চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা

প্রতিবন্ধী শিশুদের ৬৫% বিদ্যালয়ে যায় না

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৬ আগস্ট, ২০১৯ | ২:৪৭ অপরাহ্ণ

প্রাথমিক শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ, কমছে ঝরে পড়ার হারও। তবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এ সাফল্য থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরা। গবেষণার তথ্য বলছে, বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিবন্ধী শিশুদের ৬৫ শতাংশই বিদ্যালয়ে যায় না। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৭৫ শতাংশই এখনো শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালিত বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় প্রতিবন্ধী ও শারীরিক ত্রুটিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯৬ হাজার ৩৮৫ জন। এর মধ্যে শারীরিক ত্রুটিযুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ২৯ হাজার ৫৫। বুদ্ধি ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছে ২৩ হাজার ৭৩৯ জন। এছাড়া দুর্বল দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তিযুক্ত এবং অটিজম ও অন্যান্য সমস্যায় ভোগা শিক্ষার্থীদেরও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে কুড়িগ্রামের বেশ কয়েকটি হতদরিদ্র পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল-হিউম্যানিটি এন্ড ইনক্লুসন (এইচআই) বাংলাদেশ প্রোগ্রাম। এ প্রকল্পের প্রভাব নির্ণয়ের লক্ষ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রাথমিক পর্যায়ের একটি বেজলাইন সার্ভে পরিচালনা করা হয়। গবেষণাটি পরিচালনা করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি)। গবেষক দলের নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ‘র‌্যানডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল অন দ্য ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুসিভ পভার্টি গ্র্যাজুয়েশন মডেল বেজলাইন রিপোর্ট’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুড়িগ্রাম জেলার দুটি উপজেলায় প্রতিবন্ধী রয়েছে এমন ৬৮৬টি হতদরিদ্র পরিবারে জরিপ চালিয়ে এসব পরিবারের প্রতিবন্ধী ও অন্য সদস্যদের শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও আয়বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, এসব পরিবারের ছয় থেকে ১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই স্কুলে যাচ্ছে না। এছাড়া এসব পরিবারের মোট প্রতিবন্ধীর ৭৫ শতাংশ কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি। আর শিক্ষার আওতায় আসা ৩৫ শতাংশ প্রতিবন্ধীর ১৫ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা আবার স্বাক্ষর জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ। জরিপে অংশ নেয়া বেশির ভাগ বয়স্ক প্রতিবন্ধীই বলেছেন, তারা কখনো বিদ্যালয়ে যাননি। আর বিদ্যালয়ে যাওয়াদের সর্বোচ্চ গণ্ডি প্রাথমিকেই সীমাবদ্ধ।

কয়েক বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও সুযোগ-সুবিধার অভাব থাকায় সে লক্ষ্য অর্জন থেকে অনেক দূরে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে গত কয়েক বছরে। গবেষণায় যে তথ্য এসেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, এখনো এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই যত দ্রুত সম্ভব এসব শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এসব শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনতে পারলে পরবর্তী সময়ে তারা দেশের বোঝা না হয়ে সম্পদে রূপ নেবে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় হতদরিদ্র পরিবার বিষয়ে যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেটিও অর্জন হবে।

গষেণার অংশ হিসেবে স্কুলে পাঠানোর ক্ষেত্রে কী ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা হয় ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে (এফজিডি)। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচজন প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকের সঙ্গে হওয়া এক আলোচনায় তিনজন অভিভাবক জানান, তাদের সন্তান স্কুল ও মাদ্রাসায় যায়। শ্রেণীকক্ষে সহপাঠীরা তাদের নিয়ে হাসি-তামাশা করে। বিভিন্ন অকথ্য ভাষায় সম্বোধন করে। এছাড়া অন্য শিশুরা তাদের সন্তানের সঙ্গে মিশতে চায় না।

প্রতিবন্ধী রয়েছে এমন হতদরিদ্র পরিবারের অন্য সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যও সংগ্রহ করে গবেষক দল। সেখানে দেখা যায়, এসব পরিবারে সাত বছরের বেশি বয়স এমন সদস্যদের ৩৫ শতাংশই কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করেনি। শুধু স্বাক্ষর জ্ঞান রয়েছে ২০ দশমিক ৮ শতাংশের। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। প্রাথমিক সম্পন্ন করেছে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। শিক্ষাগত যোগ্যতা ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর মধ্যে রয়েছে ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশের। আর মাধ্যমিক পেরোতে পারছে মাত্র ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ হতদরিদ্র পরিবার থেকে ৬৫ শতাংশ পড়তে এলেও এর প্রায় ৯৬ শতাংশ মাধ্যমিক শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে।

খাদ্য নিরাপত্তায়ও বেশ পিছিয়ে রয়েছে প্রতিবন্ধীদের এসব পরিবার। গবেষণা প্রতিবদন অনুযায়ী, প্রায় ৭০ শতাংশ তিনবেলা খেতে পারে না। কার্তিক মাসে এ সংকট প্রকট হয়। মূলত আয় না থাকার ফলেই তারা খাদ্য সংকটে রয়েছে। এছাড়া বন্যা ও শীতকালের ঠাণ্ডাকে কাজ ও খাবার সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

হ্যান্ডিক্যাপের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় অর্ধেক প্রতিবন্ধীই কোনো ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আর যারা কাজ করছে, তাদের বেশির ভাগই দিনমজুর। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। বিয়ের বয়স হওয়া সত্ত্বেও অর্ধেক প্রতিবন্ধীই অবিবাহিত। প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার সুযোগ খুবই কম। মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী তার সমস্যার চিকিৎসা নিতে যায়। এছাড়া ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মুহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, সব হতদরিদ্র পরিবার এক নয়। আমরা যদি সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি, তাহলে যারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বঞ্চিত, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব হতদরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী রয়েছে, সেগুলোর ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। তাই এ প্রকল্পে প্রতিবন্ধী রয়েছে এমন পরিবারগুলোতে আয়বর্ধনমূলক সহযোগিতা দেয়া হবে, যাতে তারা দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এসব পরিবার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, প্রতিবন্ধী এসব পরিবার প্রায় সব দিক থেকে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। এসব পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশ শিশুই শিক্ষাবঞ্চিত। আগে এ হার আরো বেশি ছিল। শিক্ষা না পাওয়ায় কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতাও তৈরি হচ্ছে না। তাই কর্মসংস্থানের বেশ দুর্দশা। আর আয় না থাকায় স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থান—সব দিক থেকেই খুব মানবেতর জীবনযাপন করছে প্রতিবন্ধী এসব পরিবার।

সূত্র: বণিক বার্তা

পূর্বকোণ/ময়মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট