চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কল্যাণ অর্থনীতির রূপরেখা

মোহাম্মদ আবু তাহের

১৮ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

অর্থনীতি হচ্ছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকা- যা জীবিকা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। যে কর্মকা- ¯্রষ্টার মৌলিক সৃষ্টির আকার পরিবর্তন করে সম্পদ আহরণ, উৎপাদন ও বন্টন এবং ভোগের ব্যবস্থা করে মানুষের প্রয়োজন মেটায়। সুতরাং অর্থনৈতিক কর্মকা- মানুষের অস্তিত্বের জন্য আবশ্যকীয় কার্যক্রম, যা সর্বতোভাবে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করে।
প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন, “ইসলামী অর্থনীতি হলো জনসাধারণের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নীতি-পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের যাবতীয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাই কল্যাণ অর্থনীতি। অর্থনীতির এই রূপ রেখার সাথে ইসলামিক অর্থনীতির কোন বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নেই। ইসলামী অর্থনীতির সাথে সর্বোচ্চ সামাজিক কল্যাণ সুনিশ্চিত করার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজ কল্যাণের পথে বাঁধাগ্রস্থ কোন অর্থনৈতিক কর্মকা- ইসলামী অর্থনীতি সমর্থন করে না। ইসলামী অর্থনীতির সকল কর্মকা- পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে প্রদর্শিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত।
আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে সম্পদ সীমাবদ্ধ কিন্তু অভাব অফুরন্ত বা চাহিদা সীমাহীন, সুতরাং অফুরন্ত চাহিদার মধ্যে থেকে যা অধিকতর প্রয়োজনীয় তা পূরণের জন্য সীমাবদ্ধ সম্পদের ব্যবহার করে। বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি সত্যি। কারণ সম্পদ স্বভাবতই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিপত্তি হল সমাজের একশ্রেণীর মানুষ যারা সংখ্যায় অল্প অথচ পরম পরাক্রমশালী তারা ছলে-বলে-কৌশলে সম্পদ অর্জন করে তাদের লাগামহীন চাহিদা মেটায় ফলে বেশির ভাগ মানুষ সম্পদের স্বল্পতার কারণে চরম দারিদ্র্যের শিকার হয়।
আল্লাহ বলেন, “আত্মীয় স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং অভাবী ও পথিকদের দাও তাদের প্রাপ্য। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই অপব্যয় করো না। কারণ অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।”- (ইসরা : ২৬-২৭)। অর্থনীতি তখনি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।যখন সম্পদের সুষম বন্টন স্থবির হয়ে যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা চলে, একটি দেশের অভ্যন্তরে এক বছরে চূড়ান্তভাবে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার বাজারে সামষ্টিক মূল্যই হচ্ছে জিডিপি বা গ্রোস ডমেস্টিক প্রডাক্ট। কিন্তু সে জিডিপির সিংহভাগই মুষ্টিমেয় দুর্বৃত্তায়ন গোষ্ঠীর দখলে। অবশিষ্টের ভাগ্যের জোটে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অর্থনীতির দৈন্যদশা।
সুতরাং জিডিপি বৃদ্ধি সত্ত্বেও সাধারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী উন্নয়নের সুবিধা পায় না। এই পরিস্থিতিতে, ইসলামী অর্থনীতি অত্যন্ত কার্যকর। তবে শর্ত হচ্ছে, মানুষকে তার চাহিদা সীমাবদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ করা যাবে না। অফুরন্ত অভাব বোধের কারণে তা পূরণের জন্য যে অতিরিক্ত সম্পদের অপচয় হয় কিন্তু চাহিদা সীমিত হলে সে সম্পদের সাশ্রয় হবে তা সকল শ্রেণীর মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য সূচিত হবে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “আমি মানুষকে অকল্পনীয় সূত্র থেকে রিযিক দেবো”। তবে প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে সীমাহীন সম্পদ ভোগের মাধ্যমে বিলাসীতা থেকে বিরত থাকতে হবে। সম্পদ কখনো সীমাবদ্ধ নয় এই কারণে যে মানুষ বিজ্ঞান আশ্রয়ী গবেষণা শ্রম ও মেধার সমন্বয়ে মৌলিক সম্পদ এর আকার পরিবর্তন করে সম্পদের সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করে। সম্পদ যদি সীমাবদ্ধই হতো, জগতের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জীবনধারন অসম্ভব হতো।
ইসলামী অর্থনীতির আর একটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে, মহান আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন। লাভ-লোকসানের সাথে ব্যবসা পরিচালিত হয় বলে ব্যবসায় ঝুঁকি থাকে, পক্ষান্তরে যারা সুদের ব্যবসা করেন তাদের ক্ষেত্রে লাভ লোকসান যাই হোক না কেন আসলের উপর অতিরিক্ত নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হয়। মুনাফা হচ্ছে বিনিয়োগকারী কিংবা পণ্য বিক্রেতার পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগের ফলশ্রুতি। কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতাকে শ্রম নিয়োগ করতে হয় না। এই সুদের কারণে বহু ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী বাড়ি, ভিটা কিংবা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করেও সুদের যোগান দিতে পারে নাই। কাবুলিওয়ালা, মারমুখী মহাজন ও নিষ্ঠুর শাইলক এর মতো সুদ ব্যবসায়ীরা সুদ আদায়ের জন্য কত অমানবিক, পাশবিক ও নির্মম হয় তা অনেকেরই জানা। ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণী হচ্ছে একমাত্র দর্শন। সুদের ব্যবহার ও পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণ হারাম।
ইসলামী অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা নামাজ কায়েম কর, যাকাত আদায় করো। কেউ যাকাত না দিলে তার নামাজ কবুল হবে না। তাই ইসলামে যাকাত আদায়ের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।
সারা বছরের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পর যদি কারো উদ্বৃত্ত সম্পদ থাকে কেবল সে ব্যক্তির ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান অনুসরণ করে যাকাত দিতে হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদের সুষম বন্টন হয়। ধনী দরিদ্র বৈষম্য হ্রাস পায়। সমাজের আর্থিক ক্ষেত্রে দুর্বল শ্রেণীর জীবনের পথ সুগম হয়। যাকাত প্রদানের আরো একটি আবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে যে, যাকাত গ্রহণের যোগ্য এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়ার দরকার সে যেন যাকাতের অর্থ ব্যবহার করে আর্থিকভাবে সবল হয়। পরবর্তী সময়ে তার মধ্যেও যাকাত প্রদানের সক্ষমতা সৃষ্টি করে।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, “খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ হয় না, খাদ্য প্রাপ্তির সক্ষমতার অভাবের কারণে হয়”। এক্ষেত্রে তিনি বন্টনের অব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ইসলামী অর্থনীতি উক্ত বিধানের অংশবিশেষ। এই বিধান কোন মানবরচিত নয়, এটি সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহর। তিনি মানুষ সৃষ্টি করে তার দায়িত্ব শেষ করেন নাই মানুষের বসবাসের জন্য চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্র থেকে শুরু করে পৃথিবীর যা কিছু বিদ্যমান আছে সবই মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এইসব সৃষ্টিসমূহের কার্যকারিতা এত নিখুঁত ও নির্ভুল যে, এর ব্যতিক্রম হলে বিপত্তি। এজন্য কবি নজরুল ইসলামের গভীর তাৎপর্য ও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেই তার উমর ফারুক কবিতায় বলেছেন, “ইসলাম, সে তো পরশ মানিক তারে কে পেয়েছে খুঁজি? পরশে তাহার সোনা যারা তাদেরই মোরা বুঝি।”

লেখক : সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট