চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশের রাজনীতির প্রবীণতম স্তম্ভের বিদায়

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ

শতবর্ষ স্পর্শ করার আগে আগে চলে গেলেন বাংলাদেশের রাজনীতির প্রবীণতম স্তম্ভ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সুদীর্ঘকালের সভাপতি।

বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির বিকাশ, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আন্দোলন গঠন, সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্রের লড়াই-সংগ্রাম পরিচালনার রাজনৈতিক কর্মকা-ে তিনি ছিলেন সামনের কাতারের নেতা। কট্টর সমাজতন্ত্র থেকে বের হয়ে ‘লিবারেল সোসালিষ্ট ডেমোক্রেসি’ বা ‘উদার সমাজবাদী গণতান্ত্রিক’মতাদর্শ বিনির্মাণেও তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা

বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় শ্রেণি সংগ্রাম বা সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনৈতিক রণকৌশল থেকে সরে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, সংসদীয় ধারার প্রতি আস্থা রেখে রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ‘ধর্ম, কর্ম, সমাজতন্ত্র’ শীর্ষক পপুলার স্লোগান দিয়ে তিনি গণতান্ত্রিক আবহের রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রগতিশীল-সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হন। খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’- এর মাধ্যমে খোলা দরজার পুনর্গঠনের নীতি গৃহীত হওয়ার পূর্বেই এই দূরদর্শী নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে জনপ্রিয় ও গণসম্পৃক্ত করতে সচেষ্ট হন।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ছিল একটানা সাত দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। বাংলাদেশের অন্য কোনও নেতা তার মতো ৭০ বছর রাজনীতিতে সরব থাকার সুযোগ পান নি। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্ম নিয়ে তিনি ৪০-এর দশকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ২৩ আগস্ট ২০১৯ সালে ৯৭ বছর বয়সে তার সেই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটলো।

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে পাকিস্তান শাসনামল শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন মনে রাখবে।

চল্লিশের দশকে ‘পাকিস্তান উন্মাদনার’ বিপরীতে যে মুষ্টিমেয় প্রগতিশীল মুসলমান তরুণ ছাত্রাবস্থায় বামপন্থায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, মোজাফফর আহমদ তাদের একজন। ১৯৫১-৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়, তখন মোজাফফর আহমদ ঢাকা কলেজের শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও সেখানে বেশিদিন থাকেননি। লোভনীয় ও নিরাপদ চাকরি ছেড়ে তিনি পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিয়োজিত হন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমদ বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় নেতা হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে মোজাফফর আহমদের নামে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি ছিলেন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ১৯৬৭ সালে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধের সূত্র ধরে ন্যাপ বিভক্ত হলে মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। তারপর থেকে কমরেড মণি সিংহ-কমরেড ফরহাদের আত্মগোপনকালে সোভিয়েতপন্থী রাজনীতির প্রকাশ্য গণফ্রন্টের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির অভাব পূরণ করেছিলেন তিনি ও তার দল মস্কোপন্থী ন্যাপ। তিনি ছিলেন বিভক্ত ন্যাপের মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে আমলের পুরোটা সময় ন্যাপের সভাপতি। মৃত্যুর পূর্ব-পর্যন্ত তিনি এ পদে আসীন ছিলেন।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ছিল ঐতিহাসিক ও গৌরবময়। মুক্তিযুদ্ধকালে মোজাফফর আহমদ মুজিবনগর সরকারে এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্ক যান তিনি। মোজাফফর আহমদের সম্পাদনায় ‘নতুন বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছিল মুজিবনগর থেকে। পরবর্তীতে তিনি পত্রিকাটিকে সাপ্তাহিক আকারে দলীয় মুখপত্র রূপে প্রকাশ অব্যাহত রাখেন।

আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এই প্রবীণ রাজনীতিক ১৯৮১ সালে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও একতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি সর্বদাই সরব ছিলেন।

নেতৃত্ব ও মতাদর্শিক কারণে বৃহত্তর সোভিয়েতপন্থীদের অনেকেই ক্রমে ক্রমে তার দল ও তাকে ছেড়ে চলে গেলেও সততা ও আদর্শবাদিতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়। রাজনীতিকে তিনি দেশসেবা ও জনসেবা অর্থে গ্রহণ করেছিলেন, পদ-পদবি বা অর্থ উপার্জনের মাধ্যম করেন নি। যে কারণে ক্ষমতার রাজনীতি বা মন্ত্রীত্বের আহ্বান তাকে বিচলিত করে নি।
এমনকি, দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ গ্রহণেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। কারণ, তিনি কোনও কিছু পাওয়ার জন্য রাজনীতি করতেন না, এই ঘোষিত নীতিগত অবস্থানের কারণে পদক গ্রহণ করেন নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক প্রত্যাখানের প্রথম ও একমাত্র উদাহরণ তিনি।

তিনি স্পষ্ট জানিয়ে গেছেন, ‘পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম, কোনো পদক বা পদ-পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশায় নেননি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘রাজনীতির অর্থ দেশ সেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবীর জন্য কখনো রাজনীতি করি নাই। শেখ মুজিব আমাকে অনেক কিছু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন আমি হই নাই। আমি মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা ভাসানীর অনুসারী।’
তিনি বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু ও অবক্ষয়ের রাজনৈতিক ধারায় একজন উজ্জ্বলতম ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রবীণতম স্তম্ভ আর আদর্শিক সততার সুউচ্চ মিনার ছিলেন তিনি। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে জাতি হারিয়েছে ত্যাগী, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ, দেশপ্রেমিক, জনদরদি একজন রাজনৈতিক নেতাকে। বাংলাদেশ হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত, প্রগতিশীল, গণমুখী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে।

লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট