চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কাজে আসছে না ৬৮ কোটি টাকার রাডার

বজ্রপাতের ‘ডেড জোন’ বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ জুলাই, ২০১৯ | ১০:০১ অপরাহ্ণ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির শঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বিশ্বে দুর্যোগপূর্ণ দেশের ঝুঁকির তালিকায় পঞ্চম স্থানে বাংলাদেশ। বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যে কয়েক বছর ধরে আরেকটি দুর্যোগ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। সেটি হলো বজ্রপাত। বিশ্বে বছরে বজ্রপাতে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার প্রায় অর্ধেকই ঘটছে বাংলাদেশে। বজ্রপাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশে। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, “বজ্রপাতের ‘ডেড জোন’ এখন বাংলাদেশ।”
সেভ দ্য সোসাইটি এন্ড থান্ডারস্টর্ম এওয়ারনেস ফোরাম সংবাদপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে জানিয়েছে, চলতি বছরে গত দুই মাসে বাংলাদেশে বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন ১২৬ এবং আহত হয়েছেন ৫৩ জন। বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটছে।



শনিবার বজ্রপাতে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। পাবনার বেড়ায় বজ্রপাতে দুই ছেলে, বাবাসহ চারজন নিহত হন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বজ্রপাতে বাবা-ছেলের করুণ মৃত্যু হয়। ময়মনসিংহে বজ্রপাতে তিনজন নিহত হন। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় একজন নিহত হয়েছেন। আগের দিন শুক্রবার বজ্রপাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিশুসহ দুইজন এবং শেরপুরে এক কৃষক নিহত হন। ২৮ জুন সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে একই পরিবারের তিনজনসহ পাঁচজন নিহত হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে প্রায় ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশের আটটি স্থানে লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করা হয়। বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ এসব রাডার ঢাকা, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, নওগাঁ, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা এবং পটুয়াখালীতে স্থাপন করা হয়। কারিগরি দক্ষতার অভাবে রাডারগুলো কোনো কাজে আসছে না।
এ বিষয়ে রাডার বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম জানান, বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়া এবং রাডার পরিচালনা বা তথ্য সংগ্রহের দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল আবহাওয়া অধিদপ্তরে নেই। ফলে রাডারগুলো কোনো কাজে আসছে না। যুক্তরাষ্ট্রের রাডার কোম্পানি প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তাদের এজেন্টদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অযত্ন-অবহেলায় রাডারগুলো নষ্ট হচ্ছে। রাডার স্থাপনের আগে বলা হয়েছিল, বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই তথ্য জানা যাবে। মোবাইল ফোনে ১৫ মিনিট আগেই ওই এলাকার মানুষকে বজ্রপাতের তথ্য জানিয়ে দেয়া যাবে।
ভারতের আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে তিন হাজার বজ্রপাত হয়। জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে গড়ে বছরে আড়াই হাজার বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বজ্রপাতকে আবহাওয়া সম্পর্কিত দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বজ্রপাতে এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে একজন সুস্থ মানুষের মৃত্যু হতে পারে।



বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান ও বায়ুদূষণ। একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল। রয়েছে হিমালয়। সাগর থেকে আসে গরম বাতাস, আর হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। একসঙ্গে দুই রকমের বাতাসের সংমিশ্রণে বজ্রমেঘের আবহ তৈরি হয়। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রপাত ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রতিবছর বজ্রপাতের প্রবণতা আরও বাড়ছে। মানুষ হতাহতের ঘটনাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। জাপানের জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমে দেখে গেছে, বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যায় বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জে। বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কৃষক ও জেলের সংখ্যাই বেশি।

পূর্বকোণ/ময়মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট