চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিবিধ ভাবনায় প্রযুক্তিযুগের ঈদ

আজিজ কাজল

৪ মে, ২০১৯ | ২:৩৫ অপরাহ্ণ

বিবিধ ভাবনায়
প্রযুক্তিযুগের ঈদ
আজিজ কাজল
ঈদ। সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্প্রীতিতে সবাইকে এক সাথে করার এই আনন্দ, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ-প্রবাসীর গায়েও লাগে অন্যরকম বিভূতি। ঈদের দুটো বড়ো ধর্মীয় উৎসব, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আনন্দের অনেক বড়ো অনুষঙ্গ হাজির করে। ঈদে হয় তারুণ্যের জয় জয়কার। কি টিনএজ, কি তরুণ, কি জোয়ান, কি বুড়ো, সবাই মাঝেই যেনো অন্যরকম আমেজ অনুভূতি ভরে করে। গ্রামেগঞ্জে প্রবাসী বউ-ঝি, মা-বাবা থেকে শুরু করে, দাদা-দাদী-ভাই-বোন আত্মীয় স্বজন অনেকেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, সদ্য প্রবাসে পাড়ি দেয়া সন্তানের প্রিয় ডাকটি শুনার জন্য।
যাই হোক প্রযুক্তিযুগে অনেককিছুই এখন হাতে নাগালে। কেউ মোবাইল, কেউ ট্যাপ, কেউ নোটবুকে, কেউ ল্যাপটপে বসে হোয়াটসঅ্যাপ বা বিভিন্ন অ্যাপ্সস মাধ্যম চালু করে, প্রিয় মানুষটির সাথে কথা বলছে। অনেকসময় ওপার থেকে শুনা যায়, দীর্ঘ আকুতি, হাহাকার, বুক-চাপড়ানো কান্নার আহাজারি! হয়তো বেশি দিন হয়নি কোন মরণঘাতি অসুখ বা অ্যাক্সিডেন্টে অনেকে তার আদুরে প্রিয় সন্তানটি হারিয়েছে। কেউ হারিয়েছে সদ্য বিবাহিত বর। কোন সন্তান হারিয়েছে তার বাবাকে। এই দিনটাই যেনো কিছু মানুষের জীবনে, মাঝেমধ্যে অন্যরকমভাবে হাজির হয়। কি এক দুঃখবোধে, কষ্ট আর বেদনাগুলো এক সাথে ভর করে, এক সাথেই প্রকাশ পায়। এদিনেই যেনো সব ধরনের চাপা আবেগ গগন বিদায়ী হয়ে, আকাশ বাতাস ভারী করে উপচে ওঠে!। গ্রামেই শুধু নয়। নগরেও রয়েছে বিষয়টি। অনেকের সন্তান গেছে উচ্চতর ডিগ্রী নেওয়ার জন্য দূর প্রবাসে। কেউ হয়তো বেঁচে আছে। ভাল আছে। কেউ হয়তো কোন কারণে নিজের ঠিকানায় ঈদ করতে পারছে না। কেউবা কোন কারণে সদ্য হারিয়েছে কোন প্রিয় সন্তান, স্বজন, বাবা, ভাই ইত্যাদি। আসলে এই নির্মম অপ্রিয় সত্য বা বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যায়না।
একটা সময় আমাদের হাজার বছরের বাংলার মাঝেই ছিলো, এক মিথোজীবী জীবন সংস্কৃতি। সময়ের বাস্তবতায়, একটা ভারসাম্যের ভেতর এটা হয়তো অন্যরকম একটা রূপ পাল্টেছে। এভাবে করে হলেও মোটামুটি সবাই চায়, নিজের ভাল লাগা আবেগ অনুভূতির নিজস্ব কিছু চাওয়া-পাওয়া সামর্থ্যরে ভেতরেই ভাল থাকতে। সুন্দর থাকতে। বাঁচার মতো করে বাঁচতে। কেননা মানুষ হিসেবে এই অধিকার অমূলক নয়। মুসলমানদের ধর্মীয় দুটো বড়ো উৎসব ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ছাড়া বাঙালি জীবনেও আছে ছোট ছোট পারিবারিক-সামাজিক নানা উৎসব। হিন্দু-মুসলমান বা অন্য সম্প্রদায়ের বড়ো উৎসবের দিনও, বাঙালিরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝেই এখন কমবেশি উৎসবের আনন্দগুলো ভাগাভাগি করতে দেখা যায়।
ইতিহাস মতে, মধ্যযুগের বাঙালি সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের অস্তিত্ব ছিল না। যদিও উনিশ এবং বিংশ শতকে এটা মোটামুটি দেখা যায়। বিংশ শতকের প্রথম তিন দশক পর্যন্ত লেখা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলো তার একটা বড় প্রমাণ হাজির করে। বর্তমান কাল প্রবাহে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে সেটা এখন ভঙুরই বলা যায়। কিন্তু এরপরেও তৈরি হয়েছে বর্ধিত পরিবার ধারণা এবং এই পরম্পরায় নব্যবর্ধিত পরিবার নামক ধারণা। সামাজিক মানুষ হিসেবে ঈদ পাবর্ণেই এই পার্থক্যগুলো আমাদের চোখে বেশি ধরা দেয়। এবার আসি বর্ধিত পরিবার আর নব্যবর্ধিত পরিবার ধারণা এর বিবিধ প্রসঙ্গে। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারে অবিবাহিত সন্তান কর্মসূত্রে শহরে আছেন। সে তার ভাইবোনকে শিক্ষিত করার জন্য গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে গেলো। এভাবে সে আস্তে আস্তে নিজের বাবা মাকেও শহরে নিয়েÑনিজের সাথে রাখলেন। এটাই মূলত বর্ধিত পরিবার ধারণা। এখন আরেক ধরনের বর্ধিত পরিবার আছে সমাজতত্ত্বের ভাষায় যাকে বলে নব্যবর্ধিত পরিবার। যেসব পরিবার কাছাকাছি বাস করেন এবং সবার সাথে একটা ভাল সম্পর্ক বা যোগ সংযোগ আছে। এটাকে নব্যবর্ধিত পরিবার ধারণা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরকম ভিন্ন অনেক বাস্তবতার ভেতর দিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ চালু আছে। যেমন শহরে নিজের বাবা মা ভাই বোনকে নিয়ে, অনেক বিবাহিত সন্তান কর্মসূত্র বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া করে থাকছেন। শহরে যারা স্থায়ী বাসিন্দা, তারাও পৈতৃক সম্পত্তির ভাগে পাওয়া নিজেদের বড়ো কোন দালান বিল্ডিং এর বিভিন্ন ফ্লোরে বাবা মা ভাই বোন স্ত্রী স্বজন নিয়ে পারস্পরিক সম্মতিতে সবাই সমন্বয় করে থাকছেন। অনেক বাবা মা, একই বিল্ডিং এ অবিবাহিত কনিষ্ঠ সন্তান বা কন্যাসহ নিয়ে একসাথে থাকেন। অনেক সন্তান, সেই পিতার ভাগে পাওয়া কোন তলার ফ্ল্যাট বা বাসায় স্বামী-স্ত্রী সন্তানসহ ছোট পরিবার নিয়ে থাকেন। অনেকে নিজের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তি স্বাধীনতা বা নিজস্বাচ্ছন্দ্য এর কথা ভেবে, অথবা কর্মসূত্রে বাবা মা থেকেও আলাদা থাকেন। যদিও শহরে বা গ্রামে যাই হোক সবাই একসাথে না থাকতে পারার এই বাধ্যগত বাস্তবতা (শারীরিক এবং মানসিকভাবে) পরবর্তীতে আবারো সবাইকে একসাথে হওয়ার আরেকটি সুন্দর বাস্তবতা তৈরি করে। দেখা যাচ্ছে একই ভিটায় একই ঘরে না থাকলেও বাপদাদার জন্মভিটা হিসেবে ঈদ পার্বণে মা-বাবা-ভাই-সবাইকে একসাথে হতে দেখা যায়। পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে, দু’একটা দিন এক সাথে হওয়ার ফলেও অনেক বড়ো পরিবারের বন্ধন এই বাস্তবতার ভিত্তিতেই দৃঢ় থাকে। আবার অনেক পারস্পরিক অনৈক্যের ফলে, একই বন্ধনে ঈদ করতে না পারার কারণে, অনেক সামাজিক বন্ধন, কিছু মানুষের নেতিবাচক আচরণ বা অভ্যাসজনিত কারণে নষ্ট হয়ে যায়। শিথীল হয়ে যায়। এতে করে সবচেয়ে বড়ো মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, পরিবারের ধীরে ধীরে বড়ো হওয়া আদরের সন্তান এবং বয়স্ক বৃদ্ধ বাবা-মা। অনেকে আছে সম্পর্কসূত্রে কাছাকাছি থেকেও কোন কারণে, শুধু নিজ রক্তের বন্ধন ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের সম্পর্ক থাকছেনা। এই কারণে পরিবারে অবস্থাপন্ন সন্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া, অনেক বৃদ্ধ-বাবা মুখ বুজে গুমরে ওঠা বুকফাটা আর্তনাদ বা শূন্যতায় নিজের বাকী সময়গুলো পার করেন!। এই বিশৃঙ্খলা পরিবারের সন্তানদের মাঝেও একধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক সময় দেখা যায়, সন্তানেরাও এক ধরনের পারিবারিক সামাজিক বিশৃঙ্খলা, অনৈক্যের মধ্য দিয়ে, বড়ো হয়ে ওঠে। একটা সময় দেখা যায় ঐ সন্তান, নিজের ভাই বোন চাচাতো দূরে থাক নিজের মা-বাবার প্রতিও অন্যধরনে উদাসিন থাকেন; পারিবারিক বৈকল্য নিয়ে এক ধরনের নিষ্ঠুর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এতে করে এইসব সন্তানের সিংহভাগ একরোখা স্বাধীন-স্বার্থপর বা অসামাজিক হয়ে বেড়ে ওঠে।
আসলে এমন ঈদ পার্বণে বা পারিবারিক সামাজিক বিভিন্ন অনুসঙ্গগুলোতে নিজ সন্তানদের যথাসম্ভব সবাইকে পারস্পরিক একসাথে হওয়ার বাস্তবতার ভেতরে বড়ো করা দরকার। কেননা এই বিষয়গুলোর সাথে নিজেদের ইনভল্বড় না করার স্বার্থপরতা, নিজ সন্তানদের শিক্ষাজীবনেও বড়ো একটা নেতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কেননা পারিবারিক বা সামাজিক হওয়ার মৌলিক (ন্যূনতম) শিক্ষার কোনটাই যেহেতু সে সঠিকভাবে পায়নি। এতে করে একদিন সে পড়াশুনা করে বড়ো হয়ে নিজেকেই শুধু চিনতে শিখবে। নিজের ভাই বোন বাবা মা’র প্রতি সম্পর্কের যে বন্ধন, তা হয়ে পড়বে অনেক বেশি একরোখা, আলগা, শিথীল ও অমানবিক।
আসলে এই দুর্দশা বা ব্যবদান এখন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাপনার মধ্যেও যেহেতু বিদ্যমান। এর আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা আমাদের সন্তানদের নিজেদের সহজাত যে প্রতিভা বা ক্ষমতা সেটা কে চিহ্নিত করিনা। আমরা সমাজের তথাগত, আরোপিত কিছু সামাজিক মর্যাদা বা সম্মানের দোহাই দিয়ে, তার প্রতিভাকে খুন করি। খুব সহজে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করি। নিজেদের বস্তুগত চাওয়া পাওয়া স্বপ্নের মাঝে নিষ্ঠুর এক স্বার্থপর আচরণের ভেতর দিয়ে, আমাদের সন্তানদের ক্ষমতার আত্মঘাতী বিনষ্ট ঘটাই।
ঈদ বাঙালির অনেক বড়ো একটা উৎসব যেখানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে সবাইকে এক হওয়ার শিক্ষা দেয়। আমরা চাই আমাদের তরুণ প্রজন্ম সেই সৌহার্দ্যময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্তানের ভেতর দিয়ে, মানবিক মানুষ হয়ে ওঠবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট