চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

রূপপুর কাহিনী সাইলোতেও

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৬ আগস্ট, ২০১৯ | ২:১৩ পূর্বাহ্ণ

পতেঙ্গা সাইলোতে গানি বেল (চটের রোল) কাটা, বস্তায় সিল মারা ও বস্তা উত্তোলনে শ্রমিক খরচ বস্তাপ্রতি মাত্র ৭২ পয়সা। অর্থাৎ ৭২ পয়সায় তিন ধরনের কাজ করে ঠিকাদার ! শুধু কী তাই, খাদ্যশস্য (গম) ভর্তি বস্তা ট্রাকে বোঝাই করার শ্রমিক খরচও কতো কম, টনপ্রতি মাত্র ২৫ টাকা। রেলের ওয়াগনে বোঝাই আরও কম, টনপ্রতি মাত্র ২২ টাকা। কিন্তু অদক্ষ শ্রমিকের বিল দেখে একেবারে পিলে চমকানো অবস্থা। মাসে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা। শ্রমিক হ্যান্ডলিং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সাইলো থেকে ১০ খাতে শ্রমিক নিয়োগবাবদ ৩৪ লাখ ৯ হাজার ৭২২ টাকা আদায় করেছে। বিল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ যেন আরেক রূপপুর কাহিনী। সাইলোর বর্তমান হ্যান্ডলিং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স জয় কনস্ট্রাকশনের গত আগস্ট মাসের বিল পর্যালোচনা করে এই তথ্য পাওয়া যায়।

জানা যায়, বিভিন্ন কাজে নামে-বেনামে বা একই ধরনের কাজে ঘুরেফিরে অতিরিক্ত কাজ এবং শ্রমিক নিয়োগ দেখিয়ে বড় অঙ্কের টাকা বিল করা হয়েছে। পরিবহন ঠিকাদারদের দাবি, সাইলো থেকে গম পরিবহনে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ট্রাকপ্রতি ৮৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। তারপরও শ্রমিকদের নামে সরকার থেকে বিল নেওয়া হয়। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে এই তুঘলকি প্রথা চলে আসছে। প্রতি বছর সরকারের কোটি কোটি টাকা তছরুপ করা হচ্ছে। তবে তা অস্বীকার করেছেন সাইলো অধীক্ষক। তিনি দাবি করেছেন, অফিস সিস্টেমের বাইরে কোন বিল দেওয়া হয় না।
জানা যায়, পতেঙ্গা সাইলোর হ্যান্ডলিং সরকারদলীয় তিন নেতার কব্জায় বন্দী। দীর্ঘদিন ধরে জয় কনস্ট্রাকশন, রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ ও মাসুদ এন্ড কোম্পানি ঘুরেফিরে সাইলো এবং হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামের শ্রম হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তাদের নামে-বেনামে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে সূত্র জানায়। সাইলোর বিষয়ে একাধিক পরিবহন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা হয়। তারা বললেন, সাইলো ও সিএসডি গুদাম থেকে সরকারি খাদ্যশস্য পরিবহনে ট্রাকপ্রতি ৮৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করে নেয় গুদাম শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের মাঝি (উপ-ঠিকাদার) এসব টাকা আদায় করেন। রেলের ওয়াগনেও খাদ্যশস্য উত্তোলনে টনপ্রতি টাকা নেয়া হয়। তারপরও একই কাজের (খাদ্যশস্য ট্রাকে বোঝাই) জন্য সাইলোর হ্যান্ডলিং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান টনপ্রতি ২৫ টাকা হারে সরকার থেকে টাকা পায়। সরকার থেকে আদায় করা বিল ফাও বলে দাবি পরিবহন ঠিকাদারদের।

সাইলোর বর্তমান হ্যান্ডলিং ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জয় কনস্ট্রাকশনের আগস্ট মাসে জমা দেওয়া বিলের কপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১০ খাতে শ্রমিক নিয়োগবাবদ ৩৪ লাখ ৯ হাজার ৭২২ টাকা আদায় করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৩ হাজার ১১১ দশমিক ৫২৩ টন খাদ্যশস্য ট্রাক বোঝাই করা হয়েছে। টনপ্রতি ২৫ টাকা হারে সরকার থেকে বিল আদায় করা হয়েছে তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৮৮ টাকা। ওয়াগনে বোঝাই করা হয়েছে ৯৬১ দশমিক ৩৫০ টন। প্রতিটনের জন্য খরচ ২২ টাকা হিসাবে সরকার থেকে নেয়া হয়েছে ২১ হাজার ১৪৯ টাকা।

ট্রাক বা ওয়াগন ছাড়াও নৌপথেও খাদ্যশস্য পরিবহন করা হয়। তবে নৌ-পথে বোঝাই খরচ একটু বেশি। টনপ্রতি নেয়া হয় ৪৫ টাকা করে। সেই হিসাবে ৯৯৯ দশমিক ৯৯৮ টন খাদ্যশস্য ট্রাক থেকে খালাস করে কোস্টার/বার্জে বোঝাই করাবাবদ বিল নেয়া হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৯৯ টাকা।
একাধিক পরিবহন ঠিকাদারের অভিযোগ, সাইলো থেকে গম পরিবহনের সময় শ্রমিকেরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। তারপরও মাসের শেষে বড় অঙ্কের বিল আদায় করে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ নয়-ছয় করা হচ্ছে।

সাইলো অধীক্ষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান এই বিষয়ে পূর্বকোণকে বলেন, ‘লেবাররা পরিবহন ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নেয় তা আমার জানা নেই। আমাদের নিয়ম-অনুযায়ী ওয়াগন-ট্রাকে যে লোড (বোঝাই) হয়, সে অনুযায়ী বিল দেওয়া হয়। এর বাইরে টাকা-পয়সার লেনদেন হয় কিনা আমার কিছু জানা নেই।’
দেখা যায়, অদক্ষ শ্রমিকের নামে বিল করা হয়েছে ১৫ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬শ টাকা। প্রতিঘণ্টায় ৪৫ টাকা করে বিল করা হয়েছে। সাইলোর ঘাস কাটা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাজে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করা হয় বলে জানান সাইলো হ্যান্ডলিং কাজে নিয়োজিত সাবেক এক ঠিকাদার। তিনি জানান, ঝুরা গম কুড়িয়ে নেওয়া, ঘাস-গাছপালা ছাঁটাসহ বিভিন্ন কাজে অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়। নামে-বেনামে অতিরিক্ত শ্রমিক দেখানো এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ দেখিয়ে বিল করা হয়। কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই খাতে বড় অর্থ তছরুপ করা হয়।

অদক্ষ শ্রমিকের বিষয়ে সাইলো অধীক্ষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সাইলোতে যত শ্রমিক আছে সব-ই অদক্ষ শ্রমিক, দক্ষ শ্রমিক তো একটাও নেই। ট্রাকে উঠানো-নামানো সব কাজ-ই করে অদক্ষ শ্রমিকেরা।’
ট্রাক, ওয়াগনে উঠানো-নামানোর জন্য আলাদা বিল করা হয়, অদক্ষ শ্রমিকের কাজ কী-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি অনেকটা রাগান্বিত হয়ে বলেন, ‘আপনি এগুলো কোথায় দেখেন, আপনাকে কে তথ্য দেয় ? এসব কে দেখায় ?’ তবে পরক্ষণে কণ্ঠস্বর কমিয়ে বলেন, ‘আপনি যদি অফিস টাইমে আসেন কথা বলতে সুবিধা হয়। কোথায় কত টাকা দেওয়া হল, অফিসিয়াল সিস্টেমে দেওয়া হল কি না জানা যাবে।’

ট্রাক ও ওয়াগনে বোঝাই ছাড়াও স্বয়ংক্রিয় ব্যাগিং মেশিনে গম বস্তায় ভর্তি করা, বস্তা সেলাই, ট্রাক-ওয়াগনে বোঝাই করা খাতেও বড় বিল করা হয়। টনপ্রতি ৪০ টাকা করে এই খাতে বিল নেওয়া হয়েছে ৭ লক্ষ ৩৬ হাজার ৭৪৩ টাকা।
বিলের কপি পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, ট্রাক ও ওয়াগন থেকে ব্যাগিং হাউসের ফ্লোরে খালি বস্তার বেল খালাস করা খাতে নেয়া হয় বেলপ্রতি ৩২ টাকা করে। এক হাজার ৫৬৮টি বেল খালাসে বিল করা হয়েছে ৫০ হাজার ১৭৬ টাকা। আর ট্রাক থেকে গানি গুদামে খালি বস্তার বেল খালাসে বিল করা হয়েছে ১৩ হাজার ১৫০ টাকা। গানি গুদাম থেকে ব্যাগিং হাউসের খালি বস্তা বা বস্তার বেল পরিবহন করা হয়েছে ৩৪৪টি। প্রতি বেল ১৫ টাকা করে আদায় করা হয়েছে ৫ হাজার ১৬০ টাকা। ব্যাগিং হাউস বা গানি স্টোর, মেইন স্টোর বা অন্যত্র থেকে বস্তাভর্তি খাদ্যশস্য, খালি বস্তা বা অন্য কোন সামগ্রী সাইলো জেটিতে পরিবহন করাবাবদ বিল হয়েছে টনপ্রতি ১৪৫ টাকা করে। ৯৯৯ দশমিক ৯৯৮ টনের জন্য বিল নেওয়া হয়েছে এক লাখ ৪৪ হাজার ৯৯৯ টাকা। তবে সবচেয়ে আশ্বর্য হচ্ছে গানি বেল কাটা, স্টেনসিল মারা এবং বস্তা উত্তোলনে নেয়া হয় ৭২ পয়সা করে। সেখাতে বিল করা হয়েছে চার লাখ ৬৮ হাজার ৩৫৮ টাকা। ১০ খাতে মোট বিল নেওয়া ৩৪ লাখ ৯ হাজার ৭২২ টাকা।

পতেঙ্গা সাইলো থেকে সরকারি আমদানি করা গম সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। সাইলোর হ্যান্ডলিং ঠিকাদার অন্তত এক দশক ধরে সরকারদলীয় তিন নেতার হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সাইলো ছাড়াও হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামও নিয়ন্ত্রণ করে আসছে একই সিন্ডিকট। মেসার্স জয় কনস্ট্রাকশন, রাজ্জাক এন্টারপ্রাইজ, মাসুদ এন্ড কোং ঘুরেফিরে খাদ্য বিভাগের তিনটি বড় গুদাম নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। তাদের স্ত্রী, স্বজনদের নামে-বেনামে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে সূত্র জানায়। অভিযোগ রয়েছে, শ্রম হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগে নতুন নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। ওই সিন্ডিকেটকে কাজ পাইয়ে দিতে কৌশলে এসব শর্ত আরোপ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে একই সিন্ডিকেট কাজ করে আসছে বিধায় প্রতিবছর বিলের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এতে সরকার বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বিষয়ে সাইলো অধীক্ষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান পূর্বকোণকে বলেন, ‘পিপিআর মেনে টেন্ডার আহ্বান করেছি। আমি তো আর ইচ্ছে মতো করতে পারব না। পূর্বের রেকর্ড ও কাজের ভলিয়ম দেখে সরকারি আইন অনুযায়ী করা হয়েছে।’

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট