চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহাশ্বেতা

সন্ধ্যার সূর্য

একরাম আলি

২ আগস্ট, ২০১৯ | ১:৪২ পূর্বাহ্ণ

মহাশ্বেতা দেবী নেই (১৯২৬-২০১৬)। জীবিত মহাশ্বেতার সান্নিধ্য পাওয়ার উপায়ও আর নেই। অবশ্য বেঁচে থাকতে তাঁর নৈকট্য যে তেমন পেয়েছি, বলা যাবে না। বছর বারো আগে পারিবারিক এক সংকটে ভুগছি (লজ্জার কথা যে, প্রায়ই এমন দুর্ভোগ আমার চলে), বন্ধু অম্লান দত্ত জানালেন, মহাশ্বেতাদির বাড়ি যেতে হবে। কেন? কোথায় সেটা? তাছাড়া, তিনি তো আমাকে চেনেনও না।
গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটটি বেশ ছোট। বইপত্র আরো সংকুচিত করেছে চারপাশকে। কিন্তু তিনি যখন একান্ত আপনজনের মতো খুঁটিয়ে জানতে চাইছিলেন আমার বিপদের কথা এবং কী ভাবে এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠা যায় তার উপায় খুঁজছিলেন, তখন তাঁর ছোট্ট ফ্ল্যাটটিকে মনে হচ্ছিল দূর বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত প্রসারিত। তারপর আর একবারই গিয়েছি সেখানে। সে-ও অম্লান দত্তেরই সঙ্গে। আর ফোনে কথা। সে-সব কথা নিতান্ত দরকারের। ছোট-ছোট।
আর ছিল তাঁর লেখা। গল্প, উপন্যাস। যা আজও রয়ে গেছে।
সেই সত্তরের দশকে ‘এক্ষণ’-এ তাঁর ‘স্তনদায়িনী’ ইত্যাদি গল্পগুলি যখন বেরোচ্ছিল, তখন তাঁর মধ্যবয়স। তখন থেকেই বাঙালি পাঠকসমাজে তাঁকে নিয়ে হইচইয়ের শুরু। বলতেই হবে, তার আগের পর্বের লেখাগুলো ছিল কিছুটা উপেক্ষিত যেন-বা। সে-সময় কোনো এক সমাগমে শঙ্খ ঘোষ (তাঁরই মুখে শোনা) সেইসব গল্পপাঠের মুগ্ধতার কথা বলায় মহাশ্বেতা দেবীর সোজাসাপটা উত্তর ছিল, আমি তো বরাবর এইরকমই লিখি। আপনারাই পড়েননি।
হ্যাঁ। তিনি ছিলেন স্পষ্টবক্তা। বরং বলা ভালো– ঠোঁটকাটা। তিনি ছিলেন সমাজকর্মী। পুরুলিয়ার অচ্ছুৎ শবরদের মা-বাবা যেমন, তেমনই মা বহু নকশাল-কর্মীর। এখন কেউ-কেউ তাঁকে বলছেন– হাজার চুরাশির মা।
মহাশ্বেতা দেবী নানা কারণে বিতর্কিতও। রাজনৈতিক মতপ্রকাশে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছেন। কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে তাঁর লেখকসত্তার উজ্জ্বল উত্তরীয়টি আমৃত্যু উড্ডীন থেকেছে। তুমুল কলকাতায় বসবাস করেও তিনি চেয়েছিলেন ‘অরণ্যের অধিকার’। খ্যাতিও পেয়েছিলেন। ভারতের সেরা সব পুরস্কারে সম্মানিত। পেয়েছেন ম্যাগসাইসাই।
এত খ্যাতি পেয়েছেন, যা সর্বভারতীয়, যে, তাঁর প্রতি ভারতবাসীর দায়িত্ব-কর্তব্য যেন শেষ। পাঠক হিসেবে আমাদের আর কোনো দায় নেই তাঁর লেখা পড়বার। তবু কেন পড়ব?
বাংলার সেরা রূপকথা-গ্রন্থটির একেবারে শেষে এসে শেষতম প্রশ্নটি ছিল, ‘কেন রে সাপ খাস’
জিজ্ঞাসাচিহ্নহীন প্রশ্নটির উত্তরে, সম্ভবত খেতে খেতেই, সাপ বলেছিল, ‘খাবার ধন খাব নি? গুড় গুড়ুতে যা’ব নি?’
আজ মৃত্যুর পরে তাঁর গল্পগুলো পড়তে পড়তে আমারও উত্তর তদ্রƒপ। অর্থাৎ, খ্যাতির বিভা (যদি থেকে থাকে) কোনো অতিরিক্ত আলো দিতে পারে না, খ্যাতির ক্লেদও (যদি থাকে) কোনো লেখাকে কলঙ্কিত করতে পারে না। লেখা, যা আগে থেকে তৈরি হয়ে আছে, তার নানান গুপ্ত কুলুঙ্গিকে আবিষ্কার করতে পারে শুধু নতুন নতুন পাঠক।
১৯৬২-৬৪ সালে একটা গল্প লিখেছিলেন মহাশ্বেতা। ‘দেওয়ানা খইমালা ও ঠাকুরবটের কাহিনী’। আজ থেকে প্রায় অর্ধশতক আগের লেখা গল্পটির পটভূমি অষ্টাদশ শতকের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। ফের পড়তে গিয়ে দেখছি, দ্রুতগতির কাহিনি-বিন্যাসে, আখ্যানের প্রতি ভাষার বিস্ময়কর বিশ্বস্ততায় গল্পটি আবার আছড়ে পড়ল একেবারে আমাদের সামনে। এবং, সময় পেরিয়ে চলে যেতে চাইছে আরো সামনের দিকে, গল্পের দুই চরিত্র গোলক আর খইমালা যেদিকে ভেসে গিয়েছিল।
বর্ণাঢ্য কাহিনী। গতির জন্য বর্ণ আরো বেড়ে যায়। সে-বর্ণ কেমন? তিনি নেই। তাঁর রচনাকর্ম রয়ে গেছে। সেখান থেকে একটু উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
‘সময় নেই, সময় কোথায়? এতক্ষণ মেঘে মেঘে বেলা চলে গিয়েছে। সূর্যের দাঁড়াবার সময় নেই, এখন সূর্য পশ্চিমে। সহসা মেঘ ভেঙে আকাশের কোণে কোণে গলগল করে লাল আলো উছলে পড়ল। সন্ধ্যার সূর্যের দৃষ্টি ঘোলাটে, দেখলে ভয় হয়। মতি শেখের ঘোড়া গাড়িসুদ্ধ খানায় পড়ে জখম হলে, আর বাঁচবে না জেনে, মুচিরা এসে জীয়ন্তে চামড়া টানবে জেনে, ‘ওরে, এমন নিদয় কাজ করতে আমার কলজা ফাট্টে যায়’ বলে কাঁদতে কাঁদতে মতি শেখ সে ঘোড়াকে জবাই করেছিল। মানুষ সেজন্য তাঁকে আজও নির্দয় বলে, কিন্তু পোষা জীবের অমন কষ্ট কে দেখতে পারে? ঘোড়ার চোখের দৃষ্টি নিমেষে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, গলার সফেন রক্ত অমনি গলগলিয়ে চতুর্দিকে বয়ে গিয়েছিল।’
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হল। আসলে নিম্নবর্গের গল্পটি পাঠকের সামনে তার জল-কাদা-বৃক্ষরাজি-মানুষ-প্রাণীকুল-কল্পনা-মায়া-রিরংসা সমেত উপস্থিত করতে পারলে তৃপ্তি হত। সেই অতৃপ্তি থেকেই মনে পড়ছে মার্কেজের সরলা এরেন্দিরার কথা। দেশ- জাতি-ধর্ম-ইতিহাস এবং তার মৃত্তিকাসঞ্জাত গাছপালা আর সমাজবিন্যাস, অর্থনীতি আর নদীগ্রোত, কলাঝোপ আর সূর্যাস্ত-সহ ‘সরলা এরেন্দিরা’ যেভাবে নির্মিত হয়েছিল দূর লাতিন আমেরিকায়, প্রায় সমকালেই (আঙুল গুনে বললে, বছর দশেক আগেই) মহাশ্বেতা দেবীর ‘দেওয়ানা খইমালা’-র নির্মাণে তার সঙ্গে একটা পদ্ধতিগত যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
এ এক আশ্চর্য যোগাযোগ! কুড়ি শতকের মাঝামাঝি নিরাসক্ত, আত্মসর্বস্ব, বিচ্ছিন্ন এবং বহিরাগত (যেন এলিয়েন! এই ধারণাটির জন্ম এমন এক আত্মগর্ব থেকে, যা দীর্ঘদিন কালো আর বাদামিদের শোষণ করার পর সাধারণের স্তরে নেমে আসার সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত।) তৎকালীন ইউরোপের একক জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে পরাজয়জনিত যে-বমি বমি ভাব, সে-সবের থেকে দূরে নিজের দেশ আর সেই দেশের ভাষা ও তার ভবিষ্যতকে আবিষ্কারের চেষ্টাই সম্ভবত নৈকট্য এনে দিয়েছে ‘দেওয়ানা খইমালা’ আর ‘সরলা এরেন্দিরা’-র মধ্যে।
আজ তাঁর প্রয়াণের পর প্রতিবাদ করতেই হয় তাঁদের, যারা মনে করেন, আঞ্চলিক ভাষায় সংলাপ লেখার চেষ্টা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। কী অসম্ভব বিশ্বস্ততায় মহাশ্বেতা সংলাপে আর দু-এক লাইনের বর্ণনায় জীবন্ত করেছেন চরিত্রগুলোকে, ভাবা যায় না ! বিস্মৃত, অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়তে পড়তে যে-সব শব্দ পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীরও নিভৃত সংলাপে আশ্র্র্র্রয় পেয়েছে, সেইসব শব্দ তাঁর গল্প আর চরিত্রগুলোকে নির্মান করেছে।
আর চরিত্রগুলি? তারা কোমল, তারা রুক্ষ, ধূলিমলিন। তাদের শৌর্যে আকাশের পর্দা ফেটে যায়। তাদের বঞ্চনায় শানের ওপর অবিরাম খোলামকুচি ঘষার কর্কশ আওয়াজ।
এইসব চরিত্র পাঠকের মধ্যবিত্ত আপাত-নিশ্চয়তার জগতে বেমানান। ফলে, অবাস্তব। আর, এইখানেই এদের জোর। এই স্বভূমিতেই এদের বাস্তবতা।
সরকারি গান-স্যালুটে শেষ বিদায় জানানো হল মহাশ্বেতা দেবীকে। তবু এই বাক্যটি অসার হওয়ার নয় যে, তিনি সেই বিরল লেখকদের একজন, যিনি নিপীড়িতজনের বাস্তবতাকে দেখতে পেয়েছিলেন আর মধ্যবিত্তদের চোখে যতই অলীক মনে হোক, সাহিত্যে সেই বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেলেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট