চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

দুই বন্ধু ও ভালো মানুষ

আখতারুল ইসলাম

১৯ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

অনেকদিন আগের কথা, এক গ্রামে ছিল একজন ভালো মানুষ। সবাই তাকে ভালো মানুষ বলে ডাকত। এইজন্য যে, তিনি সবার উপকার করত। কারো ক্ষতি করত না, কেউ বিপদে পড়ে তার কাছে সাহায্যের জন্য এলে তাকে টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ দিয়ে সহযোগিতা করত, কিন্তু বিনিময় কিছু চাইত না। অনেকে টাকা ধার নিত দিতে পারলে দিত, না পারলে দিত না। গ্রামে কোন ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি হলে, সে লোকটি সুন্দরভাবে সেটা মীমাংসা করত। উভয়পক্ষ খুশি হত। দশ গ্রামে তার নাম খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তার কাছ থেকে বিভিন্ন পরামর্শ নিতে আসত।
কিন্তু ভালো মানুষটার একটা মাত্র ছেলে। ছেলেটা সবসময় মন খারাপ করে থাকত। কারণ তার কোন খেলার বন্ধু ছিল না।
একদিন দু’জন বন্ধু আসে ভালো মানুষটার কাছে। তাদের মধ্যে একটা বিষয়ের মীমাংসা হচ্ছে না, প্রথম বন্ধু বলল, ভালো মানুষ দেখুন আমি আমার বন্ধুকে বেশি ভালোবাসি।
দ্বিতীয় বন্ধু বলল, না আমি ওকে বেশি ভালোবাসি, অর্থাৎ কে কাকে বেশি পছন্দ করে তা পরিমাপ করতে ভালো মানুষের কাছে আসা। ভালো মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পারে। ভালো মানুষ বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখি সত্যি কে কাকে বেশি ভালোবাসে।
ভালো মানুষ বলল, দেখ্ আমার একমাত্র ছেলে রোহান, ওর কয়দিন থেকে মন খারাপ। ওর মন খারাপ কেন আমি জানি, ওর একটা খেলার সাথি চাই। ওর যেহেতু কোন ভাই-বোন নেই, তাই সে খেলতে পারে না। যে আগে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী খেলার সাথি আনতে পারবে, তখন আমি বুঝতে পারবো। সে সত্যি অপর বন্ধুকে বেশি ভালবাসে।
: দুই বন্ধু একথা শুনে বলল, এ আর এমন কি কাজ!
: ছেলে রোহান বলল, আমার হীরের চোখওয়ালা সোনার পুতুল চাই, যাকে নিয়ে আমি খেলব।
দু’বন্ধু চলল সোনার পুতুলের খোঁজে, হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে আসে। ক্লান্ত হয়ে বসে একটা বড় বটগাছের নিচে, হঠাৎ দেখল এক বৃদ্ধ লোক লাঠি ভর দিয়ে আসছে। দুই বন্ধু বলল, আচ্ছা এই বৃদ্ধ লোকটাকে জিজ্ঞাসা করি।
বৃদ্ধ লোকটি কাছে এসে বলল, কি হয়েছে তোমাদের? এমন বিমর্ষ হয়ে বসে আছ কেন?
দুই বন্ধু ব্যাপারটা খুলে বলল। বৃদ্ধ বলল এই কথা, শোন আমার কাছে একটা পুতুল আছে, সেটা সোনার পুতুল, হীরের চোখও ছিল, আমার পেছনে একটা ঘন জঙলের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে প্রচ- একটা ঝড় আসে। সেই ঝড়ে আমার থলে ওড়ে যায়। থলের সব জিনিসপত্র হারিয়ে যায়। থলেতে ছিল পুতুলটাও। পুতুলটা পেলেও পায় নি তার দু’টো হীরের চোখ। তোমরা যে আগে চোখ দুটো খুঁজে আনতে পার, তবে সে এই পুতুল পাবে। আমি এখানে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। এ কথার পর দু’বন্ধু হাঁটতে শুরু করে হীরের চোখের খোঁজে, কিছু দূর গেলে দেখতে পায় একটা গভীর বন। ওরাতো খুশি।
খুঁজতে শুরু করে হীরের চোখ, তন্ন তন্ন করে খোঁজে বনের বিভিন্ন ঝোপে ঝাড়ে, গাছের গোড়ায়। কিন্তু পায় না কোথাও, হঠাৎ দ্বিতীয় বন্ধু দেখল, একটা সাপ দুটি হীরের মনিকে ঘিরে রেখেছে, প্রথম বন্ধুকে বলল, ঐ দেখ্।
দেখলেও দুই বন্ধু কিভাবে নেবে ভাবছে। নিতে গেলে জীবন নাশের সম্ভাবনা আছে। প্রথম বন্ধু বলে, আমি নিই, মরে গেলে অন্তত বলতে পারবি, তোর বন্ধুত্বের দাম দিতে গিয়ে মরেছি।
দ্বিতীয় বন্ধু বলল, না আমি নেব, আমি মরে গেলে বলতে পারবি তোর ভালোবাসার জন্য মরে গেছি। যেই প্রথম বন্ধু ধরতে যাবে সেই দ্বিতীয় বন্ধু বলে, না বন্ধু! আবার দ্বিতীয় বন্ধু নিতে গেলে প্রথম বন্ধু বলে, না বন্ধু! এভাবে অনেকক্ষণ চলে। সাপটি চুপটি মেরে দেখছে দুই বন্ধুর কথা ও কাজ।
প্রথম বন্ধু বলল, দু’জনে এক সাথে নেব, সবাই বলবে বন্ধুত্বের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে দুই বন্ধুর মৃত্যু! সাপ ভাবছে এমন কা- তো জীবনেও দেখিনি, ওরা তো সত্যি একে অপরকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সাপটি আস্তে আস্তে সরে যায়।
প্রথম বন্ধু বলল, দেখ্ সাপটি আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরেছে, দ্বিতীয় বন্ধু বলল, সত্যিই তো! সাপটি সরে যাওয়া মাত্র দু’বন্ধু দু’টি হীরের চোখ নিল।
মহাখুশিতে দুজন আসছে, হঠাৎ দ্বিতীয় বন্ধু বলল, কিরে আমরা তো দুজনে দুটি চোখ নিলাম, তাহলে পুতুলটি কার! প্রথম বন্ধু বলল, তাই তো, আচ্ছা ধর আমার চোখটা তোকে দিলাম, তুই জিতে যা, দ্বিতীয় বন্ধু বলল না, আমার চোখটা তুই নে তুই জিতে যা। এভাবে কথায় কথায় বৃদ্ধ মানুষটির কাছে এলো দেখে বৃদ্ধ ঘুমাচ্ছে। বৃদ্ধ লোকটির ঘুম না ভাঙ্গিয়ে ওরা বৃদ্ধের জেগে ওঠার অপেক্ষা করতে লাগলো। অনেকক্ষণ পর বৃদ্ধ লোকটি জেগে ওঠে দেখল দুই বন্ধুর হাতে দুই হীরের চোখ।
প্রথম ও দ্বিতীয় বন্ধু সমস্বরে বলল, আমি…
বৃদ্ধ বলল, থাম। আমি সব বুঝতে পেরেছি। চল আমার সাথে, তারা তিনজনে এসে উপস্থিত হল গ্রামের সেই ভালো মানুষটির কাছে আস্তে আস্তে বৃদ্ধ চোখ দুটি পুতুলের চোখে লাগিয়ে দেয়। বৃদ্ধ ভালো মানুষটিকে দুই বন্ধুর সব কিছু খুলে বলে, ভালো মানুষ বলল, তোমরাই একে অপরের সত্যিকারের বন্ধু। দু’জন দুজনকে সত্যিকারের ভালোবাস। কেউ কম বা বেশি না।
দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
ভালো মানুষ, বৃদ্ধকে বলল, আমি আপনার সোনার পুতুলটা কিনে নিতে চাই, আমার একমাত্র ছেলে হীরের চোখওয়ালা সোনার পুতুলকে খেলার সাথী করার জন্য মন মরা হয়ে বসে থাকে।
বৃদ্ধ বলল, দেখুন ভালো মানুষ, আপনার কথা আপনার সততা, ন্যায়বিচার, মানুষের জন্য উপকারের কথা শুনে আমি অনেক দূর থেকে এসেছি শুধু আপনাকে এক নজর দেখবো বলে। কিন্তু পথে ঘূর্ণিঝড়ে সব শেষ করে দেয়। আমার ইচ্ছা ছিল দেখতে যখন যাবো আমার শেষ সম্ভব এই সোনার পুতুল আপনাকে দেব। কিন্তু পথে ঘূর্ণিঝড়ে চোখ দুটি হারিয়ে গেলে নিজেকে খুব অসহায় মনে হল, এই দুই বন্ধু চোখ দু’টি খুঁজে আনে। তাতে ওদের বন্ধুত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়, আমার আশাও পুরণ হল। এই নিন হীরের চোখওয়ালা সোনার পুতুল। ভালো মানুষ ও তার ছেলে খুশি হয়ে বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানায়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট