চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ২৬শ কোটি টাকার সুফল নিয়ে শঙ্কা

জলে গেল দেড় হাজার কোটি টাকা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে খরচ হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ২৮ বছর ধরে ব্যয় হওয়া এসব টাকার বেশির ভাগই জলে গেছে। সুফল পায়নি উপকূলবাসী। বর্তমানে ২৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু নি¤œমানের উপকরণ ও কাজের জন্য সুরক্ষার মেগাপ্রকল্পগুলোর সুফল নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন উপকূলবাসী। বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন উপজেলায় বাঁধ দেবে গেছে। পানির তোড়ে ল-ভ- হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, মিরসরাই, সীতাকু- ও নগরীর পতেঙ্গাসহ প্রায় ১৩৩ কিলোমিটারজুড়ে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। এরমধ্যে নগরীর পতেঙ্গসহ বিভিন্ন উপজেলায় আগের ও বর্তমান চলমান প্রকল্পসহ ৮০ কিলোমিটারজুড়ে বেড়িবাঁধ হচ্ছে। বাকি ৫৩ কিলোমিটারে মাটির বাঁধ থাকলেও পানির ঢেউয়ে বাঁধের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এখনো অরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিওয়ন) এ কে এম সামশুল করিম পূর্বকোণকে বলেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ছোট-বড় অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ২০২১ সালের মধ্যে সবকটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এতে সমুদ্র উপকূল এলাকা অনেকটা সুরক্ষিত হবে। বেড়িবাঁধের বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমান প্রকল্পগুলো সাগরের পানি উচ্চতা থেকে কয়েক ফুট বেশি উচ্চতায় নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে ঘূর্ণিঝড় বা দুর্যোগে সাগরের পানি উপচে জনবসতিতে ঢুকতে না পারে। ‘৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকা অরক্ষিত থাকায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও টেকসই ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করায় সুফল পায়নি উপকূলবাসী। দীর্ঘদিন ধরে অরক্ষিত ছিল। তবে ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মাটির বাঁধ ও সংস্কারের নামে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এসব টাকার বেশির ভাগই জলে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী কর্মসূচি শুরু করলেও ভেস্তে গেছে সেই প্রকল্পও। টেকসই ও সুরক্ষা না হওয়ায় ‘৯৬ এর ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ অনেকটা ল-ভ- হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় বাঁধের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়ে।
উপকূলীয় বেড়িবাঁধের মধ্যে নগরীর পতেঙ্গা থেকে সলিমপুর পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার সাগর উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ২২ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ রয়েছে। ২০ কিলোমিটারে রাস্তা, শিপব্রেকিং ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। অরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৭ কিলোমিটার। তবে বাঁশবাড়িয়া এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে তিন কিলোমিটার ছাড়া পুরো এলাকা সুরক্ষিত হবে। এদিকে, পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার আউটার রিং রোড নামে রোড নির্মাণ করা চলছে। প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাগর তীরে রোড নির্মাণে সুরক্ষা হবে পুরো এলাকা।
বাঁশখালীতে ৩৩ কিলোমিটার সাগর উপকূলীয় এলাকা রয়েছে। বর্তমানে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পে ৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে বাঁধের বিভিন্ন এলাকা দেবে গেছে। নি¤œমানের কাজের অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। এই নিয়ে প্রকল্পের সুফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
আনোয়ারা সাগর উপকূলীয় এলাকা রয়েছে চার কিলোমিটার। এরমধ্যে দুই কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ রয়েছে। দুই কিলোমিটার বাঁধ থাকলেও তা ভেঙে ল-ভ- হয়ে গেছে। অরক্ষিত থাকায় প্রতিনিয়ত আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলবাসী। সাগর উপকূল ছাড়াও সাঙ্গু তীরবর্তী রয়েছে আরও ৭৬ কিলোমিটার। বর্তমানে ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে চলমান প্রকল্প নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। প্রকল্পের অনিয়মের কারণে বিভিন্ন স্থানে বাঁধের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
দ্বীপবর্তী উপজেলা সন্দ্বীপে ৫৮ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৪৮ কিলোমিটার মাটির বাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে ২-৩ কিলোমিটার ভ-ভ- হয়ে গেছে। ১০ কিলোমিটার এখনো অরক্ষিত রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমানে ১৯৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পে ৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের উপকরণ বালু, পাথর ও কাজের মান নিয়ে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।
সাগর উপকূল এলাকার মধ্যে মিরসরাই উপজেলা সুরক্ষিত হয়ে গেছে। এই উপজেলায় স্থাপিত দুটি অর্থনৈতিক জোনের উন্নয়নের কারণে উপকূল এলাকা সুরক্ষিত করা হয়েছে। ১৭শ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
মিরসরাই, সীতাকু- ও সন্দ্বীপে ৯৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ সহকারী প্রকৌশলী ধীমান চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকা অনেকটা সুরক্ষিত হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর প্রভাবে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধের উচ্চতাও এখন ৭ দশমিক ২ থেকে ৭ দশমিক ৭ ফুট পর্যন্ত করা হচ্ছে। যাতে বড় ধরণের দুর্যোগে সাগরের পানি ঢুকতে না পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জনায়, ৬০-এর দশকের বন্যায় উপকূলীয় এলাকা চরমভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার পর বন্যাদুর্গত উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। ‘৮০ এর দশকে তা সংস্কার করা হয়েছে। সাগর উপকূলীয় ১৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধসহ প্রায় চারশ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। বেড়িবাঁধ সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সরকারের অন্যান্য খাত থেকে ব্যয় হয়েছে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে সরকারের শত শত কোটি টাকা পানিতেই গেছে বলে অভিযোগ জনপ্রতিনিধিদের।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট