চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

চোখে ভাসে সেই গায়েনের ছবি

ওমর কায়সার

১৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

বিনয়বাঁশী তাঁর যাদুকরী হাতের ছোঁয়ায় ঢোল বাজাচ্ছেন। তার সঙ্গে উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইছেন এক উচ্ছল অথচ কোমল তরুণ ওরে… হল্লা দেশের রাজা… তুই মানুষ মেরে করবি কী তা বল… তুই করিস তম্বি তম্বা তোর/ মন্ত্রী বেটা কিসে কম বা।
বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুন দিন’ এর দৃশ্য এটি। সে বড় দুঃসময়ের দিন এদেশের। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। স্বাধীনতার মাত্র চার বছর পরেই ইতিহাসের রথের চাকা উল্টো ঘুরতে শুরু করেছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর, স্বাধীনতার সকল অর্জন আর গণতন্ত্র তখন সামরিক শাসকের বুটের তলায়। বাংলাদেশের সংস্কৃতির কথা বলা, বাঙালির ঐতিহ্যের কথা বলা, বঙ্গবন্ধুর নাম ধরা তখন বড় অপরাধ।
সেই সময়ে পথের ওপর দেখা গেল এক গায়েনকে। তার সঙ্গে আছেন এক ঢুলি। তখনও তিনি দেশখ্যাত একুশে পদক প্রাপ্ত বিনয়বাঁশী হয়ে ওঠেননি। বোয়ালখালী থানার এক জেলে পল্লী থেকে তাঁকে ঢোল বাজানোর জন্য নিয়ে এসেছেন শহরের নাট্যকর্মীরা। উদ্দেশ্য একটাই। এই দুঃশাসনকে দূর করতে হবে। মানুষকে জাগাতে হবে। যে ভাবে হোক মানুষকে স্বাধীনতার মূল মর্মবাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। নাট্যকার মিলন চৌধুরী রচিত নাটকটি সেই সময় চট্টগ্রামের পথে পথে অভিনীত হয়েছিল। বিনয় বাঁশীর সঙ্গে সেই নাটকে গায়েনের ভূমিকায় অভিনয় করে গান গেয়ে মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন যে তরুণ তিনি শান্তনু বিশ্বাস। গায়েনের ভূমিকায় অভিনয় সুতরাং তাকে তো গান গাইতে হবেই। এটি এমন একটি চরিত্র যার জন্য অভিনয়ের পাশাপাশি গানও রপ্ত থাকতে হবে। এমন দ্বৈত বিরল গুনের মানুষ শান্তনু ছাড়া আর কে হতে পারেন। গান তার রক্তে, অভিনয় তার মেধায়, লেখালেখি তার সৃষ্টিশীলতায়।
এই স্বল্প জীবনটাতে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেলেন বহুমুখী সৃজনশীলতায় মগ্ন থেকে, সদা প্রাণোচ্ছল, হাস্যেজ্জ্বল থেকে কীভাবে একটি কর্মমুখর জীবন পার করিয়ে দেওয়া যায়। নাটকের মানুষ, গানের মানুষ শান্তনু বিশ্বাস আসলে শিল্পের মানুষ। তিনি জাত শিল্পী। যখন নাটকের কাজ করছেন তখন নাটকের অ থেকে চন্দ্রবিন্দু সব করছেন। নাটক রচনা করছেন, নাটকের দল করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন, অভিনয় করছেন। যেন তিনি একটা মানুষ, অনেকগুলো শিল্পের হাত নিয়ে জন্মেছেন। আবার যখন গান করছেন তখন গান লিখছেন, তাতে সুর দিচ্ছেন আর তা গাইছেনও।
শান্তনুর গানগুলো আসলে কবিতাই। তিনি আসলে কবিতাই রচনা করতেন। বাংলা গানের দৈন্যদশার কালে এরকম একজন শান্তনু বিশ্বাসের আরও কিছুকাল বেঁচে থাকার দরকার ছিল। কিন্তু সেটি আর হলো না।
গত ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সারাদিনে নিজের কর্মক্ষেত্র ইস্পাহানি গ্রুপের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। চায়ের নিলামে অংশ নেওয়া, দাপ্তরিক সভা, ইত্যাকার নানা কর্মে ব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন। সেদিন রাতে তিনি অসুস্থ বোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরের দিন শুক্রবার তিনি সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন বহুদূরে। আর ফিরবেন না। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লাগছে যারা তাকে চেনেন তাদের কাছে। কারণ তিনি সবসময় সুস্থ, সদা সক্রিয়, সৃজনশীল একটা মানুষ।একরম একটা প্রাণবন্ত মানুষ হঠাৎ এমন উধাও হয়ে গিয়ে সৃজনশীল সংস্কৃতি জগত হাহাকার করা একটা শূন্যতা তৈরি করে যাবেন কেউ ভাবেনি। কারণ মাত্র এক সপ্তাহ আগে তার নিজের নাটকে দল কালপুরুষ এর তিন দিনব্যাপী নাট্য উৎসব শেষ করছেন। উৎসবে তার নতুন লেখা নাটক নির্ভার এর প্রদর্শনী হয়। তাতে তিনি অভিনয় করেছেন। তারও কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আলোকিত মানুষ অনুষ্ঠানের জন্য তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাতে উঠে এসেছে জীবনের নানা দিক। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন। নাটকের দল অঙ্গন ও গণায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অভিনয় করে সবার দৃষ্টি কেড়েছিলেন। তাঁর লেখা প্রথম নাটকের নাম কালো গোলাপের দেশ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা তাঁর নাটক ‘ইনফরমার’ ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়। তাঁর লেখা অন্য নাটক নবজন্ম, দপ্তরী রাজ দপ্তরে, ভবঘুরে। মৌলিক নাটকের পাশাপাশি তিনি অনেক নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তরও করেছেন। নির্দেশনা দিয়েছেন জুলিয়াস সিজারেরর শেষ সাত দিন, মানুষ ও নিয়তি মৃণালের চিঠির মতো দর্শকনন্দিত নাটকগুলো।
সেদিনের সেই সাক্ষাৎকারে তার গানের জগতের কথাও তিনি মেলে ধরেছিলেন। খড়িমাটি প্রকাশনা থেকে তার গানের বই গানের কবিতা খোলাপিঠ বের হয়। ২০০৭ সালে তাঁর কথা ও সুরে এটিএন মিউজিক থেকে একটি সংকলন বের হয়। এটিতে কণ্ঠ দেন শিল্পী সুবীর নন্দী ও কলকাতার ইন্দ্রাণী সেন। ২০০৮ সালে ইমপ্রেস অডিও ভিশন থেকে শান্তনুর লেখা সুরে শিল্পী অরুণিমা ইসলাম ও নিজের গাওয়া যৌথ সংকলন বের হয়। ২০০৯ সালে জি সিরিজের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান অগ্নিবীণা বের করে শান্তনু ও শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের যৌথ অ্যালবাম। ২০১২ সালে বের হয় একক সংকলন ‘পোস্টম্যান’ ও ২০১৪ তে ‘খড়কুটো’। সেই সাক্ষাৎকার শেষে তিনি আমাকে বলেছিলেন, কায়সার তুমি আমার জীবনের কত পুরোনো প্রসঙ্গ টেনে এনেছ, কত বিষয় তুলে ধরেছ, তুমি কী আামার ওপরে গবেষণা করেছ নাকি। আমি মনে মনে হাসলাম। বললাম, শামু দা, শৈশব থেকেই তো আপনার সঙ্গে আছি। আপনার অভিনয় দেখতে দেখতে, গান শুনতে শুনতে, কথায় মুগ্ধ হতে হতে আমাদের দিনগুলো পেরিয়ে গেল। আপনার নাম মনে এলেই আমাদের ভেতরে একধরনের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে। আপনার আশ্রয় আর আপনার জীবন সঙ্গীনি শিল্পী শুভ্রা বিশ্বাসের প্রশ্রয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। সেই আশির দশকে আপনার সারসন রোডের বাসায় আমাদের তুমুল দিনগুলোতে আপনি ছিলেন আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। আপনার সম্পর্কে কিছু বলতে হলে আমাকে গবেষণা করতে হবে কেন?
শান্তনু বিশ্বাসের আরেকটি মহান পরিচয় আছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধে তিনি হারিয়েছেন তার অগ্রজ অতনু বিশ্বাসকে।
বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করতে কালপুরুষ নাট্যদল প্রতিষ্ঠা, নাটক লেখা, নির্দেশনা দেওয়া ও অভিনয় করার পাশাপাশি নিজে প্রসেনিয়াম নামে একটা নাটকের পত্রিকাও তিনি বের করেন। গুণবিচারী পাঠকের কাছে, নাটকের মানুষের কাছে এই পত্রিকা খুবই সমাদৃত ছিল।
প্রকৃতি অঝোর ধারায় কাঁদছে আষাঢ়ের বর্ষণের দিনে। সঙ্গে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা। তাদের চিরচেনা সেই হাসি হাসি মুখের কর্মমুখর মানুষটি আর নেই। এই বর্ষণের দিনে মেঘের ওপার থেকে তার গানগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে আসছে। চোখে ভাসে সেই গায়েনের ছবি। ’৭৬ এর সেই দমবন্ধ করা দিনগুলোতে যিনি মুক্তির গান করে মানুষে রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট