চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী

১৬ আগস্ট, ২০১৯ | ১২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে কেউ মানবসমাজের ইতিহাসের অবিসংবাদিত একটি শব্দ হয়ে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। কেউবা ইতিহাসের উজ্জ্বল একটি বাক্য হয়েছে। কেউ আবার ইতিহাসের একটি অধ্যায় হয়ে ইতিহাসের প্রয়োজনে মানুষের জন্য আলো ছড়াচ্ছে। এমনি করেই কারও প্রজ্জ্বলিত আলোকবর্তিকা সময়কে অতিক্রম করে মহাকালের মহিমান্বিত অসীমতাকে স্পর্শ করেছে। তিনি ব্যক্তি গোষ্ঠি, অঞ্চল ও আঞ্চলিকতা ছাপিয়ে একক থেকে সমগ্রতায় পরিণত হয়েছেন। কালের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্তকালের মহানায়কে পরিণত হয়েছেন। পর্যবসিত হয়েছেন একক থেকে সমগ্রতায়। বিশেষ্য থেকে মহিমান্বিত বিশেষণে। ইতিহাসের পাতা থেকে সমগ্র ইতিহাসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি শোষিত বাঙালি জাতিগোষ্ঠির সমগ্র ইতিহাস। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। জাতীয়তাবোধের, জাতিসত্তার, জাতিগোষ্ঠির, জাতিসমগ্রতায় অনন্তকালের মহানায়ক তিনি। বাঙালি জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক, জাতীয়তাবাদী ও ভূখন্ডগত মুক্তির মহানায়ক। শোষিত, নিপীড়িত, রাজনীতি ও অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতিসত্তার মুক্তির অভূতপূর্ব ও আপোষহীন নেতা-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রত্যয়দীপ্ত ও সীমাহীন প্রত্যাশার স্বপ্নময় যাদুকর। হাজার বছরের যে বাঙালি ভাতের কাঙ্গাল হয়ে কখনো বিচ্ছিন্ন-বিপর্যস্ত, কখনও বিভ্রান্ত, উৎকণ্ঠিত কখনও জাতিসত্তার উদ্বিগ্ন অন্বেষণে উদভ্রান্ত, কিন্তু নাছোড়- সেই বাঙ্গালির মুক্তিদূত, নিজ আবাসভূমের স্থপতি-কারিগর শেখ মুজিবুর রহমান। প্রায় তিন দশকের অবিরল, অক্লান্ত, অকুতোভয় এবং নিবিঢ় ও একাগ্রতার শ্রমসাধনায় পূর্ব-বাংলার বাঙালি জাতিসত্তার রক্তস্রোতে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া কর্মি মুজিব তিল তিল করে নিজেকে খাঁটি বাঙালি করে গড়ে তুলেছেন আপন তুলিতে। বাঙালির হৃদস্পন্দনকে স্বীয় জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, দু:খ-কষ্ট, শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মিলিয়ে নিয়ে দীর্ঘকাল পথ পরিক্রমা করেছেন অক্লান্ত -অবিশ্রান্ত -অদৃষ্টপূর্ব। বাঙালি সত্তাকে মানুষ হিসেবে দেখে তার শোষিত ও বঞ্চিত রুপকে আবিষ্কার করেছেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য পরিশ্রম করেছেন আরাম আয়েশ বিসর্জন দিয়ে। পাকিস্তান এসেছে। সঞ্চিত স্বপ্নগুলো বিদীর্ণ হতে সময় লাগেনি। আশাভঙ্গ হয়েছে, বাঙালির মুখে হাসি ফোটেনি। বাঙালির মুক্তি আসেনি। ভ্রান্ত লক্ষ্য ও তাত্ত্বিক আন্দোলনের রোমান্টিক অভিযাত্রীদের জনঅসম্পৃক্ততা দেখে হতাশ হয়েছেন। নেতৃত্বের অন্তর্মুখিতা ও অস্বচ্ছতা দেখে নিরাশ হয়েছেন, হতোদ্যম হননি। বাঙালির স্বপ্ন ও আকাঙ্খাকে অদম্য উদ্যমে অনুসন্ধান করে করে বাঙালির আশা আকাংখার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। বহুমাত্রিক অসঙ্গতিগুলো পেছনে ফেলে এগিয়েছেন বাঙালির মুক্তির অন্বেষায়। থেকেছেন উদ্বেলিত, উৎকণ্ঠিত। লোভ-লালসা, মৃত্যুভয় দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে সংস্কৃতি ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে শাণিত করেছেন। যাকিছু বাঙালির সাথে সম্পর্কযুক্ত তাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছেন। পূর্ববাংলা থেকে পূর্বপাকিস্তান নামান্তরকে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করেছেন। প্রতিবাদী হয়েছেন। বাংলা ভূখন্ড ও বাঙালির স্বার্থবিরোধী যেকোন পদক্ষেপকে মন ও প্রাণ দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এভাবে কর্মি থেকে সংগঠক, সংগঠক থেকে জাতীয়তাবাদ ও বোধে নিজেকে তিল তিল করে পোক্ত করেছেন। বাঙালি মানসকে মননে ও কর্মে ধারন করে নিজেকে দূরদর্শী ও অনিবার্য করে তুলেছেন দলে ও দলের বাইরে। ভীরুতা ও কাপুরুষতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। বাষট্টির পর থেকে মূলত বাঙালি ছাত্র-যুবক, তরুণদের ভিতর তীব্র তাড়নার সৃষ্টি করে তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদে দারুণভাবে আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছেন। ছাত্র ও যুবসমাজকে তথাকথিত আন্তর্জাতিকতাবাদের বলয় থেকে বের করে বাঙালির স্বাধীকার সচেতনতায় শাণিত করে সুসংগঠিত করেছেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর তাঁর রাজনীতি আরও শাণিত হয়েছে। চিত্তের দৃঢ়তা, সততা, বাঙালির অধিকারের প্রতি একনিষ্ঠতা ও পাকিস্তানি নব্য শোষকদের সঙ্গে আপোষহীনতা তাঁকে বাঙালি মুক্তির অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে। হয়েছেন শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু। তাঁর নির্মম উপলব্ধি- ‘২শ’ বছর ইংরেজরা বাংলাদেশকে শোষণ করেছে, তারপর ২৩ বছর যা কিছু হাড়, মাংস ছিল পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গেছে। বাঙালিদের আর শোষণ করতে দেয়া হবে না কাউকে।’
স্বাধীনতার পর বাঙালিদের প্রতি তাঁর নিবিড় ভালবাসা তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সক্সেগ সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্থিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ ১৯৬৪-৬৬ সময়কালে প্রথমে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামীলীগের সভাপতি মুজিব ছেষট্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছেন বাঙালির মুক্তিদূত হিসেবে। অসাধারণ ক্যারিশমা সম্পন্ন বাঙালির নেতা থেকে তিনি ছয় দফার আনবিক বোমা ফাটিয়ে কালোত্তীর্ণ মহানায়কে পরিণত হয়েছেন। আর এ সময়টাকে এজন্যেই বাঙালির স্বাধীনতার টার্নিং পয়েন্ট ধরা হয়। রাজনীতির কুশিলব থেকে জাতিসত্তার স্থপতিতে রূপান্তরিত হয়েছেন অসাধারণ প্রজ্ঞা, মেধা, সীমাহীন ত্যাগ, অকৃত্তিম ভালোবাসা আর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাঙালির শোষক পাকিস্তান সরকার তাঁকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের যে জালই ফেলেছে, তা বুমেরাং হয়ে জনবিষ্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। রাজনৈতিক মহানায়ক থেকে ইতিহাসের মহানায়ক। কালের মহানায়ক থেকে কালোত্তীর্ণ মহান নেতা। রাজনৈতিক সামাজিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি বাঙালির বিবেক থেকে বিশ্ববিবেকে পরিণত হয়েছেন। তাঁর জীবন দর্শন, আদর্শবোধ, বাঙালি চর্চা, বাঙালিকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা, আত্ম-পরিচয়ের মৌলিক অনিবার্যগুলো বিকশিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। বিবর্তিত হয়েছে কালের চাহিদায়।
রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি সুবিধাবাদিদের বর্জন করেছেন-প্রত্যাখ্যান করেননি। এসময়ে তিনি আন্দোলনকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তীব্রতর করেছেন। সকল প্রতিকুলতা তাঁকে শাণিত করেছে, ইস্পাত কঠিন করেছে। সর্বস্তরের মানুষকে তিনি ছয়দফা থেকে এক দফার তীব্র আন্দোলনে একীভূত করেছেন। মুক্তির এ অদম্য অভিযাত্রায় তাঁর সাথী হয়েছেন সর্বস্তরের বাঙালি। অসাধারণ প্রজ্ঞাবান খাঁটি বাঙালি এ নেতা মানুষের মাঝ থেকে মানুষের জন্য ভালোবাসা, আস্থা-ভরসা, সংগ্রহ ও সঞ্চিত করেছেন। বাঙালিকে ভালবেসে বাঙালি আশ্রিত, বাঙালি নির্ভর হয়ে বাঙালির শেখ সাহেব বঙ্গবন্ধু হওয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছেন স্বাধীনতার স্থপতি। ছাড়িয়ে গেছেন নিজের অর্জনের উচ্চতাকে। আপোষহীন প্রজ্ঞা, প্রত্যয়, সত্তা ও প্রবণতা তাঁকে সীমার মাঝে অসীম করে তুলেছে। বামদের রোমান্টিক, ত্যাগ ও শ্রম তাঁকে আলোড়িত করেছে-আকৃষ্ট করেনি। দেশপ্রেমিকরা তাঁর কাছে সবসময় ছিল শ্রদ্ধার, সম্মানের। ডান, বাম, অর্ধবাম ও দলীয় সংরক্ষণবাদীদের মতামতকে পাশে ফেলে তিনি ছয় দফাকে একদফায় পরিণত করে সবাইকে ছাড়িয়ে যে উচ্চতায় উঠে গেছেন, তা সম্ভব হয়েছে তাঁর গভীর দেশপ্রেম, আপোষহীনতা, প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক- দূরদর্শীতা ও প্রত্যয়ের কারণে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মুজিবকে প্রত্যয়দীপ্ত, সাহসী, প্রজ্ঞাবান, দক্ষ, দূরদর্শী করে জনগণের কাছে নিয়ে তাদের নেতায় পরিণত করেছে। তাঁর একক ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত সত্তরের সামরিক বাহিনী পরিবেষ্ঠিত নির্বাচনী বিজয়কে অনিবার্য করে তুলে। এখানেই মুজিব দূরদর্শী, অতুলনীয়, অবিসংবাদিত। বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠির রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন ও তাড়না তাঁকে তাড়িত করেছে সর্বক্ষণ। সকল ভ্রান্তি ও পিছুটান অগ্রাহ্য করে শুধু জনতার ভালবাসা ও প্রত্যয়কে ধারন করে তিনি জাতিকে মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তুলেন। এ ক্ষেত্রে বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সর্বস্তরের জনতা দারুণভাবে তাঁকে সমর্থন করেছে। বিশ্ব বিবেককে অবাক করে দিয়ে তিনি জাগ্রত বাঙালির চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মুসলিম বিশ^কে পাশ কাটিয়ে তাঁর অনুপস্থিত-উপস্থিত নেতৃত্ব আমাদের মুক্তির মোহনায় পৌঁছে দিয়েছে। তিনি হয়ে গেছেন বিশ্বমানবতার মুক্তির প্রতীক, শান্তির অগ্রদূত, জুলিওকুরি। ইতিহাসের অংশ থেকে সমগ্র ইতিহাস। কারও কাছে হিমালয়, কারও কাছে রাজনীতির কবি। বাঙালির কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাঙালির জাতির জনক।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের বাইগার নদীর পাড়ে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বাঙালি মনীষার এ নক্ষত্র উদ্ভাসিত হয়েছিল বিশ্বময় আলো ছড়াতে। বাবা শেখ লুৎফর রহমান। মা মহিয়সী সায়েরা খাতুন। কলকাতায় লেখাপড়া শেষ না করেই আঠার বছর বয়সে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান। চল্লিশের দশকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এভাবেই কর্মি থেকে সংগঠক এবং নেতা থেকে মহান নেতা। স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে একাত্তরের পরাজিত পক্ষের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র-সম্পৃক্ততায় এই মহাকালের মহানায়কের লৌকিক জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। নরপশুরা হত্যা করে তাঁর শিশুপুত্র এগার বছরের শেখ রাসেল, বঙ্গমাতা বেগম মুজিবসহ শেখ কামাল, শেখ জামাল ও তাঁদের সহধর্মিনীদ্বয়কে। হত্যা করে আরও অনেককে। বঙ্গবন্ধুকে শরীরিভাবে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ঐতিহ্য, অহংকার, অর্জন এবং তাঁর প্রাসঙ্গিকতাকে নি:শেষ করা যায়নি। বরং মুজিবের প্রাসঙ্গিকতা লক্ষগুণে বৃদ্ধি পেয়ে তা ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশসহ বিশে^র আনাচে কানাচে। বাংলা বলতে, বাঙালি বলতে, বাংলাদেশ বলতে মুজিবকেই বুঝায়। আজ দ্বিধাহীনচিত্তে বলা যায়, ‘বাঙালি জাতি যদি হয় একটি স্বপ্নের নাম, একটি আশা-আকাঙ্খার নাম, একটি লড়াকু সংগ্রামের নাম এবং সর্বোপরি একটি নিরঙ্কুশ সফলতার নাম, তবে তার সফল রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই বাঙালির ইতিহাসসমগ্র। তিনিই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
শোকের বেদনাক্লিষ্ট এ মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধা জানাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সকল শহীদকে। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠবাঙালি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ শেখ মুজিবকে। তাঁদের সকলের আত্নার চির শান্তি কামনা করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, কর্ণফুলি গবেষক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট