চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

নষ্ট সার বাজারজাতের পাঁয়তারা !

টিএসপির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ষ গত বছর ধরা পড়া ৩০ কোটি টাকার নষ্ট সারের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে জব্দ সারের ষ বোয়ালখালীতে নষ্ট সার বাজারজাত করা হলেও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৮ জুলাই, ২০১৯ | ১:৪৮ পূর্বাহ্ণ

গত বছরের মার্চে নগরীর শাহ আমানত সেতু ও পটিয়ার ভেল্লাপাড়া এলাকা থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকার নষ্ট সার জব্দ করেছিল কৃষি বিভাগ। পাথরের মতো শক্ত এসব সার ট্র্যাক্টর দিয়ে গুঁড়ো করে বস্তাভর্তি করার সময় জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের গাফিলতির কারণে জব্দ করার সারের বড় অংশ পাচার হয়ে গিয়েছিল। গত সোমবার নগরীর পতেঙ্গার দুটি গুদাম থেকে জব্দ করা সারের সঙ্গে গত বছর জব্দকৃত ভেজাল সারের নমুনার সাদৃশ্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘হয়তো সেই নষ্ট সারগুলো প্যাকেটজাত করার জন্য বিভিন্ন গুদামে ঢুকে গেছে।’ তবে এ বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। বাকলিয়া ও ভেল্লাপাড়া ছাড়াও একই সময়ে বোয়ালখালীর পশ্চিম গোমদ-ীর চরখিজিরপুর এলাকায় বিপুল পরিমাণ সেই নষ্ট সার গুঁড়ো করে প্যাকেটজাত

করা হয়েছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচিত্র সংবাদ পরিবেশন ও থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল। এক বছর ধরে সেই নষ্ট সার পাচার হয়ে আসলেও নীরব ছিল স্থানীয় প্রশাসন। গত মাসেও সেখান থেকে সার পাচার হয়েছিল। এখনো সারের স্তূপ রয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। নষ্ট ও ভেজাল সার কারবারের জন্য প্রশাসনকে দুষছেন কৃষি বিভাগ ও কৃষকেরা। একই সঙ্গে সার উৎপাদনকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান টিএসপিকে দায়ী করেছেন তারা।
অভিযোগ ছিল, নষ্ট সার টিএসপি ও অন্য নামে প্যাকেটজাত করার পেছনে চট্টগ্রামের একজন সাংসদের ভাই ও সরকারদলীয় কয়েকজন ব্যবসায়ী জড়িত ছিলেন। এই জন্য সার জব্দ করা হলেও ধ্বংস করতে বেশিদূর এগোয়নি প্রশাসন। প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে সুকৌশলে এসব সার বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়ে যায়। ভেল্লাপাড়ায় জব্দ করা সার ধ্বংস ও মন্ত্রণালয়ে চিঠিপত্র লেখার কারণে একজন কৃষি কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল।
গত সোমবার রাতভর অভিযান চালিয়ে পতেঙ্গা টিএসপি সার কারখানা লাগোয়া দুটি গুদাম থেকে ৪শ মে. টন ভেজাল সার জব্দ করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসন, র‌্যাব, এনএসআই, কৃষি বিভাগ যৌথভাবে এই অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মো. ওসমান গনি রিপন (৪১) নামে একজনকে এক বছরের সশ্রম কারাদ- ও গুদাম মালিককে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে আদালত।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান পূর্বকোণকে জানান, সার পরিবহন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স রায়হান এন্ড ব্রাদার্স টিএসপি সার কারখানা থেকে সার সংগ্রহ করে গোডাউনে সংরক্ষণ করে। দুই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. ওসমান গনি রিপন (৪১) এবং মো. ওমর ফারুক খোকন (৪৩) নামে দুই সহোদর। ৫০ কেজি আসল টি এস পি সারের সঙ্গে আরও একশ কেজি ভেজাল এবং মাটি-পাথর মিশিয়ে তিনগুণ করা হচ্ছে। টিএসপি সারের বস্তা হুবহু নকল করে ভেজাল সার গোডাউনে রাখা হয়েছে।
দুই প্রতিষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ৫ শতাধিক ডিলারের কাছে সার সরবরাহ করে। এসব ভেজাল ও নকল সার দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হচ্ছে। জব্দ করা সার হালিশহর এলাকায় সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং স্থানে ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান।
ভ্রাম্যমাণ আদালতে জব্দ করা মাটি ও পাথরমিশ্রিত ভেজাল টিএসপি সারের সঙ্গে গত বছর কৃষি বিভাগ জব্দ করা নষ্ট সারের নমুনা একই ধরনের বলে জানান কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. গিয়াস উদ্দিন পূর্বকোণকে বলেন, ‘জব্দ করা সারের নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসহ তিনটি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট আসতে এক সপ্তাহ লাগতে পারে।’
পটিয়ার ভেল্লাপাড়া থেকে নষ্ট সার জব্দ করার পর তা ধ্বংস না করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছিল মেসার্স আমানত ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মোহাম্মদ ইউনুছ তালুকদার দাবি করেছিলেন, এমভি মাই মেরি মাদার ভ্যাসেল দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া টিএসপি সার ভেল্লাপাড়া ব্রিজের পাশে মজুত করা হয়। সারগুলো জিবসাম হিসেবে চা বাগানে এবং মাছের ঘেরে ব্যবহারের জন্য প্রক্রিয়া করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। টিএসপি সার হিসেবে স্থানীয় বাজার বা অন্য কোথাও বিক্রি বা ব্যবহার করছেন না। কিন্তু প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকায় সুকৌশলে সেই নষ্ট সার পাচার হয়ে যায়। এর জের ধরে পটিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠেছিল।
গত বছর নষ্ট সার আটকের সময় কৃষি কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘নষ্ট সার শুকিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টিএসপির নামে প্যাকেটজাত করে পাচার করা হয়েছিল।’
পতেঙ্গায় ভেজাল সারের অভিযানে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাব-৭ এর সিনিয়র এএসপি মিমতানুর রহমান, এনএসআই’র অতিরিক্ত পরিচালক ইউসুফ, উপ-পরিচালক সৈকত চৌধুরী, মেট্রোপলিটন কৃষি অফিসার বিলকিস বেগম, টিএসপি সার কারখানার ব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মো. কামরুজ্জামান।
কৃষি অফিসা বিলকিস বেগম জানান, ভেজাল ও নকল সার ব্যবহারের কারণে ফসলি জমির উর্বরতা হারিয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে টিএসপি সারবাহী একটি মাদার ভেসেল অন্য একটি জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ফুটো হয়ে যায়। এতে জাহাজের একটি অংশে পানি ঢুকে ৭ হাজার ৪শ মে. টন সার নষ্ট হয়ে যায়। এসব সার পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল কৃষি বিভাগ। এসব সার তো আর ফেরত নেওয়া হয়নি। একটি অসাধু চক্র এসব নষ্ট, পাথরের মতো শক্ত হয়ে যাওয়া পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে গুঁড়ো করে বস্তাভর্তি করা হয়েছিল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট