চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

আনন্দ ও সমন্বয়ের সমুজ্জ্বল প্রতীক ঈদ

আজিজ কাজল

৩ জুন, ২০১৯ | ১:৫১ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে আলাদা স্বকীয়তায় ভাস্বর হয়ে আছে ঈদ। প্রতি বছর ঈদ-উল ফিতর ও ঈদ-উল আজহার মধ্যে ঈদ-উল ফিতর এর রয়েছে অন্যরকম মহিমা। বিশেষ করে রমজান এর তিরিশ রোজার সেক্রিফাইস ও সংযম এটা যেনো সবার কাছে অন্যরকম একটা পুরস্কার হিসেবে ধরা দেয়। বাঙালি স্বাভাবিকভাবে আবেগ প্রধান ও আনন্দপ্রিয় জাতি। ঈদ আসার আগে রমজানে এটা আরো ভাল করে টের পাওয়া যায়। সবার মাঝে পোশাক কেনার ধুম। পাঞ্জাবি, শাড়ি ও অলংকার থেকে শুরু করে সব ধরনের পোশাক-আশাক কেনার বড়ো একটা উপলক্ষ এই ঈদ। যারা কর্মব্যস্ত মানুষ। সারা বছর কেনাকাটা করার সময় সুযোগ পান না। তারাও মোটামুটি বেরিয়ে পড়েন। সামনের বছরের আগ পর্যন্ত লম্বা একটা শপিং সেরেই ফেলেন। টিন-এজদের তো কথাই নেই। তাদের তো সারা বছরই ঈদ-আনন্দ। সারাবছরই কেনাকাটা। ঈদ আসলে দু’একটা বাড়তি আইটেম যোগ না করলে কি মানায়? এভাবেই এই ঈদে।
এক সময় বাঙালি একত্র বসবাস পছন্দ করতো। প্রাচীনকালে একান্নবর্তী পরিবার পরিবার ছিলো। মানসিকভাবে সবার রুচি ও ঐক্যে একটা বড়ো যোগ-সংযোগ ছিলো। এখনতো পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, রুচি, সূচিসহ নানাবিধ কারণে বড়ো পরিবার ভেঙে গেছে বলা যায়। এখন বিশেষ কোন উপলক্ষে সবাই কয়েকদিনের একত্র বসবাস হয়তো কিছুটা পছন্দ করে। ঐক্যবদ্ধ বাঙালির স্বরূপ বুঝার জন্য—বিষয়টা নিয়ে বলার আগে একটু পেছনে যেতে চাই। পাক-ভারত উপমহাদেশে, আর্য সমাজের আগে বাংলার প্রাচীন মানুষেরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একত্রে বসবাস করতো। এটাই ছিলো বাংলার প্রথম প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা। বর্তমানে আমরা আত্মকেন্দ্রিক ও চরম স্বার্থপর হয়ে পড়েছি।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে এদেশে বিশেষ দিনগুলোতে যেমন- ঈদ, পূজা, পালা-পার্বণ, বড়োদিনের মতো নানা উৎসবের আমেজে সংলগ্ন আজকের এই বাঙালি। সবচেয়ে বড়ো যে বিষয় সেটা হলো, আমাদের সবার আছে ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত-সংস্কৃতি। যেখানে খাওয়া-দাওয়া-চলাফেরা, রুচি-অভ্যাসসহ নানা অনুষঙ্গগুলোতে, চেতনে-অবচেতনে বাঙালি মানসিক ঐক্যে পৌঁছেছে। সুতরাং উক্ত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ঈদে সবাই একই সুরে মেতে ওঠে। তাছাড়া সরকারীভাবে থাকে নানা বন্ধ ও ছুটি। বাজার সদাইপাতি থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজনের সাথে একত্রে মিলিত হয়ে আমরা ঈদকে উদযাপন করে থাকি।
এক পরিবারে বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে একজন পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমে অন্যজন পড়ছে বাংলা অথবা আরবি মাধ্যমে। মানসিক নানা বিভাজন সত্ত্বেও রক্তের বন্ধনজনিত কারণসহ সুখে দুঃখে একই ছাদের নিচে এক সাথেই থাকছেন। এমন উদাহরণ কিন্তু ভুরি ভুরি আছে। দেখা যায়, ঈদ বা এমন কোন মহোৎসবে সকলে এক কাতারে মিলিত হয়। এই দিন তারা ভুলে যায় ভুল বুঝাবুঝি। পরস্পরের নানা মত বিরোধ, ঝগড়া ঝাটি। এটা শুধু একটা পরিবারের চিত্র নয়। এটা এখনও আমাদের বাঙালি মুসলমান সমাজ কাঠামোর একটা সাধারণ চিত্র।
ঈদের আনন্দ উদ্যাপন করতে সিংহভাগ মানুষ নিজের জন্মভিটায় চলে যায়। পুরো বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে শুরু হয় বিশাল উৎসব। কেননা ঈদকে ঘিরে সব সম্প্রদায়ের মানুষ এই একটি দিনে হলেও অন্তত নিজের ঘরবাড়িতে ঘুরে আসার সুযোগ পায়। পুরো বাঙালি তখন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। সবাই স্ত্রী পুত্রসন্তান-সন্ততীসহ সপরিবারে গ্রামের বাড়ি যায়। আবার কেউ পুত্র-সন্তান-বাবা-মা-ভাইবোন-দাদা-দাদিসহ সপরিবারে গ্রামের বাড়ি যায়। গ্রামের মেঠোপথের সুন্দর কাঁচা রাস্তা ধরে বাবা পুত্র-কন্যা সমেত হাঁটছেন। বাচ্চারা, গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কৌতূহল ভরে তার বিন্দু-বিসর্গ বুঝার চেষ্টা করছে। বাবা তার পুত্র বা কন্যা সন্তানকে দেখিয়ে দিচ্ছেন ঐ জায়গাটা তোমার পুরান দাদার বাড়ি। হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে বড়ো হওয়া এমন অনেক সন্তান বাধা গরু ছেড়ে দেয়ার মতো! নানা কৌতূহলে এদিক-সেদিক দৌড়াতে থাকে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন সচেতন বাবা-মা তাদের প্রকৃতিলগ্ন সৃষ্টিশীল কিছু দেখিয়ে। বলতে পারেন, নিজের দেশ বাংলাদেশের কথা। এভাবে তারা গ্রাম-গঞ্জের আনাচে কানাচে ভিন্ন একটা পরিবেশ পরিপার্শ্বকে আপন করে নেয়ার চেষ্টা করে। মানুষ বড়ো হওয়ার জন্য ভাল হওয়ার জন্য প্রকৃতির উদারতার কাছে পাঠ নেয়াও জরুরি। রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি পদ্যে বলেছেন, ‘বিশ^জোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’।

লেখক হ কবি, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট