চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

থ্যালাসেমিয়া ঃ ইতিহাস ও হিমোগ্লোবিন নিয়ে কথা

প্রফেসর ডা. মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু

৩ মে, ২০১৯ | ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

থ্যালাসেমিয়া রোগ চিহ্নিতকরণ ও তার চিকিৎসার ইতিহাস সূচনা হয় ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানী থমাস কুলীর নেতৃত্বে। শিশুদের চেহারা ও আকৃতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে। সেই সময়ে রোগটি কুলী’স অ্যানিমিয়া নামে পরিচিত ছিল। থ্যালাসেমিয়া নামকরণ হয় গ্রীসে ১৯২৮ সালে। সেই সময়ই ইটালিতে এ রোগের বাহকদের বিজ্ঞানী সিলভেস্ট্রোনি নামকরণ করেন “মাইক্রোসাইটিক আ্যানিমিয়া” থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ যেহেতু হিমোগ্লোবিনের গঠনের অস্বাভাবিকতা, সুতরাং থ্যালাসেমিয়া রোগ চিহ্নিতকরণের ইতিহাসের সূচনা ধরা যেতে পারে “হিমোগ্লোবিন” আবিষ্কারের সময় থেকেই।
উনিশ শতকের দিকে বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্ভে যখন মানবদেহে রক্তসঞ্চালন পদ্ধতির ব্যাখ্যা দেন, তার পরপর, দুই’ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রবার্ট রয়েল ও রিচার্ড লোয়ান প্রমাণ করেন যে, রক্তে অক্সিজেন আছে বিধায় আমাদের দেহে ফুসফুসে রক্তের সঞ্চালন (চঁষসড়হধৎু পরৎপঁষধঃরড়হ) ঘটে। ১৮৬২ সনে বিজ্ঞানী হোপি-সেলাই সর্বপ্রথম রক্তের অক্সিজেন বহনকারী শ্বাসরঞ্জকটির বর্ণনা দেন এবং এর নামকরণ করেন হিমোগ্লোবিন। হিমোগ্লোবিন দুই অংশের বিবরণ দেওয়া হয় অনেকদিন পর।
হিমোগ্লোবিনের অংশ দুইটি হলো “হিম” ও “গ্লোবিন”। ১৯১২ সালে বিজ্ঞানী কাস্টার রক্তের “হিম” এর গঠনের ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হন। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বিজ্ঞানী স্যাঙ্গার সর্বপ্রথম প্রোটিনের ব্যাখ্যা দেন, তারপর বিজ্ঞানী ইনগ্রাম, রাইনস্মিথ, শ্লোডার পাউলিং সক্ষম হন “গ্লোবিন” প্রোটিন চার অণুর সমন্বয়ে গঠিত একটি “ ট্রেটামার” যার মধ্যে আছে আলফা (ধ) ও (ই) পলিপেপটাইড শৃঙ্খল। বিজ্ঞানী পেরুজ এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি পদ্ধতির সাহায্যে হিমোগ্লোবিনের ত্রিমাত্রিক গঠনের ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হন। ষাট দশকের আগেই ডেনমার্কের বোরো ও ক্রোম, ইংল্যান্ডের বারক্রফ্ট, হলডেন, হিল ও রাফাটন এবং আমেরিকার হেনভারসন হিমোগ্লোবিনের গঠন, কাজ ও বৈশিষ্ট্যের পরিচ্ছন্ন বর্ণনা দিতে সক্ষম হন।
১৯৭৫ সালের পর থেকে চিকিৎসা জগতে আধুনিক ডি.এন.এ বায়োটেকনোলজি ও মলিক্যুলার বায়োলজির সূত্রপাত হল “থ্যালাসেমিয়া” রোগীদের শ্রেণি বিভাগের এর ফলেই জানা সম্ভব হল এই রোগীদের প্রকারভেদ (ঞুঢ়বং) ও অস্বাভাবিকতার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। থ্যালাসেমিয়া রোগটিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়- α থ্যালাসেমিয়া ও β থ্যালাসেমিয়া। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানী জে-বি হিরেকের গবেষণালব্ধ ঐতিহাসিক রচনা “চবপঁষরধৎ ঊষড়হমধঃবফ ধহফ ঝরপশষব – ঝযধঢ়বফ জবফ ইষড়ড়ফ ঈড়ৎঢ়ঁংপষবং রহ ধ ঈধংব ড়ভ ঝবাবৎব অহবসরধ”। তার পরপরই থ্যালাসেমিয়া রোগটি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায় বিশ্বের বহু দেশের বিজ্ঞানীদের। এ রোগের কারণও যে “জিন”এর অস্বাভাবিকতাই তা প্রমাণিত হয় বহু বিজ্ঞানীদের গবেষণায়। বিশেষতঃ আমেরিকার বিজ্ঞানী নিল ও আফ্রিকান বিজ্ঞানী ল্যামবোট লেগ্র্যান্তুস ও বীটের গবেষণায়। ১৯৫৭ সনে বিজ্ঞানী ইনাম প্রথম দেখান যে, এই রোগের রোগীদের হিমোগ্লোবিনের “গ্লোবিন” প্রোটিনের “বিটা” (ই) পলিপেপটাইপ শৃঙ্খলের ১৪৬টি আ্যামাইনো ত্যাসিডের প্রত্যেকটির সজ্জা-রীতিই স্বাভাবিকের মত, কেবলমাত্র ষষ্ঠ স্থানের এমাইনো অ্যাসিডিটি “গ্লুটামিক অ্যাসিডের (এষঁঃধসরপ অপরফ) পরিবর্তে হয় ভ্যালিন (ঠধষরহব)। তারই ফলে দেখা দেয় এই অস্বাভাবিকতা।
এই গবেষণাগুলিই ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠা করেছিল এই ধারণাটিকে যে, ‘গ্লোবিন” প্রোটিনের “আলফা” ও “বিটা” শৃঙ্খলের সংশ্লেষ আলাদা আলাদা “জিন” বারা নিয়ন্ত্রিত। থ্যালাসেমিয়া মূলতঃ দু’ধরনের- α থ্যালাসেমিয়া ও β থ্যালাসেমিয়া। অন্যান্য ধরনগুলি এই দু’ধরণের থ্যালাসেমিয়া যে কোন একটির সামান্য হেরফেরে কারণ সৃষ্টি হয়ে থাকে।

লেখক : প্রধান ফিজিশিয়ান (অবৈতনিক), থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র – বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট