চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আষাঢ়ী পূর্ণিমা

লোকপ্রিয় বড়–য়া

১৬ জুলাই, ২০১৯ | ১:১১ পূর্বাহ্ণ

গৌতম সিদ্ধার্থ বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনকে এক মজবুত ভিত দিতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের এক বিখ্যাত দার্শনিক ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সমগ্র প্রাণীজগতের কল্যাণে যে সকল হিতকর এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন তা আজ সারা বিশ্বে অনেক আস্থা এবং সম্মানের সাথে গৃহীত হচ্ছে। বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনে কোন কল্পনা প্রসূত তত্ত্ব বা পথ নিদের্শনা বেধে দেওয়া হয়নি। বলা যায় বিজ্ঞানভিত্তিক ও আধুনিক চিন্তাপ্রসূত জ্ঞান নির্ভর উপদেশ দিয়ে বুদ্ধ এই মানবসমাজের অনেক উপকার করে গেছেন। অন্ধ কুসংস্কারাছন্ন মানুষদের জন্য অত্যন্ত যুক্তি নিভ’র স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে বাস্তববাদী মানুষে পরিণত হবার পথ দেখিয়েছেন। যতদিন এই পৃথিবী টিকে থাকবে গৌতম বুদ্ধকে একজন অদ্বিতীয় মানবতাবাদী পথ প্রদর্শক হিসেবে সবাই মূল্যায়িত করবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। মহামতি বুদ্ধ কখনোই জোর করে কাউকে বুদ্ধের দশর্নকে গ্রহণ করতে বলেননি। তিনি তার অমূল্যবাণী “নিজেকে জানো” এই সত্যকে উপলব্ধিতে এনে মানুষকে (নিজেকে জানার জন্য) গভীরভাবে আত্বস্থ হওয়ার পরামর্শ দেন। বুদ্ধ নিজেকে আবিস্কার করেছিলেন বলেই ধ্যানী হতে পেরেছিলেন এবং কঠোর সাধনায় নিজেকে সফে দিয়ে এক পর্যায়ে সিদ্ধিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাইতো গৌতম সিদ্ধার্থ বোধি লাভ করে সবজ্ঞ হয়েছিলেন।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ উৎসব। এই পূর্ণিমায় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ নিজ বিহারে বষা’ব্রত যাপন শুরু করেন। তথাগত বুদ্ধ এক সময়ে রাজগৃহের বেণুবনে ‘কলন্তক নিবাপে’ অবস্থান করছিলেন। ঐ এলাকায় মাননীয় ভিক্ষুগণ (গড়হশং) হেমন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে গ্রামের সবুজ ঘাস বা ফসলি ক্ষেত নষ্ট করে, বৃক্ষ নিধন এবং ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের পদদলিত করে এদিক সেদিক পিন্ডচারণ বা ফাং গ্রহণে গমনাগমন করতেন। এসব দেখে স্থানীয় জনগণ ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়ে প্রকাশ্যে ভিক্ষু শ্রমণদের বিরুদ্ধে দুর্নাম ছড়াতে লেগেছিল এবং প্রশ্ন তুলেছিল কেন শাক্যবংশীয় ভিক্ষু শ্রমণগণ এসব ক্ষতিকর কাজ করে কিভাবে ঘুরাফিরা করে? এই সময় পর্যন্ত বুদ্ধ তার শিষ্যতথা ভিক্ষুগণের জন্য বর্ষাবাস বিধান চালু করেননি। একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে বর্ষাঋতুতে বনের পাখীরাও গাছের ওপর বাসা বেধে নিজেদের সুরক্ষা করে। বুদ্ধ এই বিষয়টি ভেবে জ্ঞাত হয়ে ভিক্ষুগণকে আহবান করে বুঝাতে সক্ষম হলেন যে এই ঋতুতে বৃহত্তর কল্যাণে ভিক্ষু শ্রমণগনদের নিজ বিহারে বর্ষাবাস করতে হবে। সেই থেকে বুদ্ধের নির্দেশে ভিক্ষুগণ আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন হতে বর্ষাবাস এবং আষাঢ়ী পূর্ণিমার একমাস পরে দ্বিতীয় বর্ষাবাস পালন করেন। এখানে জেনে রাখা ভাল, যে সমস্ত ভিক্ষুগণ বর্ষাবাস পালন করেনা তাদের ‘দুক্কট’ অপরাধ হয়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য একটি স্মরণীয় উৎসব। বিশ্বের থেরবাদী বৌদ্ধরা মহাসমারোহে এই পূর্ণিমা উদযাপন করে আসছে। যেসব কারণে এই উৎসব বেশী তাৎপর্য বহন করে; ১) মহামানব গৌতম বুদ্ধের প্রতিসন্ধি গ্রহণ, ২) সিদ্ধার্থের গৃহ ত্যাগ, ৩) উনার পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের দীক্ষাদান এবং ৪) বুদ্ধের পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিয়ে ধর্মচক্র প্রবর্তন (ধর্মদেশনা) এই পবিত্র তিথিতেই সংগঠিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা এই আষাঢ়ী পূর্ণিমাতেই মহান ভিক্ষুসংঘ তাদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত শুরু করেন। ভিক্ষুদের পাশা-পাশি গৃহীদের মাঝে অনেকেই ত্রৈমাসিক অষ্টশীল পালন করেন। কোন ভিক্ষু যদি ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত পালন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেই ভিক্ষু কঠিন চীবর লাভ করতে পারবেনা। শুধু তাই নয় সেই ভিক্ষু অনেক প্রকার সাংঘিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। এই ব্রত শুদ্ধভাবে অনুশীলন করতে পারলে ভিক্ষুগণ তাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হবেন। ত্রৈমাসিক ব্রত ভিক্ষুদের কঠোর সংযম, শীল পালন, সাধনা ও শুদ্ধাচারে যাপিত রাখে তেমনি গৃহী সমাজকেও শীল, প্রজ্ঞা, ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে। একজন সুন্দর মনের মানুষে পরিনত হতে চাইলে নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখা চাই, আর তাই শীল পালনের বিকল্প নেই। এই বর্ষাব্রত পালন করেই ভিক্ষুগণ একটি বিহারে অবস্থান করার সুযোগ পান, পাশাপাশি পিন্ডচারণ ও ধ্যান চচ্চার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা যারা বর্ষাব্রত পালন করে থাকেন তারা নিজ বিহার ছেড়ে অন্য কোন বিহারে রাত্রি যাপন করতে পারেননা। যদি কোন বিশেষ কারণে কোথাও থাকতে হয় তা বিশেষ অধিষ্টানের মাধ্যমে নিয়ম পালন করতে হয়। পবিত্র ত্রিপিটক গ্রন্থের ‘বিনয় পিটকে’ মহাবর্গভাগে ভিক্ষুগণের বর্ষাবাস বিষয়ে সবিস্তারে জেনে নেওয়া যায়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা যে বর্ষাবাস শুরু হয় তা আশ্বিনী পূর্ণিমা অব্দি এই কঠিন ব্রত ভিক্ষুদের পালন করতে হয়। উল্লেখ আছে যে বিশেষ কার্যকারণ ছাড়া বর্ষাবাস ভঙ্গ করা বিনয় সম্মতভাবে নিষিদ্ধ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জীবজন্তুর উপদ্রব, চোর ডাকাত বা আগুন লাগার কারণে, ভিক্ষুর বাসস্থান বা কুঠির নষ্ট হলে স্বল্প সময়ের জন্য বর্ষাবাস বা ব্রত ভঙ্গ করতে পারে। সুষ্ঠুভাবে অর্থাৎ বিনয় সন্মতভাবে বর্ষাবাস পালন করলেই একজন ভিক্ষুর পক্ষে প্রবারণা পালনের সুযোগ থাকে। পাশা-পাশি গৃহী সমাজের দানশীল দায়ক-দায়িকাগণের পক্ষ হতে বর্ষাব্রত পালনকারী ভিক্ষুকে কঠিন চীবর দান করা অত্যাবশ্যকীয়।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে ধর্মবিনয় যথাযথভাবে পালন করার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধরা নিজেদের পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। শীল, বিনয়, ভাবনা বা ধ্যান সাধনা পালনকারী মানুষকে অনেক উন্নত করতে পারে। এ সমস্ত সু-কর্মের প্রভাবে মানুষ জয় করতে পারে অনেক কিছু। মানুষের ভেতরে যে অসুর ভাব বিরাজ করে তা থেকে নিবৃত হতে পারে। রাগ, দ্বেষ, লোভ বা মোহ মানুষের পাশ ঘেষতে পারেনা। সমস্ত অকুশল চেতনা দূরীভুত হয় নিমিশেই। মানবজগতে একজন শুদ্ধ মানুষ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বলিয়ান হয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে। প্রশংসায় রাঙিয়ে নিতে পারে নিজেকে একজন আদর্শ বৌদ্ধ হিসেবে। যে মানুষের পরিচয়ে থাকেনা কোন ধর্মবর্ণের ভেদাভেদ এবং সেইতো বুদ্ধের আদর্শ সেবক এবং অহিংসা মন্ত্রের পুজারী। বুদ্ধের অনুপম বাণী “বহুজন হিতায় বহুজন সূখায়” অর্থাৎ বহুজনের হিতের এবং বহুজনের সুখের জন্য প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। বিশেষত, এই বর্ষাবাস মানুষকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে। যেমন; আষাঢ় মাসে সাধারণত মাটি আকড়ে যে সকল কীট, পতঙ্গ ও সরীসৃপ বাস করে এবং চলাচল করে তারা বৃষ্টি বন্যা ইত্যাদির কারণে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করে। সে সময়ে যদি কোন সাধারণ মানুষ বা বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ তাদের পদদলিত করে তাহলে বুদ্ধের অমীয় বাণী “পানাতি পাতা বেরমনী শিক্কাপদং সমাধিয়মি” প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকিব এই শপথ ভঙ্গ হয়। মানুষের যেমন প্রাণ রয়েছে তেমনি কীট, পতঙ্গ, অন্যান্য জীব জন্তু সবারই প্রাণ রয়েছে। তাইতো মহামতি বুদ্ধ বিশ্বের সকল প্রাণীকূলের সূখ ও মঙ্গল কামনা করে বলেছিলেন “সব্বে সত্ত্বা সূখিতা হোন্তু” জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। আজকের এই পবিত্র আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবসে বিশ্বের ও বাংলাদেশের মঙ্গল শান্তি কামনা করছি।

লেখকঃ শান্তি কর্মী, সংগঠক, বৌদ্ধ নেতা ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট