চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

১৭ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

১১ আগস্ট ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদের ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৭৭ সালের এই দিনে সামরিকজান্তা স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান বিচারের নামে প্রহসন করে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ঢাকা সেনানিবাসে নির্মমভাবে হত্যা করে। বাঁশখালীর অজপাড়া গাঁয়ের লালজীবন গ্রামে ১৯৪০ সালের ১৫ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এই বীরের জন্ম। ছোটবেলা থেকে দুঃসাহসী ও সংগ্রামী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ।
পুইছড়ি ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথমে দাখিল পাশ করেন পরে ইজ্জতিয়া স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হন কিছুদিন পরে চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাশ করেন। এরপরে আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার খ্যাত চট্টগ্রাম সিটি কলেজে (বর্তমান সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ) ভর্তি হন এবং ছাত্রসংসদের জিএস নির্বাচিত হন। সেই সময় কারাঅভ্যন্তরীণ থাকা অবস্থায় কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী পাশ করেন। তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী ছাত্রনেতা। অনলবর্ষী বক্তা সৈয়দ আহমদ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক নিবেদিতপ্রাণ, চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন)। ’৬৯ এর গণআন্দোলনে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন তিনি। সে সময় অনেক দুঃসাহসিকতার সাথে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও যুবসমাজকে সংগঠিত করে তোলেন। তিনি ইয়াহিয়া সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন দুর্বার আন্দোলন সংগ্রাম। ’৭১এর ৭মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম” “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন ঘুমন্ত কুম্ভকর্ণ বাঙালীকে জাগ্রত করতে মৌলভী সৈয়দ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। শুরু হল তাঁর সংগ্রামী জীবন দীর্ঘ ৯মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হল মহান স্বাধীনতা। মৌলভী সৈয়দ দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশগড়ার সংগ্রামে নেমে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাকশাল ঘোষণা হওয়ার পর মৌলভী সৈয়দ চট্টগ্রাম জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় তিনি বাকশাল চট্টগ্রাম জেলার যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর মৌলভী সৈয়দ প্রতিবাদের ঝড় তুললেন সমগ্র দেশ জুড়ে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় ভা-ার মার্কেটে গড়ে তোলেন বিশাল কর্মীবাহিনী। ১৯৭৬ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থানকালে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দেন। ঐ সময় চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা শিরোনামে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলার প্রধান আসামী ছিলেন মৌলভী সৈয়দ, চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী। রাষ্ট্রদ্রোহীতা হিসেবে চিহ্নিত এ মামলার বেশির ভাগ আসামী ছিলেন আওয়ামীলীগ ও মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ। ’৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণ আন্দোলন, ’৭০ এর নির্বাচন, ’৭১ এর মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদকে যাঁরা হত্যা করেছে তারা নিজেদের কোনদিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এ দেশে হত্যার রাজনীতি শুরু হয়েছিল।
’৭১ এবং ’৭৫ এর খুনীদের পুরস্কৃত করেছিল জিয়াউর রহমান। রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম, কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুজাহিদ সহ অনেককে। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার মন্ত্রীপরিষদে স্থান পেয়েছিল যুদ্ধাপরাধীরা। এটা ছিল জাতির জন্য একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়। মৌলভী সৈয়দ বেঁচে থাকলে এই দুঃশাসনের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেওয়া হতো। প্রতি বছর ১১ আগস্ট আসলে আমরা এই বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি অথচ সারা বছর আমরা তাঁর পরিবারের কোন খোঁজখবর রাখি না। অনেকে বলে থাকেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে কোন প্রতিবাদ, আন্দোলন সংগ্রাম হয়নি এটা মিথ্যা কথা। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ তার জীবন দিয়ে এটাই প্রমাণ করেছেন কোন অন্যায় অত্যাচার জুলুম নির্যাতন বঙ্গবন্ধুর সৈনিকেরা মাথা পেতে নিতে পারে না। সংগ্রামের মাধ্যমে যে সংগঠনের জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একমাত্র শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে এ দেশে আর কোন দিন ’৭১ ও ’৭৫ এর খুনীরা মাথা উচুঁ করে দাঁড়াতে পারবে না।
শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ আমাদের প্রেরণার উৎস। ওনার আত্মা তখনই শান্তি পাবে যখন দেশ থেকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, দুর্নীতি, মাদকাশক্তি, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, স্বজনপ্রীতি চিরতরে বন্ধ হবে। মৌলভী সৈয়দ আমাদের মাঝে আর কোন দিন ফিরে আসবেন না। আমরা যদি তাঁর নীতি-আদর্শ অনুসরণ করে চলি তাহলে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বপ্ন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতির পিতার কন্যা বাংলাদেশের ৪ বারের সফল প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউম্যানিটি জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। জাতির পিতার রক্তের ঋণ যে বীর তার জীবন দিয়ে শোধ করে গেছেন জাতি আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে তাঁকে। আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা।

লেখক: শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট