চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

জন্মাষ্টমী : পুণ্যপ্রভু পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব উৎসব

তাপস কুমার নন্দী

২৩ আগস্ট, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন হিন্দু ধর্মানুসারীদের আরাধ্য একজন দেবতা। তিনি ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতাররূপে খ্যাত। কখনো কখনো তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বর অভিধায় ভূষিত করা হয় এবং হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতার প্রবর্তক হিসাবে মান্য করা হয়। হিন্দু বর্ষপঞ্জী অনুসারে প্রতিবছর ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী (জন্মাষ্টমী) তিথিতে তাঁর জন্মোৎসব পালন করা হয়। বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী, তিনি ধর্মরাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দানকারী একজন প্রাচীন ভারতীয় রাজপুত্র ও রাজা। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর পূর্বযুগেপ্রচলিত কৃষ্ণধর্ম প্রাচীন বৈদিক ধর্মজ হয়েও খ্রিস্টীয় যুগের শুরু থেকেই ভক্তিবাদের মায়াবী চেতনায় “ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকারী” হয়ে উঠেছেন উপাস্য অবতার। ভিন্নধর্মের লোকেরা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষ্ণের পূজা করে থাকে। বেদ কিংবা উপনিষদে কৃষ্ণ নামের উল্লেখ পাওয়া যায় না, কারণ কৃষ্ণের জন্ম অনেক পরে। একাধিক বৈষ্ণব সম্প্রদায় তাঁকে বিষ্ণুর অবতাররূপে গণ্য করেন; অন্যদিকে কৃষ্ণধর্মেও অন্যান্য সম্প্রদায়গুলিতে তাঁকে স্বয়ং ভগবান মর্যাদা দেওয়া হয়।

কৃষ্ণ শব্দের অর্থ কালো বাঘ ননীল। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রে, অনেকেই কৃষ্ণ শব্দটি সর্বাকর্ষক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে করেন । ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণকে প্রায়শই বংশী-বাদনরত এক কিশোরের রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আবার ভগবদ্গীতায়, তিনি এক পথপ্রদর্শক এবং সহায়ক তরুণ রাজপুত্র। সমগ্র মহাভারত কাব্যে, তিনি একজন কূটনীতিজ্ঞ হিসাবে পা-ব পক্ষে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথের সারথি রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন।
চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই বাসুদেব, কৃষ্ণ ও গোপাল প্রভৃতি কৃষ্ণের নানারূপের পূজাকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতেই দক্ষিণ ভারতে কৃষ্ণভক্তি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উত্তর ভারতে কৃষ্ণধর্ম সম্প্রদায়গুলি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় মোটামুটি একাদশ শতাব্দী নাগাদ। দশম শতাব্দী থেকেই ভক্তি আন্দোলনের ক্রমবিস্তারের ফলে কৃষ্ণ শিল্পকলার এক মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠেন। ওড়িশায় জগন্নাথ, মহারাষ্ট্রে বিঠোবা, রাজস্থানে শ্রীনাথজি প্রভৃতি কৃষ্ণের রূপগুলিকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ভক্তি সংস্কৃতি ও বিকাশ লাভ করে। তার দার্শনিক জ্ঞান ও আদর্শের উপর নজরদারি করলে সহজেই বুঝতে পারা যায় তিনি একজন স্বয়ং ভগবানের অবতার । তাই সনাতনী সম্প্রদায়ের কাছে চিরকালীন বিশ^াস ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং”।
সচ্চিদানন্দ শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিনী নক্ষত্রে ভোজ বংশীয় রাজা উগ্রসেনের পুত্র কংসের কারাগারে দৈবকীর কোলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শাস্ত্রে দেখা যায়, এই আবির্ভাব ছিল বসুদেব-দৈবকীর প্রতি ভগবানের তৃতীয়বারের প্রতিজ্ঞা পালন। অষ্টমী তিথিতে দৈবকীর অষ্টম গর্ভে জন্ম নিয়েছিল বলে এই জন্মতিথির নাম ‘জন্মাষ্টমী’ তিথি। আর এ উপলক্ষে যে আয়োজন বা উৎসব তার নাম ‘জন্মষ্টমী উৎসব’।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাতা ও পিতা ছিলেন বসুদেব ও দৈবকী। যদু বংশীর শুর সেনের পুত্র বসুদেব। বসুদেবের সাথে বিয়ে হয়েছিল দৈবকীর। বিদর্ভরাজ আহ্বকের দুই পুত্র ছিল দেবক ও উগ্রসেন। দৈবকী ছিল দেবকের সাত কন্যার মধ্যে একজন। আর উগ্রসেনের পুত্র ছিলেন কংস। কংস ও দৈবকীর সম্পর্ক ছিল ভাই বোনের। বোন দৈবকীর যখন বিয়ে হতে চলছিল তখন কংস খুবই আনন্দিত হয়েছিল। এমন কি নিজে রথের সারথী হয়ে বসুদেব দৈবকীর রথ চালিয়ে যাচ্ছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কংস এই আনন্দঘন শুভ মুহূর্তে হঠাৎ দৈববাণী শুনল – “হে কংস, তুমি যে বোনের বিবাহে এত আনন্দিত, সেই বোন দৈবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্র তোমাকে বধ করবে।” এই দৈববাণী শুনা মাত্রই কংস রথ থামিয়ে তরবারি নিষ্কোষিত করে। সদ্য বিবাহিতা বোন দৈবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। নববর বসুদেব দৈবকীকে রক্ষা করার জন্য কংসের কাছে বহু আকুতি মিনতি করলেন। কোন কিছুতেই যখন কংসকে শান্ত করা গেল না, তখন বসুদেব এখন ভীষণ প্রতিজ্ঞা করলেন, “জন্মের পরই তাদের প্রতিটি সন্তানকেই কংসের হাতে তুলে দেয়া হবে এবং প্রতিটি সন্তানকে নিজ হাতে কংস হত্যা করতে পারবে।” জন্মমাত্রই যদি হত্যা করা হয় তখন তো আর শিশু সন্তানের হাতে নিহত হতে হবে না। তাছাড়া কংস জানত, বসুদেব ছিলেন অত্যন্ত সত্যবাদী ও প্রতিজ্ঞা রক্ষায় অটল।
এরপর বসুদেব ও দৈবকীকে কারারুদ্ধ করা হল এবং এক এক করে দৈবকীর সাতটি সন্তানকে কংস নিজ হাতে হত্যা করল। এদিকে কংসের অত্যাচারের মাত্রাও দিন দিন বাড়তে শুরু করল। কংসের অত্যাচারে যদু বংশের অনেক নারী পুরুষ অন্য জায়গা আশ্রয় নিতে লাগল। সেভাবে এক নারী রোহিনীও আশ্রয় নিয়েছিলেন নন্দরাজ গৃহে। এবারে অষ্টম গর্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নেবে, কংস স্বভাবতই অধিকতর সতর্ক ছিলেন। চারিদিকে প্রহরা বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। এদিকে বসুদেব মুক্তি কামনায় ভগবৎ ধ্যানে মগ্ন। বসুদেব মন থেকে ভগবৎ সত্তা সঞ্চারিত করলেন দৈবকীর হৃদয়ে। তবুও দৈবকীর হৃদয়ে গভীর বিষাদের ও আতংকের ছায়া থাকায় মেঘে ঢাকা সূর্যের মতো তার মুখশ্রী কিছুটা মলিন ছিল। তবুও অন্তরে ছিল আশা ও আশ্বাসের ভরপুর। কংস ও সর্বদা উৎকর্ণ ছিল – “কখন নবজাতের কান্না শোন যায়।”

ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমীর মধ্যরাত। সন্ধ্যা থেকে প্রকৃতি আস্তে আস্তে দুর্যোগময় হয়ে উঠতে লাগল। বাইরে প্রবল ঝড়, জল, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎপাত হচ্ছে। এই মহাদুর্যোগ সময়ে দৈবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভূমিষ্ট হল। অপরদিকে একই সময়ে বিরাট নগরে নন্দপত্নী যশোদার গর্ভে জন্ম নিলেন মহামায়া। নবজাতক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জ্যোর্তিময় রূপ দেখে বসুদেব ও দৈবকী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তখন হঠাৎ দৈববাণী শোনা গেল “পুত্রং দত্তা যশোদায়ৈ কন্যাং তস্যা সমানয়”। বসুদেব ঐ দৈববাণী শুনে নবজাত পুত্রকে কোলে নিয়ে বদ্ধ কারাগারের দিকে তাকাতেই কারাগার উন্মুক্ত হয়ে গেল। প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে বসুদেব পুত্রকে মাথায় করে গোকুলে নন্দালয়ে যাবার জন্য যমুনা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন। ভগবানের অশেষ কৃপায় সবাই তখন গভীর ঘুুমে অচৈতন্য ছিলেন। অনন্ত নাগ ফনা বিস্তার করে শিশু কৃষ্ণকে বৃষ্টি থেকে আচ্ছাদন দিলেন।
উত্তাল তরঙ্গায়িত যমুনা, কি করে পার হবেন বসুদেব ভাবছেন। এমনসময় দেখা গেল এক শৃগালী অনায়াসে হেঁটে যমুনা পার হয়ে গেল। তা দেখে বসুদেব অনুপ্রাণিত হলেন এবং নামলেন যমুনার জলে। যমুনার জলও ফাঁক হয়ে বসুদেবকে যাত্রা পথ সুগম করে দিল। বসুদেব অনায়াসে যমুনা পার হয়ে নন্দালয়ে গিয়ে দেখেন অচৈতন্য যশোধার পার্শ্বে এক নবজাত কন্যা সন্তান। তিনি অতি সন্তর্পণে আপন পুত্রকে যশোদার কাছে রেখে তার কন্যাটিকে নিয়ে মথুরায় কংসের কারাগারে চলে এলেন। তখন রাত্রি প্রায় প্রভাত। নবজাতকের কান্নায় প্রহরীসহ কংসের ঘুম ভেঙ্গে গেল। তৎক্ষণাৎকংস কারাগৃহে এসে দেখলেন, তার বোন দৈবকীর কোলে পুত্রের পরিবর্তে কন্যা সন্তান। কংস দৈবকীর কোল থেকে কন্যা মহামায়াকে কেড়ে নিয়ে সজোরে শিলাখ-ে আছাড় দিলেন। কিন্তু কন্যাটি শিলাখ-ে না লেগে শূন্যলোকে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। এসময় কংস দৈববাণী শুনল — “তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে”। অর্থাৎ তোমাকে যে বধ করবে, গোকুলে সে বড় হচ্ছে। এভাবে বহু দিন বহু বছর কেটে যায়। মৃত্যুভয়ে ভীত নিদারুণ দুশ্চিন্তায় কংস তার মন্ত্রী ও পার্ষদদের পরামর্শে সমগ্র মথুরা ও গোকুলে শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য বিভিন্ন প্রকারে অসুর ও রাক্ষসকে পাঠাতে শুরু করে দিল। কিন্তু প্রেরিত সকল অসুর ও রাক্ষস কৃষ্ণের হাতে নিহত হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ধনুযজ্ঞের আয়োজন করে শ্রীকৃষ্ণ ওবলরামকে আমন্ত্রণ করে মথুরায় নিয়ে আসা হলো – উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণকে হত্যা করার। আর সেই ধনুযজ্ঞের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসকে হত্যা করে ধরণীকে অসুরভার মুক্ত করেছিলেন।
জন্মাষ্টমী উৎসব আমাদের সকলকে উৎসবমুখী করুক। এ পুণ্য তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের চিরায়ত প্রেম মাধুর্যে ¯œাত আমাদের চিত্ত অসৎ নিরোধী পরাক্রমে আন্তরক্ষার উদ্দীপনায় নতুন চেতনার দিগন্ত নব জন্মলাভ করুক। শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী হোক আমাদের সনাতনী সম্প্রদায়ের নবপ্রজন্মের চিরায়ত জন্ম মহোৎসব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট