চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পথে-পথে মাছ বিক্রি কথকতা

চলমান জীবন

আবসার হাবীব

১৭ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ছবির কথা ……. ছবিটি তুলেছিলাম চট্টগ্রামের বিখ্যাত মাছের পাইকারী বাজার ফিসারী ঘাটের। মূলত এখান থেকেই মাছের সরবরাহ পুরো চট্টগ্রাম শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারা বাংলাদেশেও এখান থেকে মাছ যায়। একজন বিক্রেতা মাছ নিয়ে বেরুবার আগে মাছ সাজিয়ে নিচ্ছে। ছবির টুকরীগুলো এরাই অলিতে-গলিতে কাঁধে ভারী নিয়ে মাছ বিক্রি করে। মাছ আড়তে আশার সাথে সাথে ভোরবেলায় টুকরী ভরে মাছ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বিক্রির জন্য। এদের পেশায় হচ্ছে মাছ বিক্রি। এখন অনেক গৃহিনী এসব মাছ বিক্রেতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ভোর হলে কখনো অপেক্ষা করে মাছ বিক্রেতার ডাক শোনার জন্য।
এখন অপেক্ষার সাথে সাথে বাজার মূল্যের কথা ভেবে হতাশ হয়ে পড়ে। বাজারে মাছসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম কমার কোনো লক্ষণও দেখছে না। এই অবস্থায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিন কাটছে। তারপরও বেঁচে থাকার জন্য বিক্রেতা মাছ নিয়ে প্রতিদিন বের হয়, ক্রেতাকে কিনতে হয় একই কারণে।
পথে-পথে মাছ বিক্রি ……. অলিতে-গলিতে, পথে-পথে, গেরস্থালী পাড়ায়, আবাসিক এলাকায় মাথায় করে – কাঁধে করে মাছ বিক্রেতারা ভোর হতেই বেরিয়ে পড়ে। সেই ডাকেই অনেকের ঘুম ভাঙ্গে। কেউ বিরক্ত হয় ছুটির দিনের আরামের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় বলে। কেউ খুশী হয়। গৃহিনী পছন্দসই মাছ নিয়ে নিলে আর বাজারে যেতে হবে না তাই। এরা দাম হাঁকে ক্রেতা বুঝে। কখনো ভালো, কখনো পচা মাছ বিক্রি করে। পচা মাছ সাধারণত আগের দিনের বিক্রেতা না হওয়া মাছ। কেনার সময় সতর্ক না হলে কিংবা মাছ না চিনলে এর শিকার হতে হয়।
বিক্রেতা-ক্রেতা সম্পর্ক …… অনেক বিক্রেতা আছে খুবই চালাক এবং ভালো। ব্যবসা বুঝে। তারা যেদিন ভালো তরতাজা মাছ সংগ্রহ করতে পারে, সেদিনের মাছ নির্দিষ্ট কিছু পরিবারের কাছে সরবরাহ করে। ঐ পরিবারে সে ভালো মাছ দিয়ে ভালো দামও পায়। গৃহকর্তা বা গৃহিনীর এককথা, ‘ভালো মাছ দেবা, ভালো দাম পাবা।’ সেই অলিখিত চুক্তিতে উভয়ে লাভবান হয়। তবে, মাছের ওজন দেখে নিতে ভুলবেন না। অবশ্য, পথে পথে যারা মাছ ফেরী করে এই ঝুঁকি তারা নিতে চায় না।
বাকীতেও ওরা মাছ বিক্রি করে সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কোনো কোনো পরিবারের কাছে। অনেক সময় লোক চিনতে ভুল করে। ফলে, অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কখনো বাড়ী বদলের কারণে কিংবা যোগাযোগের অভাবে। বাজারের সব মাছ বিক্রেতাই ওজনে ঠকায় এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। এটা যেন সর্বজন স্বীকৃত। ক্রেতাসাধারণ একেবারে নির্বিকার এ ব্যাপারে। কারণ, বাজারে বেশী তর্ক করতে গেলে গণধোলাই খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাজারে মাছ বিক্রেতারা ঠকানোর ক্ষেত্রে যেন একমত। দু’একজন যে ব্যতিক্রম নেই তাও নয়।
সকালবেলার গান ….. একদিন ফেরীওয়ালা মাছ ফেরী করতে না আসলে পরিবারের চেহারাটা বদলে যায়। আয়েশ করে পত্রিকা পড়া যায় না এক কাপ চা নিয়ে। ছোট ছোট বাজারে স্বামী-স্ত্রীর মুখে মেঘের ছায়া নামে। আমিষ সরবরাহকারী মাছের অভাবে না জানি জীবনটা নিরামিষ হয়ে যাবে আজ এই বন্ধের দিনে। তরতাজা মাছ বড়ই মজা। আবার বড়ো দরকারীও। যদি মিলে যায় যথারীতি, গৃহিনীর দৃষ্টিতে সুখের আমেজ আসে। আসে মনে আনন্দ। গুন গুন গান, ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে রান্নার মজাদার ভাজাভুজির ঘ্রাণের মতো। গৃহিণীদের পছন্দই আসল কথা। সংসার সুখের হয় গৃহিণীর পছন্দের স্বাধীনতায়। না রমণীর গুণে। ভাবতে খারাপ লাগে না।
জীবনের কথা …… জীবিকার তাগিদে রহিম-সলিম-শংকররা এই মাছ বিক্রিকে পেশা হিসেবে নেয়। জীবিকা মানে কাজ। আছে কাজের রকমফের। সেই অনুযায়ী তা জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। জীবনের ছন্দ বদলে যায়। বদলে যায় চালচলন, মানসিকতাও গড়ে উঠে সেভাবে। গড়ে উঠে চরিত্র ও স্বভাব। অনেক সময় অনেকের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে এই জীবন। ক্ষুদ্র আয়ের জীবন। একজন মাছ বিক্রেতার সাথে কথা বলতে বলতে মনে হয়েছে, তারা এই পেশাকে আন্তরিকভাবে নিয়েছে। একসময় সে বলে উঠে, ‘রিক্সা চালানোর চেয়ে মাছ বিক্রি করা অনেক ভালো।’
তারা প্রত্যেকে দৈনিক হাজার তিনেক টাকার মাছ ক্রয় করে। বিক্রি করে লাভ হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। কখনো কখনো তার চেয়েও বেশী। পেশা নিয়ে কেউ কেউ সন্তুষ্ট। কেউবা হতাশ। মানুষ তার বাঁধাধরা বৃত্তির বাইরে এভাবে বেছে নেয় নোতুন নোতুন বৃত্তির পথ। কোনো বৃত্তি উৎপাদনমুখী, আবার কোনো বৃত্তি অনুৎপাদনশীল। তবে এভাবেই মানুষ করে নেয় আয়-রোজগারের পথ। এটিও এক ধরনের কর্ম সংস্থান। দারিদ্র্য মোচনের প্রচেষ্টা।
জীবিকার কথা …….. মানুষ তো কেবল খাওয়া পড়া নিয়ে বেঁচে থাকে না, থাকে মানুষের জীবন স্বপ্ন এবং মনের চাওয়া-পাওয়া, রূপ-রস-রুচির এক অনন্য জগৎ। কোন জীবিকায় কার মন বসে যায় তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নাই। তাই কোনো জীবিকাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। এই পেশায় যেমন আছে ব্যক্তি মানুষের নিজের তাগিদ, তেমনি তা সবার প্রয়োজনেও গড়ে উঠেছে।
ফেরীওয়ালার জীবিকা বেশ অর্থকরী হয়ে উঠেছে শহরে-নগরে-বন্দরে। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন জাতের মাছ মাথায় করে, তরি-তরকারি ও আনাজপাতি সাজিয়ে রাস্তায়, মোড়ে, গলির মুখে এসে ক্রেতার সন্ধানে মাছ, মাছ…..তরকারি….. তরকারি করে ডাক দেয়। গলির ভেতরে গৃহাঙ্গনের কাছে এসে হাজির হওয়াটা একালের এ এক নতুন চমকপ্রদ জীবিকা। ক্ষুদ্র ফেরিওয়ালারা যেন সংসার যাত্রার এক সহযোগী ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রতিদিন ভোর বেলায় যোগান দিয়ে চলেছে দিনের প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো। ভোরে উঠে বাজারে ছোটার ঝামেলাটুকু পোহাতে হয় না এখন অনেক পরিবারকে।
নানান জীবিকার তন্তুজাল আজো আমাদের চারিপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কত বিচিত্র পেশা বা জীবিকা কালের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে। কিংবা এসব পেশার মানুষদের আমরা ভুলে যেতে বসেছি। শহরে ঘোড়ার গাড়ী, ঝালাই, ইরানী মহিলাদের কাঁচের চুড়ি বিক্রি, কাবুলিওয়ালার পেস্তা-বাদাম। তবে, এখন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন জিনিস নিয়ে নতুন নতুন বিক্রেতা। ভুট্টার খৈ ভাজা থেকে শুরু করে ভ্যান গাড়ীতে ক্যাসেট প্লেয়ার চালিয়ে আইসক্রিম বিক্রেতা – ঘরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে কোনো কিছুই বাদ যায় না – ঘরে দরজায় দাঁড়িয়ে হাত পাতলে সবই পাওয়া যাচ্ছে। এমন কি বাড়ী বাড়ী গিয়ে নামী-দামী কোম্পানী তথা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর দ্রব্য-সামগ্রীও ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে পার-টাইম চাকরীরত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বদলতে।
পুনশ্চ : ভোরের চিত্র ……..
শহরের ভোরের প্রতিদিনের চিত্র আগের মতো নেই। ঋতুতে ঋতুতে যে পরিবর্তনের হাওয়া নগরবাসী পেতো, এখন আর তা অনুভব করা যায় না। কেউ যদি মনে করিয়ে না দেয়। এখন প্রতিদিন যে হারে মাছ বিক্রেতা, কলা বিক্রেতা – এমন কি ফুলের টব বিক্রেতা পর্যন্ত – নিবেন – আছে বলে ডাক দিতে থাকে – কারো কারো ডাকে আগে সেই সুরেলা আমেজ খুঁজে পাওয়া যায়, কারো ডাকে শহরের যান্ত্রিক জীবনের আবেগহীনতা ফুটে উঠে। তাতেই যেন আমরা অভ্যস্ত। কখনো কখনো খুশী হই হাতের কাছে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু পেয়ে যাই বলে। দেখা মেলে জব্বার মিয়াদের মতো মাছ বিক্রেতা, তরকারী বিক্রেতাদের। এদের একটি নামও আমরা দিয়ে দিয়েছি। এদের আমরা ‘ফেরিওয়ালা’ নামেই ডাকি। কিংবা তরকারী বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা ইত্যাদি নামে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট