চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

আলাপচারিতায় প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান

চট্টগ্রামের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গন আমায় খুব বেশি টানে

ডেইজী মউদুদ

১৬ জুলাই, ২০১৯ | ১:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বিহারীলাল দাশের কবিতায় রোমান্টিসিজম পড়াতে গিয়ে প্রথম দিন ক্লাসে এসে পড়াচ্ছিলেন ‘সর্বদাই হুহু করে মন/ বিশ^ যেন মরুর মতন’। দু লাইন পাঠ করে সোজা ব্ল্যাকবোর্ডে চক ডাস্টার নিয়ে ছক আঁকতে শুরু করতেন। সাহিত্যের ক্লাসে চক আর ডাস্টার, ব্ল্যাক বোর্ড ব্যবহার, ছাত্রছাত্রীরা একটু অবাক হয়ে গেলাম। কিন্তু তাঁর পড়ানোর ধরন এবং স্টাইল এ মনে হতো আমরা বোধ হয় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী। ক্লাস শেষ করে প্রতি ক্লাসে অত্যন্ত স্মার্ট ও নাটকীয় ভঙ্গিতে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলতেন ‘ এনি কোয়েসচেন? আমরা প্রায় সময় চুপ থাকতাম। তিনি বলতেন ‘থ্যাংক ইউ’।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বোঝাতে গিয়ে তিনি অনুসরণ করতেন বৈয়াকরণিক এই পদ্ধতি। ছক এঁকে কবিতার বিষয়বস্তু আর আঙ্গিককে মুখে ব্যাখ্যা করতেন অত্যন্ত স্মার্ট আর সাবলীল ভঙ্গিতে। মাস্টার্সে শুধু কবিতার ক্লাস নয়, তিনি ছিলেন ধ্বনিতত্ত্ব আর ভাষাতত্ত্বের প-িতজন। এ বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন এক বিষয়। মুখস্থ করার কিছুই ছিল না, বোধগম্য করার বিষয়। সহজে নম্বর উঠতো না বিধায় এটির অল্টারনেট বিষয় ছিল পালি প্রাকৃত ভাষা। পালিতে আবার বেশি নম্বর পাওয়া যেত। তাই আমাদের সহপাঠীরা সকলেই পালি নিয়েছিলেন। কেবল আমি, কবির, রউফ, সাথী আর মহীবুল আজিজ কয়েকজনই স্যারের বিষয়টি নিয়েছিলাম। এতক্ষণ যার কথা বললাম, তিনি আর কেউ নন, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রাণপ্রিয় শিক্ষক ড. মনিরুজ্জামান। তাঁর পরিচয় এক অভিধায় দেয়া যাবে না। এক কথায় বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত একটি নাম প্রফেসর ড. মনিরুজ্জমান। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, গল্পকার, ছড়াকার , উপন্যাসিক, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও সম্পাদক। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘকাল। শুরুতেই চট্টগ্রাম কলেজ পরে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬৮ সালে বাংলা বিভাগে যোগ দেন অধ্যাপক হিসাবে।
গতকাল তিনি চট্টগ্রাম এলে নগরীর এক মাসিক পত্রিকা অফিসে তাঁর সাথে দেখা। কুশল বিনিময়কালেই স্যার বলেন, রাজীব হুমায়ূনকে নিয়ে তোমার লেখাটা পড়েছি, ভালো লিখেছ। বিজ্ঞ ও প-িত শিক্ষকের মুখে ছাত্রীর প্রশংসা ! শুনেই একরাশ ভালো লাগা আমায় আচ্ছন্ন করলো। খুব বেশি যেন পুলকিত হলাম । চট্টগ্রামের সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমি দীর্ঘ ৫০ বছর চট্টগ্রামে ছিলাম। এখন পুরনোরা কেউ নেই, কেবল আছেন সত্যব্রত। বলেন, আমি ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ। তারা শিখতে চাইতো, জানতে চাইতো আর ধৈর্য্য ধরে শুনতো। তাই আমি আমার একটি গ্রন্থ ছাত্রছাত্রীদেরকে উৎসর্গ করেছি। তিনি বলেন, তখন চট্টগ্রাম কলেজ ছিল সাহিত্য চর্চা আর আড্ডার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার সবখানিকটা জমে উঠতো চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে। বিভাগে ছিলেন জনপ্রিয় শিক্ষক মমতাজ উদ্দীন সহ স্বনামখ্যাত শিক্ষকেরা। বিভিন্ন সময়ে ঢাকা থেকে বিশিষ্ট জনেরা আসতেন। মূলতঃ তাঁদেরকে ঘিরে আড্ডা বা আসর জমে উঠতো। ভাষাবিজ্ঞানী আবদুল হাই, ড. এনামুল হক, সৈয়দ আলী আহসান, আবু হেনা মুস্তফা কামাল, ড. আনিসুজ্জামান, আবুল ফজল, মুস্তফা নুরুল ইসলাম প্রমুখ শিক্ষকেরা। কলিকাতা থেকে ও কবি সাহিত্যিকেরা আসতেন। সাহিত্য আসর আড্ডায় তারা মধ্যমনি থাকতেন। এরপর বেতার এর জন্য তাৎক্ষণিক প্রচুর গান লিখতে হতো। আমার কমপক্ষে ৫০০ গান বেতারে প্রচার করা হয়েছে। সেগুলো আর সংগ্রহে নেই। হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তবে ৫০ বছর ধরে চট্টগ্রামে থেকে তিনি চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আর সাহিত্যাঙ্গনকে বেশি ভালোবেসেছিলেন। ত্রাই বহিঃপ্রকাশ তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘ সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম’। তিনি তাঁর লেখা দুটি ছোট গল্প আমাদের পাঠ করে শোনান। গল্প দুটি যখন পাঠ করছিলেন,তাঁর পাঠ এবং রচনাগুণে ঘটনাগুলো যেন ভাসছিল চোখের উপর। স্যার অনর্গল পড়ে যাচ্ছেন, আমরা সবাই মুগ্ধ শ্রোতা, খুবই মজা পেলাম।
আর আমরা স্যারকে নিয়ে গতকাল আড্ডায় বসেছিলাম ইতিহাসের খসড়া সম্পাদক শামসুল হক ভাইয়ের আমন্ত্রণে তারই মোমিন রোডস্থ কার্যালয়ে। শুরুতেই স্যারকে সাদর সম্ভাষণ জানান আমার সহপাঠী গবেষক ও নাট্যকার আহমেদ কবির। তিনি স্যারের অসাধারণ পা-িত্য ও প্রতিভার কথা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। বিশেষ করে ভাষাবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্বে তাঁর পান্ডিত্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি বিষয়গুলো নিয়ে সহজ পদ্ধতি ও সহজ ভাষায় একটি গ্রন্থ রচনা করার জন্য স্যারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কালধারা সম্পাদক শাহ আলম নিপু, চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মুজিব রহমান, সহযোগী অধ্যাপক আনিকা রাইসা চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা অমল কান্তি নাথ, কবি অলক চক্রবর্তী প্রমুখ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট