চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

চমেক হাসপাতালে সক্রিয় শিশু অপহরণচক্র

ভাগ্যক্রমে খুশি রক্ষা পেলেও বার বার একই ঘটনা

ইমাম হোসাইন রাজু

১৭ জুলাই, ২০১৯ | ২:০৮ পূর্বাহ্ণ

পাঁচ বছর বয়সী রাইসা আক্তার খুশি। অসুস্থ মায়ের সাথেই ভর্তি হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। কিন্তু এরইমধ্যে অপহরণের কবলে পড়ে যায় ছোট্ট শিশুটি। যদিও ভাগ্যক্রমে শিশুটি ফিরে আসে মায়ের কোলে। সৌভাগ্যক্রমে শিশুটি মায়ের কোলে ফিরে এলেও অনেক শিশুর ‘হারিয়ে’ যাওয়ার শঙ্কা ভর করে আছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। শুধু খুশিই নয়, প্রাপ্ত তথ্যমতে গত ছয় মাসে বৃহত্তর চট্টগ্রামের একমাত্র এই চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে প্রায় আট শিশু অপহরণের কবলে পড়ে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে এই পর্যন্ত কোন অপরাধীকে ধরা যায়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, শিশু পাচার রোধে স্বজনদের সচেতন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও কঠোর হওয়া জরুরি।
অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, হাসপাতালের বড় ধরনের একটি চক্র সক্রিয় থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা হওয়ায় থাকায় টার্গেট হিসেবেই একমাত্র এই হাসপাতালকে বেছে নিয়েছে চক্রটি। চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করে থাকেন হাসপাতালের কথিত কিছু আয়া-বয়ও। এছাড়াও হাসপাতালের কর্মচারী সেজেও এমন কাজ করে থাকেন তারা। তাই এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে শিশু চুরি বা অপহরণের ঘটনা আরও বাড়ার আশঙ্কার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই পর্যন্ত যে সকল শিশু চুরি বা অপহরণের ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন নারীরা। এসব নারী বিভিন্নভাবে ওয়ার্ড থেকে শিশুদের কৌশলে বের করেন এবং পরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে চক্রটির হাতে তুলে দেন। এটাই তাদের কাজ। সম্প্রতি যে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তার তথ্য যাচাই করলে দেখা যায়। ওই চক্রটির টার্গেট থাকে নবজাতক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের। যাদের চকলেট বা খেলনা জাতীয় কিছু দিয়েই আপোষ করে থাকেন তারা। চক্রটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগ দিয়ে এসব অবুঝ শিশুদের বাইরে নিয়ে আসেন। এরমধ্যে হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা কয়েকজনকে হাতে-নাতে আটক করলেও এখন সক্রিয় রয়েছে এই চক্রটি।
তথ্য বলছে, গত ছয়মাসে যে আট শিশু উদ্ধার হয়েছে, সবগুলোই হাসপাতালের নিরাপত্তায় ও শৃঙ্খলায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের হাতেই উদ্ধার হয়। সবকটি শিশুদের উদ্ধার করা হয় জরুরি বিভাগের আশপাশ থেকে। তাদের মধ্যে সম্প্রতি উদ্ধার হওয়া চন্দনাইশের হাশেমপুর সৈয়দাবাদ গ্রামের খোকন মিয়ার মেয়ে রাইসা আক্তার খুশিকেও জরুরি বিভাগের সামনে উদ্ধার করে আনসার সদস্যরা। এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সীতাকু- থানাধীন বড় কুমিরা এলাকার ফরহাদ উদ্দিন ইরানের দুই বছরের মেয়ে ইলাহন মুত্তাকিম ইকরাকেও একই স্থান থেকে উদ্ধার করে তারা। এছাড়া নেত্রকোনা জেলার মদন থানাধীন ফতেপুর এলাকার মো. জুয়েলের সাড়ে চারমাস বয়সী শিশু মো. বায়েজিদকে জরুরি বিভাগের সামনে থেকে উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়া এসব শিশু তাদের পরিবারের কেউ না কেউ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কারণেই এসেছে বলে জানিয়েছেন আনসার সদস্যরা। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চক্রটি তাদের টার্গেট করে ওয়ার্ড থেকে বের করে নেয়। এরপর বিভিন্ন কৌশরে তাদের অপহরণের চেষ্টা করে থাকেন।
এ বিষয়ে হাসপাতালের আনসার কমান্ডার মো. আবুল কাশেম পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমরা এই পর্যন্ত যত শিশুদের উদ্ধার করেছি, তাদের সবাই জরুরি বিভাগের আশপাশ থেকে উদ্ধার করা হয়। এসব শিশুরা তাদের মায়ের সাথেই হাসপাতালে এসেছেন। উদ্ধার হওয়ার সময় আমরা লক্ষ্য করেছিলাম, এসব শিশুদের লক্ষ্য করে কয়েক গজ দূরত্ব রেখে একজন নারী অনুসরণ করে থাকেন। যা সন্দেহজনক। কিন্তু আমাদের দেখে তারা কৌশলে পালিয়ে যাওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারিনি। তবে এখন থেকে আমাদের টিম কঠোর নজরদারিতে রেখেছেন। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এমন কাউকে সন্দেহ হলে যেন সাথে সাথে আটক করা হয়’।
এর আগেও গতবছর শিশু চুরির চক্রকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। যারা একটি চক্রের সাথে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছিলেন পুলিশ। এরমধ্যে গত বছরের ২ জুলাই হাসপাতালের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ২ বছর বয়সী এক শিশুকে চুরি করে পালানোর সময় আনোয়ারা বেগম (৪০) নামে এক নারীকে আটক করে থানায় দেন আনসার সদস্যরা। এর কয়েকদিন আগে চিকিৎসক সেজে শিশু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন রাজু (১৯) ও ফারজানা আক্তার মনি (২৬) নামে দুই ভুয়া চিকিৎসক। যারা হাসপাতালের শিশু চুরির সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেন। পরে তাদের বিরুদ্ধে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় শিশু চুরি ও হাসপাতালে অনধিকার প্রবেশের অপরাধে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়।
এদিকে, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সরকারি এই হাসপাতালের গুরুত্বর্পূণ ওয়ার্ড ও প্রতি গেটে সিসিটিভি ক্যামেরা ও নিরাপত্তাকর্মী থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এমন ঘটনা ঘটছে এই প্রশ্ন এখন অনেকের কাছে। যদিও এ বিষয়ে মানতে নারাজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ‘একটি চক্র কাজ করে থাকতে পারে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সবাই সবার কাজ করে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের হাসপাতালে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশ ও আনাসরদের নির্দেশনা দেওয়া আছে, যাকে সন্দেহ হবে সাথে সাথে আটক করে যেনো জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাছাড়া হাসপাতালের হাজারো মানুষের ভিড়ে কে চোর বা কে ভালো মানুষ, তাতো চেনা কষ্টকর। তবুও এখন থেকে এ বিষয়ে আরও সতর্ক থাকবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট