চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ওয়াসার নাগরিকবান্ধব পদক্ষেপ চাই

১৮ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ

সেবার মান না বাড়িয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃক এক লাফে ৬২ শতাংশ পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে বিস্তর বিতর্কের সুযোগ আছে। কোনো ধরনের নাগরিক মতামত কিংবা গণশুনানী ছাড়াই হঠাৎ কেনো পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হলো, আবার তাও এক লাফে প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তার ব্যাখ্যা দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করলো না ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। যেখানে ওয়াসাকে সত্যিকারের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জোরালো নাগরিক দাবি আছে, যেখানে ‘গড় বিল পদ্ধতি’র নামে ৩৮% গ্রাহকের কাছ থেকে ৫ গুণ বেশি বিল আদায় করার বিষয়টি উঠে এসেছে সংস্থাটির অর্থবিভাগের প্রতিবেদনে, আছে মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পানি না পাওয়া এবং ভাউজার বাণিজ্য ও সিস্টেম লসের নামে লুঠপাটের নানা অভিযোগও; কর্তৃপক্ষ সেসব সমাধানে মনোযোগ না দিয়ে কেনো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যুক্তিহীন পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হলো তা বোধগম্য নয়।
ওয়াসা আইন, ১৯৯৬-এর ২২ ধারা অনুযায়ী প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ওয়াসা বোর্ড। সে অনুযায়ী প্রতিবছরই ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়ায় ওয়াসা। কিন্তু ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে নিয়ম ভাঙে সেবা সংস্থাটি। দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ১৬ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়ানো হয়। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল ওয়াসা। বছরে দু’বার পানির দাম বাড়ানোর কোনো নিয়ম না থাকলেও ৬ মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ওয়াসা। তাও গড়ে প্রায় ৬২ শতাংশ। আবার ওয়াসা বোর্ডও তাতে অনুমোদন দিয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডসভা আবাসিক সংযোগে প্রতি ইউনিট পানির দাম ৯ টাকা ৯২ পয়সার স্থলে ১৬ টাকা ও বাণিজ্যিকে ২৭ টাকা ৫৬ পয়সার স্থলে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে তা কার্যকর করা হবে।
দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে ওয়াসার চেয়ারম্যান বলেছেন, আগে ভূ-গর্ভস্থ পানি বেশি উত্তোলন করত ওয়াসা। এখন ভূ-উপরিস্থ পানির দিকে ঝুঁকছে। ভূ-উপরিস্থ পানি আলাদাভাবে শোধন করা হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। তাই পানির প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের সামঞ্জস্য রেখে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তার মতে, সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম পানির দাম বাড়ানো যায় কিনা খতিয়ে দেখতে বলেছেন। এজন্য উৎপাদন ব্যয় অনুযায়ী দাম রাখার প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগগুলো তদন্ত সাপেক্ষে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া হলে, সিস্টেম লস ও লিকেজের কারণে ওয়াসা যে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, সেদিকে নজর দিলে অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না বলে মনে করে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংস্থাটির মতে, যেসব কারণে ওয়াসা লোকসান দিচ্ছে সেসব কারণ অপনোদনে মনোযোগ না দিয়ে ওয়াসা দাম বাড়িয়ে গ্রাহকের ঘাড়ে বোঝা তুলে দিচ্ছে। অন্যান্য নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্যও তাই।
আমাদেরও মনে হচ্ছে, লোকসানের কারণগুলো চিহ্নিত করে কঠোর সমাধান উদ্যোগ নিলে পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে একই বছরে দ্বিতীয় বারের মতো এক লাফে প্রায় ৬২ শতাংশ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রাহকের স্বার্থবিরোধী। এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার আগে মন্ত্রণায়য়ের উচিত হবে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া। একইসঙ্গে গত ২৫মে ওয়াসার ৫১তম বোর্ড সভায় সংস্থাটির অর্থ বিভাগ ২৭ হাজার গ্রাহক ৫ গুণ বেশি বিল দেয়া সংক্রান্ত যে প্রতিবেদন পেশ করেছে, সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হলো, বেশি বিল নেয়া এখনো অব্যাহত আছে কি না, আদায়কৃত বেশি বিল ফেরত দেয়া হবে কি না, সে বিষয়েও ওয়াসার সুস্পষ্ট বিবৃতি দেয়া দরকার। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের লুকোচুরি সেবা সংস্থাটিকে বিতর্কিত করে তুলবে। জানা গেছে, ‘সিস্টেম লস’ কমানো এবং ‘রাজস্ব আয়’ বাড়ানোর জন্যেই মূলত ‘গড় বিল পদ্ধতি’র নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে এভাবে বাড়তি বিল আদায় করে যাচ্ছে সেবা সংস্থাটি। আইন এবং নৈতিকতার মাপকাটিতে বিষয়টি সিদ্ধ নয়। তারপরও কেনো এমনটি করা হলো তা জানা, একইসঙ্গে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই নাগরিকসাধারণের আছে। বিল পরিশোধ করেও পানি না পাওয়া, ভাউজার বাণিজ্য, পাইপ ফেটে পানির অপচয়, মিটার না দেখে ভুয়া বিল করা, অকারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারসহ অন্যান্য বিষয়েরও সুনিষ্পত্তি দরকার।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট