চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

আবারো ব্যর্থ পাকিস্তান

রোহিতের শতকে ভারতের জয়

মিটু বিভাস

১৭ জুন, ২০১৯ | ২:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ^কাপের ভারত-পাকিস্তান মহারণের চিত্রনাট্যটা যেন আগেই লেখা থাকে। ম্যাচের আগে কত উত্তেজনা, ক্রিকেটারদের কাছ থেকে আগুনে লড়াইয়ের প্রত্যয়, দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে যুদ্ধাংদেহী ভাব, সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে কথার বাকযুদ্ধ, পুরো ক্রিকেট বিশ^ যেন আলোড়িত হয়ে উঠে এ ম্যাচকে ঘিরে। কিন্তু মাঠের লড়াই শেষে বিজয়ী সেই এক দলই। বিশ^কাপে যতবারই যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে মাঠে নামে দু’দল এবং ততবারই ভারতের কাছে নতজানু হয়ে মাঠ ছাড়ে পাকিস্তান। এবারও পারল না নিষ্ঠুর এ নিয়তির লিখন খ-াতে। ম্যানচেস্টার পূর্বসূরীদের ইতিহাস বদলাতে পারল না ফখর-আমিররা। মাঠে ¯œায়ুযুদ্ধে বিরাট কোহলিদের কাছে হার মানলেন সরফরাজরা। দুই দেশের চিরন্তন লড়াইয়ে ভারতের কাছে বৃষ্টি আইনে ৮৯ রানে পরাজিত হল পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে রোহিত শর্মার দুরন্ত শতক ও বিরাট কোহলির অর্ধশতকে ৫ উইকেটে ৩৩৬ রানের বড় সংগ্রহ তোলে ভারত। জবাবে ৩৫তম ওভার শেষে ১৬৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছে পাকিস্তান তখন মাঠে নামে বৃষ্টি। এরপর ডার্ক লুইস পদ্ধতিতে পাকিস্তানের নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪০ ওভারে ৩০২ রান। দ্বিতীয় দফায় ব্যাট করতে নেমে আর কোন উইকেট না হারিয়ে ৪৬ রান সংগ্রহ করলে ৬ উইকেটে ২১২ রানে শেষ হয় পাকিস্তানের ইনিংস। এ জয়ে ৪ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট নিয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভারত। অন্যদিকে নবম স্থানে থাকা পাকিস্তানের সংগ্রহ ৫ ম্যাচে ৩ পয়েন্ট।
বিশ^কাপের এ হাইভোল্টেজ ম্যাচে আগে থেকেই ছিল বৃষ্টির শংকা। ম্যানচেস্টারে সকাল থেকে আকাশের মুখ বিষণœ। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের দিকে দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে বিশে^র কোটি কোটি সমর্থক। শেষ পর্যন্ত মাঠে গড়াবেতো ম্যাচ। তবে বেলা গড়াতেই ঝলমলে হাসি। দুই প্রতিবেশী দেশের ব্যাট-বলের লড়াইয়ে থাবা বসাতে পারেননি বৃষ্টি দেবতা। ম্যাচে দুইবার বৃষ্টি হানা দিলেও পাকিস্তানের ভাগ্য বদলাতে পারেনি। টস জিতে প্রথমে বল করার সিদ্ধান্ত নেন পাক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। মেঘলা আবহাওয়ায় শুরুতেই ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলা। কিন্তু তাঁর এ সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে গেল। বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে এর আগে সর্বোচ্চ রান ছিল ৩০০। চার বছর আগের বিশ্বকাপে ভারত এই রান করেছিল। ম্যানচেস্টারে রোহিত শর্মার ব্যাটে ভারত সেটাকে ছাড়িয়ে গেল। চলমান বিশ^কাপে এটা রোহিত শর্মা দ্বিতীয় শতক। তবে ইনিংসের শুরুতে ভারতের রানের লাগাম ঠিকই আটকে রেখেছিলেন মোহাম্মদ আমির। কিন্তু বোলিংয়ে তিনি যোগ্য সঙ্গী পাননি। ধাওয়ানের অনুপস্থিতিতে ভারতের ওপেনিংয়ে রোহিতের নতুন পার্টনার ছিলেন রাহুল। শুরুর দিকে বোঝাপড়ায় দুজনের সামান্য সমস্যা হচ্ছিল। বিশেষ করে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে। একবার তো রোহিত প্রায় রান আউট হতে বসেছিলেন। পরে অবশ্য দুজনেই দুজনের চোখের ভাষা বুঝতে পারেন। রোহিতের কলে ঠিকঠাক সাড়া দেন রাহুল। লোকেশ রাহুল দারুণ প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। কিন্তু দায়সারা ভাবে উইকেট ছুড়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বের হতে পারেননি কালকেও। উইকেটে জমে যাওয়ার পরে বাবর আযমের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন রাহুল। ৭৮ বলে ৩টি চার ও ২টি ছক্কায় ৫৭ রান করেন তিনি। প্রথম উইকেটে এ দুইজন তুলেন ১৩৬ রান। রাহুল ফিরলেও নিজের ছন্দে ব্যাট করতে থাকেন রোহিত। ওয়াহাব রিয়াজ, হাসান আলি, শাদাব খানদের অবলীলায় পাঠাতে থাকেন গ্যালারিতে। দলপতি বিরাট কোহলির সাথে ৯৮ রানের জুটি গড়ার পর বিধ্বংসী ইনিংস শেষ হয় রোহিতের। শর্ট ফাইন লেগে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওয়াহাব রিয়াজ। সেই জায়গা দিয়েই বাউন্ডারি মারতে চেয়েছিলেন রোহিত। টাইমিং ঠিকঠাক না হওয়ায় ওয়াহাবের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন রোহিত। ১১৩ বলে ১৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় ১৪০ রান করেন রোহিত। এটি তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি। এর আগে অর্ধশতরান পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নভজোৎ সিং সিধু, শচীন টেন্ডুলকর ও যুবরাজ সিংয়ের সঙ্গে এলিট ক্লাব ঢুকে পড়েন ‘হিটম্যান’ রোহিতও। চতুর্থ ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচেই অর্ধশতরানের নজির গড়েন তিনি। দলীয় ২৩৪ রানে রোহিত ফেরার পর ব্যাটিংয়ে প্রমোশন দিয়ে নামানো হয় হার্দিক পা-েকে। ২৮৫ রানে আমিরের শিকার হয়ে পা-ে ফেরার আগে ১৯ বলে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় খেলেন ২৬ রানের ঝড়ো ইনিংস। পা-ে যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন স্ট্রাইক রোটেট করছিলেন কোহলি। পা-ে ফিরতেই কোহালি স্বমহিমায় বের হয়ে আসেন। তবে নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি ধোনি। মাত্র ১ রানে আমিরের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন তিনি। ৪৬.৪ ওভারে বৃষ্টি নামলে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। খেলা শুরুর পর আমিরের বলে উইকেটের পেছনে সরফরাজের তালুবন্দী হলে ৬৫ বলে ৭টি চারে ৭৭ রানে ফেরেন কোহলি। তবে এর আগে ৫৭ রান পূর্ণ করার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন রেকর্ড গড়েন বিরাট কোহলি। শচিন টেন্ডুলকরকে ছাপিয়ে দ্রুততম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ১১ হাজার রানের মালিক বনে যান ভারতীয় অধিনায়ক। এর আগে দ্রুততম হিসেবে ২৭৬ ইনিংসে ১১ হাজার এলিট ক্লাবের সদস্য হওয়ার রেকর্ড ছিল টেন্ডুলকরের ঝুলিতে। মাত্র ২২২ ইনিংসেই সেই রেকর্ড ছুঁলেন বিরাট। কোহলি ফেরার পর টিভি রিপ্লেতে দেখা যায় বল তাঁর ব্যাটেই লাগেনি। পাক ক্রিকেটাররা আবেদন করলে আম্পায়ার মারিয়াস এরাসমাস সেই আবেদনে সাড়া দেননি। তবে কোহালি এক মুহূর্তও ক্রিজে না দাঁড়িয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা লাগান। ভুল শব্দ শুনেই ক্রিজ ছেড়ে আসেন তিনি। তার বিদায়ের পর বিজয় শঙ্কর ১৫ ও কেদার যাদব ৯ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন। পাকিস্তানের পক্ষে আমির ৩টি, হাসান আলী ও ওয়াহাব রিয়াজ ১টি করে উইকেট নেন।
বিশাল রানের বোঝা মাথায় নিয়ে জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে শুরুতে ইমাম উল হককে হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। দলীয় ৫ম এবং নিজের তৃতীয় ওভারে বল করতে এসেছিলেন ভুবনেশ^র কুমার। ঐ ওভারে চতুর্থ ডেলিভারির পরে বাঁ-পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ে ব্যাথা অনুভব করেন ভুবনেশ্বর। পরিবর্তিত হিসেবে ওভার শেষ করার দায়িত্ব পান বিশ্বকাপে অভিষেককারী বিজয় শঙ্করে। এতেই শাপে বর হয়ে দেখা দেন শঙ্কর। বিশ্বকাপ অভিষেকে বল হাতে এসেই মাইলস্টোন স্পর্শ করেন তিনি। প্রথম ভারতীয় এবং বিশ্বের নবম বোলার হিসেবে বিশ্বকাপ অভিষেকের প্রথম বলেই উইকেট তুলে নেন তিনি। দলীয় ১৩ রানে তাঁর বোলিং ফাঁদে আটকে পড়েন এ ওপেনার। এলবিডব্লিউ হওয়ার আগে ৭ রান করেন তিনি। এরপর ফখর জামান ও বাবর আযমে আস্থা খোঁজার চেষ্টা পাকিস্তানের। ভারতীয় বোলারদের দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করে ১০৪ রানের জুটি গড়েন তারা। ২৪তম ওভারে বাবর আযম এবং ২৬তম ওভারে দুর্দান্ত খেলতে থাকা ফখরজামানকে তুলে নেন কুলদ্বীপ যাদব। ৭৫ বলে ৭টি চার ও একমাত্র ছক্কায় ফখর জামান ৬২ রান করেন। তবে মাত্র ২ রানের জন্য অর্ধশতকের দেখা পাননি বাবর। ৫৭ বলে ৩টি চার ও ১ ছয়ে ৪৮ রানে শেষ হয় তাঁর সংগ্রহ। পরের ওভারে মোহাম্মদ হাফিজ ও শোয়েব মালিককে তুলে নিয়ে পাক ব্যাটিংয়ে ধস নামান হার্দিক পান্ডে। হাফিজ ৯ রান করলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি মালিক। এ নিয়ে বিশ^কাপে টানা দুই ম্যাচে ডাক মারলেন মালিক। ১২৯ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর স্তব্দ হয়ে যান পাক দর্শকরা। জয়ের কেতন উড়াতে শুরু করে ভারতীয় শিবির। তবে ক্রিজে থেকে ৫০ ওভার খেলার চেষ্টায় ছিলেন সরফরাজ আহমেদ ও ইমাদ ওয়াসিম। ৩৫তম ওভারে প্রথম বলে সরফরাজকে ফিরিয়ে দেন শংকর। ফেরার আগে ৩০ বলে ১২ রান করেন পাক দলপতি। পরের ওভারের শুরুতেই অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টি। পাকিস্তানের সংগ্রহ তখন ৬ উইকেটে ১৬৬ রান। বৃষ্টি থামলে ডার্ক-লুইস পদ্ধতিতে পাকিস্তানকে নতুন লক্ষ্য দেয়া হয় ৪০ ওভারে ৩০২ রান। জিততে হলে ৩০ বলে করতে হবে ১৩৬ রান। দ্বিতীয় দফায় ব্যাট করতে নেমে ৪০ ওভারে ৬ উইকেটে ২১২ রানেই শেষ হয় পাকিস্তানের ইনিংস। ভারতের পক্ষে শংকর, পা-ে ও কুলদ্বীপ ২টি করে উইকেট নেন।
ভারত : ৩৩৬/৫ (৫০)
ব্যাটিং
লোকেশ রাহুল-কট বাবর বল ওয়াহাব- ৫৭
রোহিত শর্মা-কট ওয়াহাব বল হাসান- ১৪০
বিরাট কোহলি-কট সরফরাজ বল আমির- ৭৭
হার্দিক পান্ডিয়া-কট বাবর বল আমির- ২৬
এমএস ধোনি-কট সরফরাজ বল আমির- ১
বিজয় শংকর-অপরাজিত- ১৫
কেদার জাদব-অপরাজিত- ৯
বোলিং
বোলার-ওভার-রান-উইকেট
মোহাম্মদ আমির ১০-৪৭-৩
হাসান আলী ৯-৮৪-১
ওয়াহাব রিয়াজ ১০-৭১-১
ইমাদ ওয়াসিম ১০-৪৯-০
শাদাব খান ৯-৬১-০
শোয়েব মালিক ১-১১-০
মোহাম্মদ হাফিজ ১-১১-০
পাকিস্তান : ২১২/৬ (৪০ ওভার, টার্গেট ৩০২)
ব্যাটিং
ইমাম উল হক-এলবিডব্লিউ শংকর-৭
ফখর জামান-কট চাহাল বল কুলদ্বীপ-৬২
বাবর আজম- বোল্ড কুলদ্বীপ-৪৮
মোহাম্মদ হাফিজ-কট শংকর বল পা-ে-৯
সরফরাজ আহমেদ- বোল্ড শংকর-১২
শোয়েব মালিক- বোল্ড পা-ে-০
ইমাদ ওয়াসিম-অপরাজিত-৪৬
শাদাব খান-অপরাজিত -২০
বোলিং
বোলার-ওভার-রান-উইকেট
ভুবেনেশ^র কুমার-২.৪-৮-০
জসপ্রিত বুমরাহ-৮-৫২-০
বিজয় শংকর-৫.২-২২-২
হার্দিক পান্ডে-৮-৪৪-২
কুলদ্বীপ যাদব-৯-৩২-২
যুবেন্দ্র চাহাল-৭-৫৩-০

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট