চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পাঞ্জেগানা নামায বা সালাত মু’মিনের প্রাত্যহিক জীবনে এনে দেয় অপরিমেয় আধ্যাত্মিক শক্তি

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১৮ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আহকামে ইলাহী, তথা ঐশ্বরিক বিধানের হিকমত ও প্রজ্ঞার সামনে আমাদের সকলকেই মাথা ঝুঁকিয়ে দেওয়া উচিৎ। এ অবিচল বিশ্বাস আমাদের থাকতে হবে যে, সালাত হলো বান্দার জন্য প্রেরিত আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠ উপহার প্রধানতম ফরয, দ্বীনের অন্যতম মূল স্তম্ভ নাজাত ও মুক্তির পূর্বশর্ত, ঈমানের অতন্দ্র প্রহরী। আল্লাহ তায়ালা বলেন: তোমরা সালাত কায়িম করো আর মুশরিকদের দলভুক্ত হয়ো না। (সূরা রূম: ৩১)। সূরা আ’লার ১৪-১৫ আয়াতে এসেছে : সফল ব্যক্তি সেই, যে পবিত্রতা অর্জন করেছে। আপন প্রতিপালকের নাম স্মরণে অত:পর সালাতে মগ্ন থেকেছে।
প্রত্যেক সালাতের জন্যই আল্লাহ পাক সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে “ নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর সময়সহ ফরয করা হয়েছে।” (সূরা নিসা:১০৩)। অতএব নির্ধারিত সময় মতোই আমাদেরকে সালাত আদায় করতে হবে। সালাতের সময়সমূহের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্ কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাত আঁধার হওয়া পর্যন্ত সালাত আদায় করুন, আর ভোরের সালাতও। নিশ্চয় ফজরের সালাত (ফিরিশতাদের) উপস্থিতির সময়। -(সূরা বণী ইসরাঈল: ৭৮) সূরা ত্ব-হা’র ১৩০ নং আয়াতে বলা হয়েছে: আপন প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠে রত থাকুন সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং দিনের শুরু ও রাতের শেষে তাসবীহ পাঠ করুন: যেন আপনি সুখী হন।’
সময়ের অল্প অল্প ব্যবধানে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করার পিছনে নিহিত রয়েছে আল্লাহতায়ালার বিরাট হিকমত। সালাতের এই বারংবারতা ও প্রাত্যাহিকতার মাধ্যমে মানুষ তার আত্মা ও রূহের জন্য লাভ করে পরিপূর্ণ ও পুষ্টিকর খাদ্য। তদ্রুপ এতে রয়েছে কলব’কে সৃষ্টিবিমুখ ও স্রষ্টামুখী করে পার্থিব লোভ লালসা ও শয়তানের চতুর্মুখী প্ররোচনা থেকে হিফাজতের পরিপূর্ণ ও কার্যকর ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে হযরত শাহ ওয়ালীউলাহ মুহাদ্দীস দেহলবী (রহ.) বড় সুন্দর লিখেছেন: মুসলিম উম্মাহ যদি প্রতিদিন বারবার জীবন ও কর্মের হাসাবা ও কর্মের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত না রাখে, তবে এই উম্মাহর রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো কিছুতেই সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের বিধান প্রদানের মাধ্যমে মহা-প্রজ্ঞাবান আলাহ পাক সে ব্যবস্থাই করেছেন। পূর্ব থেকেই নামাযের, অপেক্ষা ও প্রস্তুতি গ্রহণ মূলত: সালাতেরই অন্তর্গত এক সালাতের জ্যেতির্ময়তারই একটা অংশ। এ ভাবে দিনের অধিকাংশ সময় সালাতের গ-িতে এসে পড়ে।
আমাদের এ অভিজ্ঞতা আছে যে, যে ব্যক্তি তাহাজ্জুদ সালাতের নিয়ত করে শয্যা গ্রহণ করে সে অন্ততপক্ষে পশুর মতো নিশ্চিন্তে কিছুতেই ঘুমোতে পারবেনা। তদ্রুপ করো অন্তর যদি সর্বদা সালাত ও অন্যান্য যিকির ইবাদতের চিন্তায় মগ্ন থাকে তবে তার ভেতরের পশুত্ব কিছুতেই তাকে কোন পাশবিক কর্মে লিপ্ত করতে সফল হবে না।’ সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে- “ঘুম থেকে জাগ্রহ হতে হতে যার মুখে কালিমা শাহাদাৎ, তাসবীহ ও তাহমীদ তথা পবিত্রতা ও প্রশংসাবাদ উচ্চারিত হয় সে যদি কোন দুআ করে কিংবা অযু করে সালাত আদায় করে তবে তার দু’আ ও সালাত অবশ্যই কবুল হবে।” (হাদীসটি তিরমিযী ও আবু দাউদেও উদ্ধৃতি হয়েছে)।
হযরত শাহ ওয়ালীউলাহ (রহ.) উপরে বর্ণিত এই মর্ম উদ্ধার করেছেন যে, যার মুখে আল্লাহর যিকির এতই স্বত:স্ফুর্ত এবং অন্তরে সালাতের চিন্তা এতই প্রবল যে চোখ খোলার সাথে সাথে মুখ থেকে যিকির শুরু হয়ে যায় সে কিছুতেই গাফিল ও অচৈতন্য অবস্থায় ঘুমোতে পারবেনা।- (হুজ্জাতুলাহি’ল -বালিগাহ, খ ১, পৃ:৭৮)।
আলাহ পাক মু’মিনদের সন্বন্ধে বলেছেন: এরা এমন লোক যাদেরকে ব্যবসা ও ক্রয়-বিক্রয় কিছুই আল্লাহর যিকির থেকে গাফিল করতে পারেনা।” (সূরা নূর : ৩৭)।
অতএব নির্ধারিত সময়ে আমাদেরকে সালাত আদায় করতে হবে। সময়ের মত সালাতের রাকাআত সংখ্যা ও আল্লাহ পাক নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা অবশ্যই পালনীয়। কোন অযুহাতেই এর অন্যথা হতে পারবে না। রাসূলুলাহ (স.) ও তাঁর পূণ্যাত্মা সাহাবাগণ সালাতের সময় ও রাকাআত সংখ্যা উভয়েরই যথাযথ পাবন্দী করেছেন জীবনভর। এমনকি জিহাদ ও যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও এ ব্যাপারে কোনরূপ শিথিলতা তারা প্রদর্শন করেননি। ইসলামী উম্মাহ সালাতের এই ইবাদত এমন নিষ্ঠা, যত্ন, ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতার সাথে পালন করে এসেছে যার তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবেনা পৃথিবীর কোন জাতির ইতিহাসে। উত্থান-পতনের অনেক নাজুক মুহূর্তই এসেছে ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে, এসেছে কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষার মুহূর্ত। কতবার সে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে গোটা জাতির ভাগ্যাকাশ। কিন্তু কোথাও কোন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতেই এক ওয়াক্তের জন্যও মুলতবি হয়নি আল্লাহ পাকের দেয়া এই সালাত।
বস্তুত: পক্ষে এই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত – নির্ধারিত সময় ও রাকা’আত সংখ্যাসহ – মানুষের রূহ ও আত্মার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য এবং স্বাস্থ্য রক্ষাকারী ইন্জেকশন স্বরূপ। আর স্বয়ং রব্বুল আ’ালামিন তার বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন এ ব্যবস্থাপত্র; যিনি মহাজ্ঞানী ও অনন্ত প্রজ্ঞার অধিকারী। মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের যাবতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে যিনি মানুষের চেয়েও বেশী অবগত। তাই মানুষের উচিত স্বত:স্ফূর্তভাবে তার বিধান মেনে নেয়া এবং অবনত মস্তকে তার নির্দেশ পালন করে যাওয়া।
আসলে সালাতের সময়সমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব এবং সে সময়গুলোতে আলাহর অপার রহমত ও করুণার যে ধারাবাহিকতা বর্ষিত হয়, জ্যোতির্ময় তাজালী ও নূরের ¯িœগ্ধ পরশে আত্মিক উন্নতি ও উৎকর্ষ লাভের এবং নৈকট্য ও সান্নিধ্য অর্জনের যে অনুপম অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তার যথার্থ ‘ইলম’ বা জ্ঞান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (স.) ব্যতীত আর কারো নেই। তবে এই পাঁচটি সময় নির্ধারনের অনেক কারণ ও হিকমতের একটি এই যে, এ সময়গুলোতে আরব মুশরিকগণ তাদের উপাস্যের আরাধনা করত। তাই মুসলমানদেরকে সে সময়গুলোতে ‘লা-শারীক আল্লাহর’ ইবাদতে মশগুল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মানুষ যেখানে একজন ডাক্তার ও চিকিৎসকদের পরামর্শ, ব্যবস্থাপত্র, ওষুধের মাত্রা ও পথ্য মেনে চলা অত্যাবশ্যক মনে করে এবং এ ব্যাপারে সামান্য শিথিলতা প্রদর্শন কিংবা নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রয়োগকে অমার্জনীয় অপরাধরূপে বিবেচনা করে। অথচ চিকিৎসক ভিন্ন গৃহের অতি বুদ্ধিমান কোন জীব নয়, আমাদেরই মত রক্ত-মাংসে গড়া সধারণ মানুষ যার অভিজ্ঞতা সীমিত জ্ঞান অনুমান- নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে মহাজ্ঞানী ও অনন্ত প্রজ্ঞার অধিকারী আল্লাহ পাকের নির্দেশ ও বিধানের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কিরূপ হওয়া উচিত, যিনি বিশ্ব-জাহানের প্রতিপালক?

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট