চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

শিক্ষা নয়, সুশিক্ষাই জাতির মেরুদ-

শাহিদা আকতার জাহান

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বের মানবতার গতি-প্রকৃতি, জীবনাচার, একই। সুন্দর পরিবেশ, নিরাপত্তা, অভাবহীনতা, নিরপেক্ষতা, সবকিছুই সঠিক ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি নবজাতকের জন্যে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকে সুশিক্ষা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া তদস্থানীয়
অভিভাবক ও শিক্ষকের দায়িত্ব-কর্তব্য। প্রাথমিক বিদ্যালয় একটি শিশুর জ্ঞান অর্জন ও বিকাশের স্থান। আর একটি দেশের সব চেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে নতুন প্রজম্নের মেধা। শিশুর মনে সুপ্ত থাকে সহজাত প্রবৃত্তি, সুপ্ত থাকে সম্ভাবনার বীজ। শিক্ষক শিশুর জ্ঞানের গভীরতা ও সুনিপুণ শৈল্পিক দৃষ্টি দিয়ে শিশুর ভেতরে থাকা নেতৃত্বের গুনাবলি বিকাশের ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়ে জ্ঞান-প্রজ্ঞার সাথে মনের সমুদয় আদর, সোহাগ-স্নেহ দিয়ে শিশুর সার্বিক বিকাশের সহায়তা করে। কারণ শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক ‘এঁধৎফরধহ ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হ.’ শিক্ষক শুধু পাঠ দান করেন তা নয়। তিনি জাতিগঠন করেন এবং মানুষ গড়েন
সুনিপুন হাতে। জাতির উন্নয়ন, মান নির্ভর করে দেশের নাগরিকের উপর, আর নাগরিকের মান নির্ভর করে দেশের শিক্ষার মানের উপর, আর সুশিক্ষার মান নির্ভর করে শিক্ষকের সুন্দর-সাবলীল উপস্থাপনা, দক্ষতা ও গঠনমুলক তথ্যসংবলিত পাঠদানের গুণাবলীর উপর। ‘ঊফঁপধঃরড়হ রং ষড়হম, ষরভব রং ংযড়ৎঃ.’ শিক্ষা অনন্ত; জীবন সংক্ষিপ্ত। বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হলো
সুশিক্ষা। উন্নত সমাজ গঠন ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দেশের সমৃদ্ধির জন্য সুশিক্ষার বিকল্প নাই।
সুশিক্ষা একটি জাতির সমৃদ্ধির মূল ভিত্তি। কি ভাবে সাধারণ থেকে আসাধারণ হওয়া যায় তার প্রমাণ হলো সুশিক্ষা। একটি দেশকে শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে হলে প্রথমে
সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুশিক্ষার মাধ্যমে ধর্মীয়মূল্যবোধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও উদারতা আনতে হবে। তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে। সুশিক্ষা মানে পুঁতিগতবিদ্যা বা কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা মানুষকে দক্ষ করে তুলে এবং অনুকুল পরিবেশ থেকে প্রতিকুল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার শক্তি যোগায় তাই সুশিক্ষা।
সুবিশাল মহীরুহ যেমন ছোট্ট একটি বীজের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে, সে বীজ উর্বর মাটিতে রোপিত হলে এবং অনুকুল পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে ক্রমে ক্রমে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়। ঠিক মানব শিশুও জন্মের পর পরিপুর্ণ প্রতিভা ও অপার সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম গহণ করে। আর জন্মের পর হতেই মানব শিশুর শিক্ষা শুরু তার পরিবার এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে কাছ থেকে। পরিবার থেকে লব্ধ এই মৌলিক শিক্ষাই পরবর্তী জীবনে শিক্ষার ভিত তৈরি করে দেয়। শিশুর মনোদৈহিক বিকাশের জন্য তার পরিবারকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় বলা যায়। পরিবারের
ভালোবাসা, আদর-যত্ন, জীবনাদর্শ মানবিক ও নৈতিক গুণাবলিতে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভাল-মন্দ বুঝতে পারে, শিক্ষার সাথে নৈতিকতা অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত।
সুশিক্ষা হচ্ছে মানুষের মধ্যে আচরণগত, মনুষ্যত্ববোধ, বিবেকবোধ, নৈতিকতার পরিবর্তন ও জাগ্রত করা। বিবেকবোধ বর্জিত মানুষ, সমাজের, দেশের সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ শিক্ষা হচ্ছে একটি দর্শন, আগুনের পরশমণি, যার ছোঁয়ায় মানুষের
মানবিক, নৈতিক জীবনবোধ, মূল্যবোধ সৃষ্টি করে পারিবারিক অনুশাসন, আর্দশিক মূল্যবোধ ও সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়।
শিশুরা হচ্ছে স্বভাবগতভাবে অনুকরণ প্রিয়। সে তার চারপাশের পরিবেশ থেকে যা দেখে, পরিবার থেকে যা শেখে তাই সে আত্নস্ত করে। এই শিশুদের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। আগামীর দেশ ও জাতির নেতৃত্ব্য দিবে তারাই, তাই তাদেরকে সে লক্ষ্য অর্জনে যোগ্য করে তোলা না যায় তবে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাদের মাঝে দেশপ্রেম, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষার বীজ যথাযথভাবে বপন করতে হবে। শিশু কিসে আনন্দ পায়, কোন বই পড়লে
উপকৃত হবে, তাদের বয়স, রুচি, সামর্থ্যরে উপর ভিত্তি করে বই প্রণয়ন করতে হবে। শিশুদের জন্য একটি শিশু নীতিমালা প্রণয়ন করলে শিক্ষার সঠিক মান, ইতিহাস-চেতনার বিভিন্ন ধারা অতীতে সৃষ্টি হয়েছে জাতি সেখান থেকে মুক্তি পাবে। প্রথম থেকে শিশুদের আতেœাপলদ্ধি, মননশীলতা মেধা বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জীবনকে বাস্তবে রূপ দিতে অভিভাবকবৃন্দ, ও শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সৃজনশীল ও মননশীল পরিবেশ শিশুদের জন্য গড়ে তুলতে পারলে তারাই হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির স্বপ্ন পূরণে এদেশের আলোকিত মানুষ। তাদের মাঝে অনেক সুপ্তপ্রতিভা লুকায়িত রয়েছে, তা
বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা সরকারের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ব।
শিক্ষার প্রথম ভিত হলো প্রাথমিক শিক্ষা। এই প্রথম শিক্ষার ভিত যদি দৃঢ় বা মজবুত না হয় তাহলে শিশুদের আস্তে আস্তে তাদের সুশিক্ষা থেকে বিচ্যুতি ঘটবে। শিক্ষা শিশুর সুযোগ নয়। তার মৌলিক অধিকার। বর্তমান সরকারের এতো উন্নয়নের মাঝেও শিক্ষাকে নিয়ে বাণিজ্য করার অপচেষ্টার লোকের অভাব নেই। ব্যবসার মনোবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার নামে গড়ে উঠেছে অনেক মাধ্যামিক উচ্চমাধ্যামিক ও বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রামে শহরে অনেক কিন্ডার গার্ডেন্ট গজিয়ে উঠেছে অলিতে গলিতে। অসাধু ব্যাবসায় জড়িতরা পরীক্ষার আগের দিন রাতে প্রশ্নপত্র প্রকাশ করে। কতো নিচু মন মানসিকতার লোক হলে একাজ করতে পারে?
আজকের এই প্রযুক্তির যুগে শিক্ষায় জাতির মেরুদন্ড একথা সঠিক নয়। এ উন্নত ও প্রযুক্তির যুগে আমাদের ‘স্লোগান হবে একটাই, ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদ-’ সুশিক্ষা হলো জলন্ত আলোর সমতুল্য। সূর্যের আলোয় যেমন পৃথিবীকে আলোকিত করে। টিক উপযুক্ত
সুশিক্ষায় মানুষের মনোজগৎতের সকল অন্ধকার দুর করে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে আমরণ পর্যন্ত। সূর্যের আলো ছাড়া যেমন পৃথিবী অন্ধকার। তেমনি সুশিক্ষা ছাড়া অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করার কোন বিকল্প পথ নেই। তাই বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে বই উৎসব করে এবং সুন্দর পরিবেশে ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই প্রদান করে। মাদের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা প্রদান, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, শিক্ষক নিয়োগ, দপ্তরি নিয়োগ, প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণীর পদমর্যাদায় উন্নীত, ২২৩ ভাগ বেতন বৃদ্ধিকরণ, এক সাথে সব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা সবকিছুর আমুল পরিবর্তন এসেছে বর্তমান সরকারের আমলে। স্বাধীনতার পূর্বে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম অবহেলায় দিন কাটাতো, আমরা গর্বিত দীর্ঘ দিন পর হলেও বঙ্গবন্ধুর পর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা কোন আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়াই শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবী মেনে নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবন ধারায় পাল্টে দিয়েছেন। সুশিক্ষা ছাড়া একজন মানুষ প্রকৃত অর্থে শিক্ষার সঠিক ও সম্যক ভাবে জ্ঞান লাভ করতে পারে না। শুধু মাত্র তত্ত্ব ও তথ্য সরবরাহ বা হস্তান্তরকে সুশিক্ষা বলা যায় না। প্রকৃত শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন আনা। মনুষ্যত্ববোধ, বিবেকবোধ জাগ্রত করা।
মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ প্রকাশিত ও
বিকশিত হয় অন্যদের ভাল সাহচর্যে। ভালো সাহচর্যে থাকার জন্য দেশ ও সমাজ শিশুদের নৈতিক বিকাশের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। সেখানে নিজ পরিবারের শেখা মূল্যবোধের সাথে অপরাপর শিশুদের মূল্যবোধের দ্বন্ধ-সংঘাত দেখা দিতে পারে। আবার তা পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধগুলো বিস্তার লাভ করতে পারে। তাই সুশিক্ষার জন্য দরকার উপযুক্ত পরিবেশ ও উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। বই পুস্তকে নীতিকথা লিখিত থাকে তা ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্থ করিয়ে বিষয় বস্তুুর উপর পরীক্ষা নিয়ে পাশ-ফেল নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু সুশিক্ষা দানের ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মানবিক, নৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধগুলো জীবনের ভিত্ত হিসেবে গড়ে উঠল কিনা তা মূল্যায়ন করা খুবই জরুরী।

চলবে

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট