চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : আইনজীবী বদরুল হক খান

অধ্যাপক কামরুল আনোয়ার চৌধুরী

১৮ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলার রামগড় ফটিকছড়ি থেকে কক্সবাজার, চকরিয়া-টেকনাফ পর্যন্ত জনগণের উকিল হিসাবে যার নাম সর্বপ্রথম বিবেচনা করতো তিনি হচ্ছেন এডভোকেট বদরুল হক খান। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান আলহাজ¦ বদরুল হক খান ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার আইনজীবী সমিতির একজন প্রতিথযশা আইনজীবী। তিনি ছিলেন ফৌজদারী আইনের বিশেষজ্ঞ। বৃটিশ আমলে ১৯১৯ সনে তিনি আইন পেশায় যোগদান করেন। বৃটিশের স্বর্ণযুগ ১৯৩০ সন থেকে পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সন পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামের সরকারী উকিল বা পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন। তিনি সরকারী উকিল হলেও সরকারের সব মামলা সমর্থন করতেন না। যেখানে দেখতেন সরকারী কর্মচারী অথবা পুলিশের সাজানো মামলা নিয়ে এসেছে, তখনই তিনি তা নাকচ করে দিতেন। যাঁর ফলে অনেক সময় নির্দোষ নাগরিকেরা সরকারী অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে যেতো। তবে যে মামলা তিনি করতেন সে মামলায় আসামীর রক্ষা ছিল না।
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে বি এ পাশ করে তিনি কলিকাতা যান আইন পড়তে। কলিকাতা বিশ^বিদ্যালয়ে বি এল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন সেই বৃটিশ আমলে। এরপর তিনি সরকারের মুন্সেফ নিযুক্ত হন। পরে তিনি আইন পেশায় যোগদান করেন। আইন ব্যবসায়ে তিনি বৃটিশ বাংলা ও পাকিস্তানের যে কত সেবা করে গিয়েছেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। তার সবচেয়ে বড় অবদান গরীব মক্কেলদের সেবা। যে জ্ঞান-মেধা তাঁর ছিল তাতে তিনি মামলায় যে কোন ফিস আদায় করতে পারতেন, কিন্তু তিনি জানতেন যে আমাদের দেশের লোক গরীব। সামান্য ফিস নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে কিছু না নিয়েই তিনি মামলা করে যেতেন। মামলা করাই ছিল তার জীবনের আদর্শ। চতুর মক্কেলরা এর সুযোগ নিত। যার ফলে হাজার হাজার মামলা করার পরও জনাব বদরুল হক খান কোনদিন বিত্তশালী হননি। অর্থের জন্য বৃটিশ আমলের সরকারী উকিল জনাব বদরুল হক খানের দুঃখ ছিল না। তাঁর ছিল অফুরন্ত কর্মশক্তি। তাঁর ধীশক্তির, যোগ্যতার স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন। এই অঞ্চলের দুই আইনের দিকপাল থেকে। এদের একজন হচ্ছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অন্যজন বৃটিশ বাংলা প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী খুবই সম্মান করতেন বদরুল হক খানকে। শেরে বাংলা ফজলুল হক তাঁকে আইনজীবী বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করে ডাকতেন। ১৯৫২ সনে চট্টগ্রামের সেই চাঞ্চল্যকর ফৌজদারী মামলা সেই মামলার ইলেক্ট্রিসিটি বিভাগের একজন প্রবীণ প্রকৌশলী ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ অভিযুক্ত ছিলেন। অভিযুক্তদের আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসামী পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছিলেন। উক্ত মামলায় জনাব বদরুল হক খান ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে। কৃতিত্বের সাথে তিনি আসামীদের কৌঁসুলী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিপক্ষ হিসেবে মামলা পরিচালনা করেন।
বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে সেশন মামলা তিনি কৃতিত্বের সাথে রাষ্ট্রের পক্ষে পরিচালনা করতেন। একজন পাবলিক প্রসিকিউটর হিসাবে তাঁর যোগ্য রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনের উদাহরণ চট্টগ্রাম বার সমিতির সদস্যদের নিকট চিরজাগ্রত আছে। ১৯৫৭ সনে পটিয়া থানাধীন অঞ্চলে স্থানীয় কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় হযরত আজিজুল হক শেরে বাংলার (রহ.) উপর এক আক্রমণ হয়। এতে একজন নিহত হয়। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় আগুন দেওয়া হয়। পটিয়া মাদ্রাসা পুড়িয়ে দেওয়া ও হত্যাকা- ঘটানো তথাকথিত আত্মঘাতি বানোয়াট ও ঘটনার সূত্র ধরে হযরত শেরেবাংলা’র (রহ.) বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ইতিহাসে তা ওয়াহাবী-সুন্নি দাঙ্গা নামে পরিচিত। হযরত শেরে বাংলার (রহ.) পক্ষে উকিল ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট বদরুল হক খান। তিনি সুন্নি আকিদার লোক ছিলেন। হুজুরের জন্য যথেষ্ট কষ্ট স্বীকার করেছেন। সম্পূর্ণ পাকিস্তানের বিচার বিভাগের উপর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট বদরুল হক খানের বিশেষ কমান্ড ও কন্ট্রোল থাকায় কুচক্রীদের পক্ষে কোন মুসলমান আইনজীবী এই মামলা গ্রহণ করে নাই।
অপর পক্ষের উকিল ছিলেন বাবু কৃষ্ট নন্দী। ১৯৬৫ সনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট বদরুল হক খানের নেতৃত্ব হযরত আজিজুল হক শেরে বাংলা এই মামলায় জয় লাভ করেন। নয় বছর ব্যাপী এই মামলায় হযরত আজিজুল হক শেরে বাংলা ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট বদরুল হক খানকে সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন পটিয়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি চকরিয়া অঞ্চলের হাজার হাজার আলেম ওলেমাগণ এবং পাকিস্তানের সাবেক স্পীকার ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী। পাকিস্তানী জজ রায়ে তথাকথিত ঘটনা ও মামলাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্য প্রণোদিত বানোয়াট বলে উল্লেখ পূর্বক হযরত শেরে বাংলা (রহ.) কে সসম্মানে নির্দোষ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই মামলার জন্য বারবার নির্দিষ্ট সময়ে কোটে হাজিরা দিতে গিয়ে হযরত শেরে বাংলা (রহ.) ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট বদরুল হক খানকে অমানুষিক পরিশ্রমের শিকার হতে হয়। হাজার হাজার মামলা পরিচালনা কালে ঘটনার মধ্যে থেকে সত্যকে বের করে আনার অদ্ভুত রকমের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল তাঁর। এই উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্য চট্টগ্রাম জেলার (সাবেক কক্সবাজার মহকুমা পর্যন্ত) ঘরে ঘরে তার নাম সুপরিচিত। বিশাল অভিজ্ঞতার কারণে কাগজপত্র দেখতে হত না। মক্কেলের কথা শুনে বুঝে নিতেন কি করতে হবে। বইপত্র পড়ত না বলে আমরা মনে করতাম হাইকোর্টের নতুন নতুন রুলিং দিয়ে তাঁকে ঘায়েল করব। পরের দেখা ঐ রুলিংগুলি তিনি আগেই দেখে নিয়েছেন। এর বিপরীতে কি দেখাতে হবে তার জন্যও তিনি তৈরী আছেন।
পাকিস্তান আমলে ্ বদরুল হক খান সাহেবের সহযোগী ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কী বলেন, আমি ও বদরুল হক খান চট্টগ্রাম ‘ল’ কলেজে শিক্ষকতা করতাম তিনি ক্লাসে কি পড়াত তা আমি কোনদিনই বুঝতে পারি নাই। কোন সিলেবাসের বালাই নেই। ক্লাসে কোন বই নেওয়া নেই। কেবল হাজিরা খাতাটা নিয়ে ক্লাসে গেলেন। তারপর বলতে থাকলে কাহিনীর পর কাহিনী। ছাত্ররা মন দিয়ে শুনছে। যখন ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করতাম কি পড়িয়েছেন, ছাত্ররা উত্তর দিতো, ভালো পড়িয়েছেন। পরে বুঝেছিলাম তিনি কখনো আইনটাকে প্রথমে তুলে ধরতেন না। একটা মামলার কাহিনী বলতেন ও সেই মামলায় যেই আইনগুলি প্রয়োগ করা গেল তা বলতেন। যার ফলে আইনের ব্যাখ্যা ছাত্রদের কাছে সহজ হয়ে আসতো। ছাত্ররাও খান সাহেবের ক্লাসে আগ্রহ নিয়ে হাজির হতো। তিনি যখন আদালতে যুক্তি তর্ক শুরু করতেন তখন আদালত ভবনে আইনজীবী ও জনগণের ব্যাপক সমাগম হত এবং উপস্থিত সবাই মোহাবিষ্ট হত। ইংরেজী ভাষার উপর তাঁর দখল শুধু বিস্ময়কর নয়, অবিশ^াস্য রকমের বিস্ময়কর। চট্টগ্রামে আইন কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি ঐ কলেজের সহ-অধ্যক্ষ ছিলেন বহু বছর। মুসলমানের ভাগ্য উন্নয়নের চিন্তা জনাব বদরুল হক খানের মুসলিম মানসে ক্রিয়াশীল ছিল। তাই তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি সক্রিয়ভাবে সমর্থন করতেন।
১৯৪৭ সনে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় তিনি ছিলেন সরকারী উকিল। লাখ লাখ হিন্দু চট্টগ্রাম ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। অনেকে দেশত্যাগী হিন্দুদের বাড়ীঘর জমিজমা দখল করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি কারো কথায় কর্ণপাত করেন নি। জনাব বদরুল হক খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন সুদীর্ঘকাল। মুসলিমলীগের টিকেটে পটিয়া, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। খান সাহেবের হাজার হাজার মামলা পরিচালনা ছিল কুৎসিতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের।
তিনি রেখে গেছেন দার্শনিকতা সমৃদ্ধ হাজার হাজার মামলা পরিচালনার ইতিহাস। যা মেধায়, প্রজ্ঞায়, বিচক্ষণতায়, আইনের ব্যাখ্যায় আমাদের মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত। শুধু যুক্তি তর্কই নয়, বলিষ্ঠ ভাষা ও তার পা-িত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাদের আইনের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
হাজার হাজার মামলা পরিচালনার প্রভাবে সমগ্র বৃটিশ বাংলা ও পাকিস্তানে খান সাহেবের সৃষ্টি হয়েছিল হাজার হাজার ভক্তম-লী। এ সমস্ত ভক্তম-লীর নিকট তিনি কিংবদন্তির নায়ক ধর্মবীর, কর্মবীর বটবৃক্ষ ও চৌকষময় আইনজীবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা সাবেক কক্সবাজার মহকুমাসহ প্রত্যেক থানার শতশত ইউনিয়নের হাজার হাজার গ্রামের মানুষের কল্পনায় তিনি সব সময় সর্বাবস্থায় হিরো হয়েই ছিলেন। গ্রামের নিরক্ষর কৃষকদের খান সাহেব ছিলেন মুরব্বী ও বটবৃক্ষ। আদালতে মামলা পরিচালনা করেছেন চৌকষ ইংরেজীতে। পুরো আদালতে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত তার মেধা, প্রজ্ঞা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার দিকে। কৃষক শ্রমিক আইনজীবী ও লোকে লোকারণ্য তাঁর মামলা স্থলে বিরাজ করত পিনপতন নীরবতা। অসাধারণ যোগ্যতার প্রভাবে মেধা প্রতিভার কারণে, যদি কলকাতায় আইন ব্যবসা করতেন, বৃটিশ ভারতেও প্রতিষ্ঠা লাভ করা তার জন্য কঠিন ছিল না। হতে পারতেন শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, প-িত জহরলাল নেহেরু ও কায়েদে আযম জিন্নাহর মতো আইন জগতের স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৩০ সন থেকে ১৯৬১ সন পর্যন্ত বৃটিশ ও পাকিস্তানি আমলের সরকারি উকিল হিসেবে শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিরুদ্ধেও অনেক অনেক মামলা পরিচালনা করেন তিনি।
খান সাহেব পার্লামেন্টে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভাইস এডমিরাল এ আর খানের নিকট জানতে চান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানী অফিসারের সংখ্যা কত। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জবাবে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানীরা বেঁটে/খাটো হওয়াতে, এবং ইংরেজীতে দক্ষতা কম থাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে খুব কম থাকায় পূর্ব পাকিস্তানি অফিসার হিসাবে আছেন। খান সাহেব পাকিস্তান পার্লামেন্টে পাকিস্তানের সংস্থাপন মন্ত্রী জেনারেল হাবিব উল্লা খানের নিকট জানতে চান সি.এস.পি সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা কত? পাকিস্তানের সংস্থাপন মন্ত্রী জবাবে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে সি.এস.পি হওয়ার জন্য উপযুক্ত লোক পাওয়া যায় না। খান সাহেব তাঁর ভাষণে বলেন, বৃটিশ বাংলার হিন্দু নেতারা বাঙালি মুসলমানদের বড় বড় চাকরি থেকে বঞ্চিত করত যোগ্যতাহীনতার অভিযোগ আনয়ন করে। একই ধারা যদি পাকিস্তানেও অব্যাহত থাকে তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের পাকিস্তানি হয়ে কি লাভ?
পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে লাখ লাখ বিহারিদের চাকুরির সুযোগ করে দেওয়ায় বিরুদ্ধে তিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট