চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কূটচালের দাহন

আজাদ ম-ল

১৪ জুন, ২০১৯ | ১:২৭ পূর্বাহ্ণ

আলম শেখ তারপরও বসে রইল। অন্যায়ভাবে আরোপিত বুকের পাঁজর ভাঙার মরমর মালা যেভাবে তার গলায় ঝুলছে, তাতে করে মেম্বারের হালকা আশ্বাসের সুরে সে নিশ্চিত হতে পারল না। সে বসে রইল যে আশ্বাসে কাজ হয় সেই আশ্বাসের আশায়। তাছাড়া তার সন্দেহ হলো, মেম্বারের কাছে তার সমস্যার কথাটা বলা হয়েছিল হয়তো হালকাভাবে অথবা তার বুকের পাঁজরের নিষ্পেষিত হাহাকারের সুর সে হয়তো মেম্বারকে ঠিকমতো শোনাতে বা বোঝাতে পারে নাই। তা না হলে, তিন দিন হয়ে গেল অথচ সমস্যা সমাধানের জন্য মেম্বার কোন রকম উদ্যোগ নিলো না কেন? সে ভাবল, আজ যে করে হোক তার সমস্যা যে গুরুতর সেটা মেম্বারকে বোঝাতেই হবে, তাতে যদি পায়ে ধরতে হয় তবুও। যে হৃদয়হীন কূটচালের খেলা তার শেষ সম্বল নিয়ে শুরু হয়েছে, তার ক্ষতির মাত্রা এখনও প্রাথমিক অবস্থায় আছে কিন্তু এই নিষ্ঠুর খেলা যদি আরো কিছুদিন চলতে থাকে তাহলে একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মনোজাগতিক হিসেব-নিকাষের ভবিষৎ যোগফলের দিব্যদৃষ্টিতে সে অস্থির হয়ে উঠল। কিন্তু, কই মেম্বার? ‘চিন্তা করিস না আলম’ বলে সেই যে ভিতর বাড়ি ঢুকল আর বের হওয়ার নাম নাই। কাজের আশ্বাস শুনতে তার আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে? অন্তকোণের দোটান আর অস্থিরতায় সে উঠে কাছারি ঘরের বাইরে আসতেই মেম্বারবাড়ির কাজের লোক কাদের আলীকে দেখতে পেল। বাড়ির কাজের লোক হলেও, ইদানিং কাদের আলী মেম্বারের সাথে সাথেই থাকে। আলম শেখকে দেখে সে যেন সাপ দেখার মতো চমকে উঠল, তার পান চিবানো মুখে এমন বিস্ময়ের ছাপ ফুটিয়ে তুলল তাতে মনে হলো আলম শেখের এতক্ষণ কাছারি ঘরে বসে থাকা কোনোমতে ঠিক হয় নাই। সে কপালের চামড়া ভাঁজ করে জিজ্ঞাস করল-
-তুমি এহনো বইসা আছাও ক্যা?
বর্তমানে কাদের আলীর হাব-ভাবের হিসাব শুধু আলম শেখ না, গ্রামের কেউ মিলাতে পারে না। তার কথা-বার্তা চাল-চলনে কেমন জানি মাতব্বরী ভাব, গ্রামের বাজারের অনেকের দোকান থেকে এটা-সেটা নিয়ে টাকা-পয়সা না দেওয়ারও দুর্নামও তার অনেক। মেম্বারের সাথে থাকে বলে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। মেম্বারও তাকে বিশেষ পাত্তা দেয়, মাথায় ছাতা ধরা বা নৌকায় উঠার সময় পরনের লুঙি ভিজিয়ে নৌকা পাড়ে টেনে ধরার বাইরেও সে মেম্বারের জন্য আরো বিশেষ কাজ করে দেয়, সেই বিশেষ কাজের জন্য তার গুরুত্ব বাড়ে মেম্বারের কাছে, মেম্বারের গুরুত্ব বাড়ে চেয়াম্যানের কাছে আর চেয়ারম্যানের বাড়ে আরো উপড়ের লেবেলে। এ এক বিদিক বিশেষ কাজ। আলম শেখ অবশ্য কাদের আলীর মতিগতি নিয়ে কোন মাথা ঘামায় না, বিশেষ কাজের খোঁজ-খবর রাখা তার কোন প্রয়োজনও পড়ে না, গ্রামের অতি দরিদ্র এবং খেটে খাওয়া মানুষ সে, জীবিকার তাড়নার যাঁতাকলে পিষ্ট তার জীবন। তারপরে মরার উপড় খরার ঘা হিসেবে বর্তমানে সে যে কঠিন পরিস্থিতির কবলে পড়েছে, তাতে করে ধূর্ত কাদের আলীকেই তার অকূল দরিয়ায় ভেসে যাওয়া গাছের গুঁড়ি মনে হয়।
-মেম্বারসাপের লগে আরেকবার দেহা করবের চাই, কাদের বাই।
-ক্যা? আর কোনো সমেস্যা?
-যে সমেস্যার মধ্যি আছি তাতেই তো চোহে সইষ্যার ফুল দেখতাছি, কাদের বাই।
-মেম্বারসাপতো আমার সামনে কইলো চিন্তা না করতে। হেরপরও চোহে সইষ্যার ফুল দেহো ক্যা?
-সইষ্যার ফুল কী আর এমাই দেহি কাদের বাই। তিন দিন অইয়া গেলো, মেম্বারসাপতো কোনো কাজই করলো না। ওরাতো সমানে মাটি কাইটা যাইতেছে।
-তাগো জমিতে তারা মাটি কাটলি তোমার কী? মেম্বারসাপই হের কী করবো?
কাদের আলীর কথা শুনে আলম শেখ যেন আকাশ থেকে পড়ল, তার আশঙ্কাই ঠিক, সে মেম্বারকে সমস্যার কথা সঠিকভাবে বোঝাতে পারে নাই। কাদের আলীর সামনে সে মেম্বারকে তার সমস্যার কথা বলেছিল, কাদের আলী যদি তার সমস্যা হালকাভাবে দেখে তাহলেতো মেম্বারও সেই ভাবেই দেখছে। সে মুখ কাচুমাচু করে বলল-
-তাগো জমি তারা যেমনে খুশি তেমনে কাটুক, আমার আপত্তি নাই, তয় যেভাবে ওরা কাটতেছে তাতে তো আমার জমি আর থাকবো না, কাদের বাই।
-ক্যা? তোমার জমির কী পাংখা গজাবো নি যে উইড়া চইলা যাবো।
কাদের আলীর নির্দয় স্বরের কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা আলম শেখের বুকে কাঁটার মতো বিঁধল, তার চোখের মনি কাঁপতে লাগল, স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে তার কষ্ট হলো, যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা শেষ সম্বল, চোখের সামনে নাই হয়ে যাওয়ার মর্মস্পর্শী ভাবাবেগে সে কাদের আলীর পা জড়িয়ে ধরল,
-রক্ষা করোগো কাদের বাই, ওই ছাড়া আমার যে আর কিছুই নাই।
আলম শেখের করুণ মিনতির আকুতি কাদের আলীর বুকের যমিন সিক্ত করতে পারল না, ইদানিং গ্রামের অনেক মানুষের এমন আচরণের সাথে সে পরিচিত। সে বরং আলম শেখের চোখের পানির স্বচ্ছ আয়নায় বিশেষ কিছু দেখতে পেলো আর মনে মনে বলল, ‘ প্রভু তোমার এতো দয়া কেন! ’ এবার সে তার নিদিষ্ট গন্তব্য পৌঁছানোর নৌকা ঘাট হতে ছেড়ে দিল, অবশ্য নৌকা নিদিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছালেও তার সমস্যা নাই। লাভ না হোক লসতো নাই। তবে, এই কেসেতো লাভের মওকা কাঁচের গ্লাসের মতো পরিস্কার। এই কেসতো বউ পিটানো বা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার মতো না।
-আহ্, করো কী আলম বাই, আমার পা ধরছাও ক্যা? আমি তো মাতব্বরও না মেম্বারও না।
-বাই, তুমি মেম্বারসাপরে একটু কইয়া দেও,তোমার কতা উনি হুনবো, আমারে দয়া করো।
-আজ নারে বাই, মেম্বারের বড় বউ রাগ কইরা বাপের বাড়ি চইলা গেছে, হেইজন্যি ছোট বউয়ের হাতে তার ঝগড়া চলতাছে।
-তাইলে তুমি চেয়ারমেনসাপরে কও, তোমারতো হের লগেও খাতির আছে।
এবার কাদের আলী তৃপ্তির ঢেকুর তুলল, মাছ তার জালে ঢুকে পড়েছে, এখন তাকে পেঁচিয়ে উঠানো যত দেরি, তবুও সে আর একটু সময় নিতে চায়, তাড়াহুড়ার মাছ ফসকেও যেতে পারে। সে তার পান চিবানো মুখের দাঁত জিব্বা দিয়ে খিলান করতে করতে আলম শেখের কাঁধে একটি হাত উঠিয়ে মেম্বারবাড়ির বাইরের দিকে হাঁটতে লাগল।
-বুঝলা আলম বাই, ইটের বাটাতো চেয়ারমেনের, তোমার জমির পাশের জমিও তার, হের জমিতে হে মাটি কাটলে আমি না করমু কেমনে?
-যেমনে হোক চেয়ারমেনরে বুঝাও কাদের বাই, যেই খাড়া কইরা মাটি কাটতেছে, এ্যাকফোটা ম্যাঘ নামলেই আমার জমির মাটি সব ধইসা যাবো, আমি ফহির অইয়া যামু।
-চেয়ারমেনের কাছে তুমি যাও না ক্যান?
-গেছিলামরে তো, কোতাই জানি মন্ত্রি আইবো, হে উয়া নিয়া ব্যস্ত, হের হাতে কতাই কওয়া গেল না।
-তোমার বাড়ির হাতে লাগাই না হের ইটের বাটা, দিনে এ্যাকবার না এ্যাবার তো আসে, ঐ হানে ধরো।
-এতো প্যাঁচঘোচ বুঝিনে, তুমিই একটা কিছু করো, এই গরীবরে বাঁচাও, কাদের বাই।
এবার কাদের আলী তার জাল গুটানো শুরু করল, সে তার ঠোঁট আঁকা-বাঁকা করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-বুঝলা আলম ভাই, খালি মুহের কথাইতো আর চিঁড়া ভিজবো না, তার জন্যিতো পানি লাগবো।
আলম শেখ গ্রামের মূর্খ সহজ-সরল মানুষ হলেও ধূর্ত কাদের আলীর শেষ কথার ইঙ্গিত বেশ বুঝতে পারল, সে আবারো হাত জোড় করে বলল-
-কাদের বাই দয়া করো, আমার তো চিড়া ভিজাইবের পানিটুকু নাই।
-হাসাইলা আলম বাই, কিছু নাই, তাই গোয়লে ঘাস খায় কিসে? হুনো মিয়া, মেম্বার, চেয়ারমেন কেউ তোমার কতা হুনবো না, তারা জানে ভোটের সময় তুমি হেগো ভোট দেও নাই। এ্যাকমাত্র আমিই তোমার শ্যাষ সম্বল রক্ষা করবের পারি। আরে বাবা, কিছু পাইতে অইলে তো কিছু দেওয়া লাগে, তাই না?
নিরুপায় আলম শেখের গোয়ালের গরুতেও শেষ রক্ষা হলো না, তার শেষ সম্বল বিঘা খানেক জমির অর্ধেক চেয়ারম্যানের ইটভাটার জন্য মাটি কাটা খাদে, আষাঢ়ের প্রথম ঢলেই কোমর ভেঙে পড়ল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল আলম শেখ, সেই কান্না আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিলো ঠিকই তবে কারো কান স্পর্শ করল না। অধিক শোকে জড়পিন্ড হয়ে সে থাকল কিছুদিন। তারপর নোয়ানো মনে পৃথিবীর আলোতে তাকে আবার পা রাখতে হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, তার চলার পায়ে আবারও ছন্দপতন হলো।
তাকে আবারও মেম্বারবাড়ির কাছারি ঘরে, যে আশ্বাসে কাজ হয় সেই আশ্বাসের আশায় বসে থাকতে হলো। কাদের আলী এবার তাকে মেম্বারের ছোট বউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে সেই গীত শোনাইয়া, তার কূটচালের জাল বিস্তারের কাজ শুরু করল- ‘কাদের বাই খুব কষ্ট পায়লাম, ম্যাঘ নামলে চেয়ারমেনের ইটের বাটার টেবা দেওয়া মাটি ভাইঙ্গা তোমার বাড়ি তলাবো ক্যা? তয় চিন্তা কইরো না, তোমার জমির টেহা যেমনে চেয়ারমেনের কাছ থেকা আদায় কইরা দিছিলাম, এবারেও তেমন ব্যবস্থা কইরা দিমু, তয় আগেই কইয়া রাখলাম খালি মুহের কতায় কইলাম চিড়া ভিজবো না।’
আলম শেখ কোন কথা বলতে পাড়ল না। সে পাথর চোখে, আকাশের কালো মেঘ আর কাদের আলীর ঠোঁট লাল করা মুখের পার্থক্য খুঁজতে লাগল…

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট