চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

ছেলেধরা গুজব ও আতঙ্কিত শিক্ষার্থী

লিটন দাশ গুপ্ত

৫ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

এখন কথা হচ্ছে, সেই সময়ের তুলনায় এই সময়ে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তা চেতনার অনেক উন্নতি হয়েছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু গুজব বা রটনা অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার হ্রাস পাবার কথা থাকলেও কেন যে অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে গুজবের পরিধি বা নামের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন- আগে ছেলেধরা বলা হলেও এখন তা বলা হচ্ছে মাথাকাটা গলাকাটা চট্টগ্রামের ভাষায় ‘হল্লা হাডা’। আগেকার সময়ে গুজব ছিল সীমিত এলাকায়, ছড়িয়ে পড়ত দুয়েকটি উপজেলায় বা জেলার অভ্যন্তরে। আর এখন দেশব্যাপী চলমান মাথাকাটার গুজব এপার বাংলা ছাড়িয়ে ওপার বাংলায়ও ঠেকেছে।

‘ছেলেধরা’ সেই ছোট বেলায় আমাদের কাছে একটি বহুল পরিচিত পুরনো শব্দ ছিল। দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় থাকার পর, এই পুরনো পরিচিত শব্দটি আবার নতুনভাবে আমাদের সবার সামনে চলে এল। এখানে ‘ছেলেধরা’ মানে মেয়েরা বাদ বা মেয়েরা নিরাপদ, এমন কিন্তু নয়। ‘ছেলেধরা’ ছেলেদের যেমন ধরে, তেমনি মেয়েদেরকেও ধরে! কারণ ‘মেয়েধরা’ যারা, তারা ছেলেও ধরতে পারে না, মেয়েও ধরতে পারে না, তাই তাদের কথা কেউ বলেও না। তবে যারা ‘ছেলেধরা’ তারা, ছেলেমেয়ে দুইকে ধরে, তারপরেও কেন যে তাদেরকে শিশুধরা বা ছেলেমেয়ে ধরা না বলে কেবল ছেলেধরা বলা হয়, তা আমার কাছে জানা নেই।
যে কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, সেই ছোট্ট বেলায় আমাদের কাছে বহুল পরিচিত শব্দ ছেলেধরা। শৈশবে যখন কয়েক বছর পর পর ছেলেধরার গুজব শুনতাম, তখন মাতা পিতা অভিভাবক আতঙ্কিত থাকলেও মনে মনে আমি বা আমরা খুশী হতাম স্কুলে যাওয়া থেকে বাঁচতে পারবো বলে।
যা হোক, এখন কথা হচ্ছে, সত্যিই কি ছেলেধরা বলতে কেউ আছে? ছোট বেলায় শুনতাম, কালুরঘাট পুলে ফাটল ধরেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে শিশু বলি দিতে না পারলে সেতু ভেঙে ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এখন শোনা যাচ্ছে পদ্মাসেতু জোড়া নিচ্ছে না, মাথা প্রয়োজন!
এখন কথা হচ্ছে, সেই সময়ের তুলনায় এই সময়ে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তা চেতনার অনেক উন্নতি হয়েছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু গুজব বা রটনা অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কার হ্রাস পাবার কথা থাকলেও কেন যে অধিকতর বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে গুজবের পরিধি বা নামের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন- আগে ছেলেধরা বলা হলেও এখন তা বলা হচ্ছে মাথাকাটা গলাকাটা চট্টগ্রামের ভাষায় ‘হল্লা হাডা’। আগেকার সময়ে গুজব ছিল সীমিত এলাকায়, ছড়িয়ে পড়ত দুয়েকটি উপজেলায় বা জেলার অভ্যন্তরে। আর এখন দেশব্যাপী চলমান মাথাকাটার গুজব এপার বাংলা ছাড়িয়ে ওপার বাংলায়ও ঠেকেছে। এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিচ্ছে সাধারণ নিরীহ মানুষকে।
সার্বিক ক্ষেত্রে দেশ সবল হলেও, এখন অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্ক কত যে দুর্বল রয়ে গেল, তা এই ধরনের গুজব বিশ্বাস করা থেকে প্রমাণিত হয়। আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি। এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। আমার শৈশবে দেখা বাংলাদেশ আর এখনকার সময়ে দেখা বাংলাদেশ আকাশ পাতাল ব্যবধান। শিক্ষা সংস্কৃতি প্রযুক্তি স্বাস্থ্য
কৃষি শিল্প যোগাযোগব্যবস্থা ও জ্ঞান বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। পদ্মাসেতু নির্মাণ এত বড় একটা প্রকল্প, তাও আবার নিজস্ব অর্থায়নে। বর্তমান সরকারের ব্যাপক সাফল্যে কিন্তু একশ্রেণির মানুষ ঈর্ষান্বিত। তাই তারা এই পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে বলে গুজব রটিয়ে ফায়দা লুটতে সচেষ্ট হয়েছে। অথচ হাজার হাজার অভিভাবক লক্ষ লক্ষ মানুষ অন্ধের মত চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে যাচ্ছে তাদের কথা। অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ ভালো সৎ মানুষের সত্য কথা উপেক্ষা করে, অন্যের ‘শোনা’ কথা অজ্ঞ মূর্খের মত বিশ্বাস করে যাচ্ছে অনেক সার্টিফিকেট অর্জনকারী তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি; তাতে আমি বিস্মিত হচ্ছি, যা না ভেবে পারছি না। কারণ অনেক শিক্ষিত মানুষ আমার থেকে জানতে চেয়েছে এই ঘটনা সত্য কিনা? এরা কি শিক্ষা গ্রহণ করেছে, কি লেখাপড়া করেছে আমার প্রশ্ন? আমার কাছে জানতে চাওয়া অপরাধ নয়, কিন্তু তাদের সত্য মিথ্যা নিয়ে দ্বৈত মনোভাব থাকবে কেন? আজ এই সকল বোকা মানুষের কারণে বলি হয়েছে কতগুলো নিরীহ মানুষ। অকালে ঝরে গেল কত গুলো তাজা প্রাণ। এইপর্যন্ত দেশে বহুমানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। কেবল পশ্চিমবঙ্গে নিহত সংখ্যা চৌদ্দ জন বলে বিবিসি জানিয়েছে। অথচ যার একজনও ছেলেধরার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল না।
সাধারণ অভিভাবক বা মা-বাবা এমন গুজবে সাড়া দিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে না। আবার অনেক অভিভাবক বা মা-বাবা, এখন নিজের ছেলে-মেয়ে নিয়ে বের হতেও ভয় পাচ্ছে। কারণ মা-বা বাবার সাথে বের হওয়া ছেলে-মেয়ে যদি চকলেট খাবার জন্যে বা অন্য কোন কারণে রাস্তায় কান্না করে, সাধারণ মানুষ মনে করবে ছেলেধরা, অতঃপর গণধোলায়! এই গণপিটুনি বা ছেলেধরা সন্দেহ থেকে রেহাই পায় নি উচ্চপদস্থ মানুষ, বিবিসি’র সাংবাদিক, বিভাগীয় পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অনেকে। মানুষ এখন যান্ত্রিক হয়ে গেছে, আবার তার মধ্যে কিছু মানুষ অতিযান্ত্রিক। এখন এই অতিযান্ত্রিক ‘মানব’ যন্ত্রের বিবেক আবেগ হারিয়ে দানবে পরিণত হয়েছে। তাদের বোধশক্তি লোপ পেয়ে দিনদিন পশুতে পরিণত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই নিয়ে দৈনিক পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে ‘মনুষ্যতে পশুত্ব ও পশুতে মনুষ্যত্ব’ শিরোনামে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম।
যা হোক, এখন কথা হচ্ছে চলমান ছেলেধরা বা গলাকাটা গুজব সম্পর্কে আমার কাছে অনেকে জানতে চেয়েছে। আমার মনে হয় এই বিষয়ে জানার জন্যে এই পর্যন্ত কয়েক ডজন মানুষ আমাকে হয় মোবাইল করেছে, না হয় আমার কাছে এসে জানতে চেয়েছে আসল ঘটনা কি। ব্যক্তিগত কৌতুহলের কারণে তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞাস করলাম, এই বিষয়ে পত্রপত্রিকায় দিচ্ছে টেলিভিশনে দেখাচ্ছে, তাছাড়া এত মানুষ থাকতে আমার কাছে কেন জানতে এলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা হতভম্ব হয়ে তিনি বলেন, তাঁর নাকি মনে হয়েছে আমার কাছে এলে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সত্য ও সঠিক তথ্য পাবেন, তাই আসা। বিষয়টি শুনে ভালোই লাগল, একইসাথে আমার উপর বিশ্বাস রাখার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। আমি জানি এই রকম অনেকেই আছেন আমার প্রতি বিশ্বাস আছে। তাই তাঁদের সবার উদ্দেশ্যে আমার আজকের এই লেখা। তাদের দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাতে চাই এই সব হচ্ছে গুজব। একই সাথে বলে রাখা ভালো নেত্রকোনা শহরের নিউটাউন এলাকায় জনৈক ব্যক্তির ব্যাগে, যে শিশুটির মাথা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে সেটি ছেলেধরার বিষয় নয়, এটি একটি হত্যাকা-। এছাড়া দুয়েক জায়গায় ছেলে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টার সাথে পদ্মাসেতুতে মাথা লাগার গুজবের সম্পৃক্ততা নেই। তাই এক কথায় বলতে চাই, এই সব গুজবে কান দিবেন না। যারা এই সব গুজবের সাথে সম্পৃক্ত তাদের প্রতিহত করুন।

লেখক- শিক্ষক ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন