষ করে পরিণত বয়সে বিভিন্ন রচনাবলী ও সভা-সমিতির বক্তব্যে। রবীন্দ্রনাথ তথাকতিথ রাজনীতিবিদ ছিলেন না। এবং এ ব্যাপারে তাঁর কোন পক্ষপাতিত্ত্বও কোন সময়েই ছিল না। সমগ্র ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি সভ্যরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা ছিল তার মূল স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নের কথা বিভিন্ন রচনাবলীতে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকাশ করেছেন মাত্র, যা অনেক সময় নির্ভুল-সত্যনিষ্ঠ ও প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর রচনার কিছু উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হবে যে, রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে সমাজজীবন পর্যন্ত তিনি কোথাও কাউকে এতটুকু ছাড় দিয়ে কথা বলেন নি।
-“সাধনা পত্রিকায় রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আমি প্রথম আলোচনা শুরু করি। তাতে আমি এই কথাটার উপরেই বেশি জোর দিয়েছি। তখনকার দিনে চোখরাঙিয়ে ভিক্ষা করা ও গলা মোটা করে গর্বমেন্টকে জুজুর ভয় দেখানোই আমরা বীরত্ব বলে গণ্য করতাম।———ইতিমধ্যে কার্জন লাটের হুকুমে দিল্লির দরবারের উদযোগ হল। তখন রাজ শাসনের তর্জন স্বীকার করেও আমি তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলুম। সেই প্রবন্ধ যদি হাল আমলের পাঠকেরা পড়ে দেখেন তবে দেখবেন, ইংরেজের সঙ্গে ভারতবাসীর রাষ্ট্রিক সম্বন্ধের বেদনা ও অপমানটা যে কোথায়, আমার সেই লেখায় কথাটা প্রকাশ করেছি।” দরবারকে নিয়ে তাঁর কঠিন-কঠোর সাহসী মনোভাবের পর পরক্ষণে এসে তিনি ভারতবাসীকে স্মরণ করে দিতে চান-“আমাদের নিজের দেশ যে আমাদের নিজের হয়নি তার প্রধান কারণ এ নয় যে, এদেশ বিদেশীদের শাসনাধীনে। আসল কথাটা এই যে, যে দেশে দৈবক্রমে জন্মেছি মাত্র সেই দেশকে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, তপস্যা দ্বারা, জানার দ্বারা, বোঝার দ্বারা সম্পূর্ণ আত্মীয় করে তুলিনি-একে অধিকার করতে পারিনি। নিজের বুদ্ধি দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, প্রেম দিয়ে যাকে গড়ে তুলি তাকেই আমরা অধিকার করি, তারই, পরে অন্যায় আমরা মরে গেলেও সহ্য করতে পারিনে। কেউ কেউ বলেন, আমাদের দেশ পরাধীন বলেই তার সেবা সম্বন্ধে দেশের লোক উদাসীন। এমন কথা শোনবার যোগ্য নয়।” (রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা, ১৯২৯) রবীন্দ্রনাথের এ-ধারণা যে কতটা সত্য তা স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ সময় পরও রবীন্দ্রনাথের প্রায় শতবর্ষ পর এসেও সত্যনিষ্ঠ প্রমাণিত হয়। যখন দেখি স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের উদাসীনতা। বিশ শতকের শুরু থেকে রবীন্দ্র চিন্তায় রাজনৈতিক শাসকদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এবং সা¤্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরোদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় লক্ষ্য করা যায়।
মানবতাবিরোধী প্রথম বিশ^যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের মনকে চরমভাবে আন্দোলিত করে। ফলস্বরূপ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকা-ের তীব্র প্রতিবাদ, গান্ধী চিত্তরঞ্জনকে সাথে নিয়ে নানা সভায় প্রতিবাদ ও শেষ পর্যন্ত নিজের নাইটহুড খেতাব পর্যন্ত বর্জন করেন তিনি। সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী চরিত্রে বিশে^র শ্রমজীবী মানুষকুল যে এর অন্যতম শিকার। তা মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একমাত্র মানবতায় মুক্তির পথ, সভ্যতার পথ, বলে গেছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও।-“ মানুষ একলা থাকতে পারে না। তার সভ্যতা এই যে, সকলের যোগে যে বড়ো হয়, সকলের সঙ্গে মিমলতে পারলেই তার সার্থকতা, এই হল মানুষের ধর্ম। যেখানে এই সত্যকে মানুষ স্বীকার করে সেখানেই মানুষের সভ্যতা। …ইতিহাসে যেখানে মানুষ একত্র হয়েছে অথচ মিলতে পারেনি, পরস্পরকে অবিশ^াস করেছে, অবজ্ঞা করেছে, পরস্পরের সার্থকে মেলায়নি-সেখানে মানুষের সভ্যতা গড়ে উঠতে পারেনি।” (নবযুগ ১৯৩৩)
প্রথম বিশ^যুদ্ধের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন- মূলত বাণিজ্য, সা¤্রাজ্য ও প্রভূত্বপরায়ণতাকে বিস্তারের লক্ষ্যে বিশে^র অসহায় জনগোষ্ঠীর ওপর এহেন অত্যাচার। লড়াইয়ের মূল (১৯১৫) প্রবন্ধে তিনি বলেন-“প্রভূত্ব জিনিসটা একটা ভার, মানুষের সহজ চলাচলের সম্বন্ধের মধ্যে একটা বাধা। এই জন্য প্রভূত্বই যত কিছু বড়ো বড়ো লড়াইয়ের মূল। বোঝা নামাইয়া ফেলিতে যদি না পারি, অন্তত বোঝা সরাইতে না পারিলে বাঁচি না। পাল্কির চেহারা তাই বারবার কাঁধ বদল করে।” রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ জাতীকে দু’ধারায় বিচার করতেন। যারা ভারতবর্ষে এসে দেশ শাসনের কাজে নিয়োজিত তাদের কে ছোট অর্থাৎ অমানবিক এবং যারা ইউরোপে অবস্থান করছে তাদেরকে বড়ো অর্থাৎ মানবিক গুণসম্পন্ন বলে গণ্য করে রচনা করেন ‘ছোট ও বড়ো’ (১৯১৭) প্রবন্ধটি। এখানে হয়তো রবীন্দ্র চিন্তায় ভুল ছিল বলেই তিনি প্রবন্ধের শেষাংশে এসে আসা পোষণ করেছিলেন-“বর্তমান চেহেরা যেমনি হোক, তবু এই আশা, এই বিশ^াস, মনে দৃঢ় করিয়াছি যে, পশ্চিম পূর্বের সহিত মিলিবে।” তাঁর ধারণা ছিল যে, একদিন পশুত্বের অবসান ঘটে মনুষ্যত্বের জাগরণ আসবে। কিন্তু কার্যত কখনো তার প্রতিফল পরিলক্ষিত হয়নি।
ভারতবর্ষের সামাজিক চিন্তায় হিন্দু-মুসলিম বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের কাছে বড় উদ্বেগের কারণ ছিল বৈকী। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে ছিল দেশ ভাগের আগে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ মিটিয়ে এক কাতারে আসতে হবে-অন্যতায় দেশভাগের সুফল ঘরে তুলতে পারবেনা। হিন্দু-মুসলমান এক কণ্ঠ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারলে ভারতবর্ষের ভাগ্য যে সুপ্রসন্ন হবে এতে রবীন্দ্রচিন্তায় কোন দ্বিধা ছিল না, ভুল ছিল না। হিন্দু-মুসমান সম্পর্কটি রবীন্দ্রনাথের কাছে বরাবরই একটা বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে ছিল। যা তিনি বিভিন্ন রচনাতেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর পরিণত বয়সের রচনা কালান্তরেই ‘হিন্দু-মুসলমান’ শিরোনামে দু’টি প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। যদিও বা দু’টি প্রবন্ধের রচনা কালের দুরত্ব নয় বছরের। একটি ১৯২২ সালের, অপরটি ১৯৩১ সালে রচিত। তথাপি দু’টি প্রবন্ধেই দুই সম্প্রদায়ের অনেক বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা পরিলক্ষিত হয়। এবং এ-বিষয়ে তাঁর অনেক উদ্বেগের কারণও প্রতিয়মান হয়। “ভারতবর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে-ধর্ম মতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল। আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্ম মতে প্রবল। এক পক্ষের যেদিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সেদিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে।” (হিন্দু-মুসলমান, ১৯২২)। ধর্ম মত এবং সামাজিকতার দিক থেকে দু’ ধর্মের মধ্যে চরম বিরোধ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে দু’এর ঐক্য একান্তভাবে কামনা করেছেন। তাঁর বিভিন্ন রচনাতে। কিন্তু সেই বিরোধের কী শতাব্দীকাল পর এসেও সম্পূর্ণ সুরাহা হয়েছে? নিশ্চয়ই নয়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তাঁর কাছে ধর্মের চেয়ে মানুষের আরাধ্যই সব সময় প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। মানুষের ধর্মীয় রঙের অতিরঞ্জনকে তিনি দেখতে অবস্থত ছিলেন না কখনো। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নিয়ে তিনি সবসময় উদ্বভিগ্ন ছিলেন। কোলকাতায় কোন একবার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার সময় কবি জোড়াসাঁকোতে অবস্থান করছিলেন। সেদিন অনেক মুসলমান ভীত মন্ত্রস্ত ও দিক বিদিক হয়ে প্রাণ বাঁচাতে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ-হেন অবস্থা দেখে কবি মনে প্রচ- রেখাপাত করেছিল এবং তিনি এই মনোবেদনা থেকে লিখেছিলেন-“ এই মোহমুগ্ধ ধর্ম বিভীষিকার চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো।” ধর্মীয় গোড়ামি এবং সাম্প্রদায়িক বিষ-বাষ্প ছড়ানোকে তিনি নিকৃষ্টতমও গ্রহিত কাজ কনে করতেন। তাঁর মতে-“মানুষ খাটো হয় তখন, যখন সে অন্যের সাথে মিলিত হতে পারে না। পরস্পর মিলিয়া যে মানুষ, সে মানুষই পুরো মানুষ। একলা মানুষ টুকরো মানুষ।” তাঁর কাছে মানব ধর্মই প্রধান। তিনি দেশ বিভাগ হলেই দুই বাংলা এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ফিরে আসবে এমটি কখনো মনে করেন নি। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ হলেও তাঁর যে চিন্তাশক্তি তা যথার্থই প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুই সম্প্রদায় নিয়ে তাঁর যে শঙ্কা ছিল তা আজ অবধি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি উভয়দেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এখনো এদেশে দেখা যায় নির্বাচনের নামে দেশের রাজনৈতিক কোন পট-পরিবর্তনের সময় ঘটতে থাকে ধর্মীয় রঙে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানা দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এমনকি সম্প্রতিও ভারতের কিছু কিছু প্রদেশেও নির্বাচনের আগেও পরে অনেক জায়গায় সামান্য গোজবায় এবং মাংস পরিবহনের মতো নানা অপরাধে প্রকাশ্য রাস্তায় বেদরক পেটানো হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের মতে-মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মতো এতো বড় সর্বনেশে অন্ধকার আর নেই। ধর্মের নামে দুই সম্প্রদায়ের কিছু ধর্মান্ধ মানুষের মনের কালিমা যতদিন দূর না হবে ততদিন শুধুমাত্র বিভাজনে কোন সুফল বয়ে আনবে না। রবীন্দ্রনাথের এহেন ভাবনা-চিন্তা শতবছর পর এসে আজকের সমাজ প্রেক্ষাপটেও চিন্তার উদ্রেক বটে। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ তথাকথিত রাজনৈতিক ও সমাজ চিন্তক না হলেও তাঁর অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা পরবর্তী সময়ে নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের বড়াবড়ই ধারণা ছিল, শিক্ষা, সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এক ভারতবর্ষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইংরেজদের এক ব্যাপক ভূমিকা থাকবে। আর এই চিন্তা-চেতনা থেকে তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধে আমরা বুঝে নিতে পারি তিন সমন্বয়বাদী ধারণাকে লালন-পালন করে এক সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তো তিনি দেশ বিভাজনের মধ্যে প্রকৃত সমাধান কখনো খুঁজে পাননি। কারণ এতে রয়েছে দুই ধর্ম হিন্দু-মুসলমানের এক বড় ধর্মীয় বিরোধ। যা উভয় ধর্মান্ধ মানুষের মনের পরিবর্তন না আসলে কখনো শান্তির সুবাতাস বয়ে আনবে না এই ভারতবর্ষে। তাই রবীন্দ্রনাথ জাতীয় জীবনের নানা পর্যায়ে সচেষ্ট ছিলেন হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়িক ঐক্যকে অটুট রাখতে। সভা-সমিতি, প্রবন্ধ রচনা, কবিতা, গল্প উপন্যাস, সঙ্গীত সবক্ষেত্রেই তিনি জাতীয় ঐক্যের সুর তুলেছেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিকগণও রক্ষনশীল হিন্দু সমাজ তা কখনো আমলে নেয়নি বলে এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের হতাশাও পরীলক্ষিত হয়।
দেশের অগ্রগতিতে নারী স্বাধীনতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক স্বচ্ছ ধারণা ছিল। চার দেয়ালের মধ্যে বন্দীদশা দেখে দেখে রবীন্দ্রনাথের বাল্যকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। সে সময় যে দু’ চারজন মেয়েরা সবেমাত্র স্কুলে যেতে শুরু করেছে তার মধ্যে অন্যতম তাঁর বড় দিদি ছিল, তাও দ্বার-খোলা পাল্কিতে চরে স্কুলে যেতেন।
রবীন্দ্রনাথের বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেটি তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তা হচ্ছে সময়ের প্রয়োজনে দূততম সময়ে গৃহবন্দী মেয়েরা অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাবিত হচ্ছে। তাঁর ভাষায় “আজ সেই চাকা-পাল্কির যুগ বহুদূর চলে গেছে। মৃদুপথে যায় নি, দ্রুত পদেই গেছে। বাইরের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ পরিবর্তন আপনিই ঘটেছে। এ নিয়ে কাউকে সভা সমিতি করতে হয়নি।” রবীন্দ্রনাথ তাঁর পরিণত বয়সে এসে সমাজে নারীর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেছেন। মনে করেছেন সভ্যতা সৃষ্টির নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। কারণ এতোকালের অনুরক্ষণশীলতা তো সৃষ্টিশীলতারই বিরোধী। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে শান্তি নিকেতনে বসে নারী প্রবন্ধে (রচনাকাল, ১৯৩৬) তাঁর বক্তব্য-“আমার মনে হয় পৃথিবীতে নূতন যুগ এসেছে। অতি দীর্ঘকাল মানবসভ্যতার ব্যবস্থাভার ছিল পুরুষের হাতে। এই সত্যতার রাষ্ট্রতন্ত্র। অর্থনীতি, সমাজ শাসনতন্ত্র গড়েছিল পুরুষ। মেয়েরা তার পিছনে প্রকাশহীন অন্তরালে থেকে কেবল করেছিল ঘরের কাজ। এই সভ্যতা হয়েছিল এক ধোঁকা”। রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করতে পারলেন প্রকৃত সভ্যতার নতুন দ্বার খুলতে শুরু করেছ পৃথিবীর সর্বত্রই। এবং সে ধারা রবীন্দ্রযুগ পেরিয়ে আজো প্রবাহমান বিশ^জুড়ে। নারীর অগ্রযাত্রা ব্যতিরেখে রবীন্দ্রচিন্তায় বিশ^ অগ্রযাত্রা যে, অসম্ভব তা আজ শতত প্রতীয়মান।
রবীন্দ্রনাথ গ্রামপর্যায়ের উন্নতি ব্যতিরেখে নগরায়ণে বিশ^াসী ছিলেন না। শুধুমাত্র গুটিকতেক নাগরিক জীবনের আধুনিকায়নে পুরু ভারতবর্ষের চিত্র ওঠে আসে না। অর্থনৈতিকভাবে এক স্বনির্ভর পল্লী সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তার মধ্যদিয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনের কথা তাঁর চিন্তায় ছিল। গ্রামের সাধারণ কৃষক শ্রেণীরক কথা চিন্তা করে তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্থ পতিসরে সমবায় সমিতি ও গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তোলার কাজে লাগান। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বাঙালির উন্নতির পথে তাঁর মতে দু’টি বাধার মধ্যে একটি হচ্ছে, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। কারণ অর্থনৈতিকভাবে একজন মানুষ স্বচ্ছল না হলে তার থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার আসা করা যায় না। উন্নতির দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে জলবায়ু। তাঁর মতে-এদেশের জলবায়ু অতটা মন্দ না। কিন্তু উপযুক্ত পরিশ্রমের ফলে জলবায়ুর সারবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। কারণ এদেশের পল্লী অঞ্চলের শ্রমশীল কৃষকেরা মোটেও দুর্বল নহে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তারা জলবায়ুকে মানসম্পন্ন অবস্থায় নিয়ে আসতে পারে। জলবায়ু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ আগের চিন্তা-চেতনার সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে সে সব চিন্তা ধারাকে এখনো সময় উপযুগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
কবি রবীন্দ্রনাথ যেখানেই গেছেন, রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা কখনো তাঁকে ছাড়েনি। তিনি শুধু সৃষ্টি চেতনা নিয়ে মগ্ন ছিলেন না। দি বেঙ্গলী ও বন্দেমাতরম পত্রিকা দু’টির প্রতিবেদক থেকে প্রতিয়মান হয় তিনি ১৯০৭ সালেরর ১৭ জুন এক সফরে চট্টগ্রাম আসেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চট্টগ্রাম শাখা স্থাপনের ব্যাপারে বিশিষ্ট বক্তিদের সাথে আলোচনার জন্য। স্বদেশী সমাজের আহূত সভায় সভাপতিত্ব করে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে গিয়ে চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন -কেউ এই দেশকে স্বদেশ ভাবে না। কারণ কেউই কোন প্রকৃত কাজ করে না। সরকার তার কর্তব্য পালন না করতে পারে কিন্তু আমাদের কাজ আমাদেরকে করতে হবে। তিনি বলেন-তিনি কোন দলের নন। শিক্ষিত লোকেরা জনসাধারণের সঙ্গে মেশেন না। এই যোগাযোগের অভাবই সাম্প্রতিক হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের কারণ। (প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ চট্টগ্রাম এবং (১৯৯২) বইয়ের ইংরেজি উদ্ধৃতির তরজমা, সূত্র: রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম সফর, ভূঁইয়া ইকবাল, শিল্পশৈলী, মে-জুন ২০১৯)।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পরিণত বয়সে এসে শাসকদের মানবতা বিরোধীকর্মে সোচ্চার হয়ে ওঠেছেন। যদিও তিনি কোন রাজনৈতিক সহিংসতা ও গুপ্ত হত্যা কখনো সমর্তন করেন নি। তথাপি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার দখল, শাসক বাহিনীর সাথে ফতেয়াবাদের জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের অসম যুদ্ধ, অপর্ণা চরণ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার-এর ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ ও আত্মদান ইত্যাকার ঘটনাবলীতে বিপ্লবীদের রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রেরণা যুগিয়েছে। সূর্যসেন ও প্রীতিলতার আর এক সহযোদ্ধা কল্পনা দত্ত। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অগ্নিকন্যা সম্বোধন করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুণ্টন মামলার অন্যতম আসামি কল্পনা দত্ত ১৯৩৩ সালের ১৯মে চট্টগ্রামের পটিয়ার গৈরালাগ্রামে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে ধরা পড়ে। তাঁদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছে কলকাতার ছাত্র সমাজ। কল্পনা দত্তকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৬ সালের ২৫ জানুয়ারি পূর্ব বাংলা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে চিঠি লেখন। উল্লেখ্য, ঢাকার নবাব পরিবারের সাথে কবির একটা যোগসূত্র ছিল। রবীন্দ্রনাথকে ১৯১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ব্রিটিশ জমিদার ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় নোবেল বিজয়ের জন্য এক অভিনন্দন সভার আয়োজন করেন। আর খাজা নাজিমুদ্দীন ছিলেন নবাব সলিমুল্লার বোন নবাবজাদি বিলকিস বানুর বড় ছেলে। আর ঐ চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দিকের চেয়ে মানবিক দিকটিই চরমভাবে প্রকাশ পেয়েছিল-“আমি বহুদিন ধরে নারী রাজবন্দীদের নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত যারা এখনো জেলে রয়েছে। তাদের একজন শ্রীমতি কল্পনা দত্ত। —- যারা এখনো জেলে বন্দী। তাদের মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়, আমার বিশ^াস তাতে দু’টি উদ্দেশ্য সাধিত হবে। এতে বর্তমান বাংলা সরকারের মানবিক উদ্দেশ্য জনসাধারণের কাছে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে।——যে পরিবেশের কারণে তাদের আবেগের বিস্ফোরণ সন্ত্রাসের মাধ্যমে হয়েছিল, তার পরিবর্তন হয়েছে—-”(রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ, ভূঁইয়া ইকবাল)। অবশ্য পরে ছাত্র আন্দোলনের চাপে ১৯৩৯ সালের ১মে ব্রিটিশ সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দেয়। শাসক শ্রেণীর নির্যাতন ও দমন নীতিতে রবীন্দ্রনাথকে সোচ্চার দেখা যায় ‘হিজলী ও চট্টগ্রাম’ প্রবন্ধেও। হিজলী কারা রক্ষীরা দু’জন রাজবন্দীকে যখন গুলি করে হত্যা করে (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩১) সে সংবাদে পরিণত বয়সে রবীন্দ্র মনকে বিচলিত করে তুলে।
অসুস্থ শরীর ও মন নিয়ে তবু তিনি কলকাতার বৃহৎ প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়ে মনের ক্ষোভ এভাবে প্রকাশ করেন-“এই সভায় আমার আগমনের কারণ আর কিছুই নয়, আমি আমার স্বদেশবাসী হয়ে রাজপুরুষদের এই বলে সতর্ক করতে চাই যে, বিদেশীরা যত পরাক্রমশালী হোক না কেন আত্মসম্মান হারানো তার পক্ষে সকলের চেয়ে দুর্বলতার কারণ।——একথা ভুললে চলবে না যে, প্রজার অনুকূল বিচারও আন্তরিক সমর্থনের পরেই অবশেষে বিদেশী শাসনের স্থায়িত্ব নির্ভর করে।” (হিজলি ও চট্টগ্রাম, ১৯৩১)। এতে বুঝা যায় রবীন্দ্রনাথ শাসক শ্রেণীর মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রতি ছিল সর্বদা সোচ্চার ও সজাগ। তিনি শাসক শ্রেণীকে রক্তচক্ষু দেখাতেও ভয় করেন না।
জীবনের একেবারে প্রান্তবেলায় এসে রবীন্দ্রনাথ অনুধাবন করতে পারলেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মে শুধুমাত্র হিন্দু সমাজেই চিত্রায়িত হয়েছে। সমাজের আর এক পিট মুসলিম সমাজ চিত্র ওঠে আসেনি। এতে করে দুই সমাজের দূরত্ব বারবে বৈ কমবে না। সমাজচিন্তক রবীন্দ্রনাথ মানবতন্ত্রী ও লেখক আবুল ফজলের লেখা উপন্যাস ‘চৌচির’ এবং গল্প ‘মাটির পৃথিবী’ পাঠে মুগ্ধ হয়ে আবুল ফজলের কাছে দীর্ঘ এক চিঠিতে এভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন-“…আপনার চৌচির গল্পটি আমার দৃষ্টিকে ক্লিস্ট করেও পড়েছি। আমার পক্ষে এ গল্প বিশেষ উৎসক্যজনক। আধুনিক মুসলমান সমাজের সমস্যা ঐ সমাজের অন্তরের দিক থেকে জানতে হলে সাহিত্যের পথ দিয়েই জানতে হবে। এর প্রয়োজন আমি বিশেষ করে অনুভব করি। আপনাদের মত লেখকের হাত থেকে এই অভাব যথেষ্টভাবে পূর্ণ হতে থাকবে এই আশা করে রইলুম। চাঁদের এক পৃষ্ঠায় আলো পড়ে না। যে আমাদের অগোচর। তেমনি দুদৈবক্রমে বাংলাদেশের আধখানা সাহিত্যের আলো যদি না পড়ে তাহলে আমরা বাংলাদেশকে চিনতে পারবো না। না পরলে তার সঙ্গে ব্যবহারের ভুল ঘটতে থাকবে। কিন্তু এই পরিচয় স্থাপন ব্যাপারে কোন একটি জিদ বশত ভাষার প্রতি যদি নির্মমতা করেন তাহলে উল্টো ফল হবে——”। (আবুল ফজল ১৩৮২, পৃ.১৩৮)।
রবীন্দ্রনাথকে আবুল ফজলের লেখা ৩১.০৮.১৯৪০ সালে লিখিত চিঠির প্রতি উত্তরে রবীন্দ্রনাথ এই দীর্ঘ চিঠিটি আবুল ফজলকে লেখেন ০৬.০৯.১৯৪০ সালে। তখন অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের চোখের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। তথাপি সমাজের প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা তা তিনি এ রাতে পারেন না বলে আবুল ফজলের লেখাসমূহ অনেক কষ্টে পাঠ করেও অনুসূচনা এবং উপদেশমূলক এই পত্রটি মুক্তিবুদ্ধির মানুষ আবুল ফজলকে লিখে পাঠান।
রবীন্দ্রনাথের বিশাল সৃষ্টিশীল শিল্পকর্ম-কবিতা, সংগীত, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, চিত্রকলার মধ্যে যখন আমরা অবগাহন করি হয়তো তখন আমাদের মনে হয় ভাবুক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির নানা সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে নব নব সৃষ্টিতে মত্ত্ব। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্মের অপর পিঠ মননশীল সাহিত্যের বিশাল প্রবন্ধ সম্ভারের ভেতর যখন অনুপ্রবেশ করি, তখন ভাবুক, সৌন্দর্যপ্রেমী রবীন্দ্রনাথ নয়, পাঠকের সামনে ধরা দেয় সমাজের এক দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সচেতন ভারতবর্ষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের এক ত্রিকালদ্রষ্টা দার্শনিক ও চিন্তক রবীন্দ্রনাথকে। বিশেষ করে তাঁর পরিণত বয়সের প্রবন্ধাবলী পাঠে পাঠকসমাজকে চমকে দেয় তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তার দায়বদ্ধতা অনুধাবন করতে পেরে। তাঁর এসব রচনাবলীর বক্তব্য স্বদেশ ও সমকালীনতাকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে বিশ^জনীন ও সর্বকালীন। অতপর, শতাব্দীপর এসেও রবীন্দ্রনাথের মননশীল প্রবন্ধাবলী আমাদের বর্তমান প্রজন্মের পুনঃপুন পাঠকরা অপরিহার্য।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট