চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ভারতে আজমগড়ী হযরতের যেয়ারত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

১৫ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

ছাত্র জীবনে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার (কুত্বুল আলম, সুলতানুল আউলিয়া হযরত শাহ সুফি আলহাজ্ব মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মজিদ রহ.) সান্নিধ্যে পৌঁছার সৌভাগ্য হয়। ফলশ্রুতিতে তাঁর হাতে মুরিদ হই। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর শুক্রবার সকালে আমার হযরত পীর ছাহেব কেবলা ইন্তেকাল করলে তাঁরই অনুজ তথা ছোট ভ্রাতা হযরত ছোট হুজুর কেবলা কুত্বে মাদার, অলিয়ে জমান হযরত আলহাজ্ব শাহ সুফি মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী রহ.’র সান্নিধ্যে থাকার সৌভাগ্য হয়। তিনি ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ৪ নভেম্বর শুক্রবার সকালে ইন্তেকাল করেন।
তরিক্বতে আছি বিধায় দাদা পীর আজমগড়ী হযরত কুত্বুল আলম শায়খুত তরিক্বত হযরত আলহাজ্ব শাহ সুফি মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী রহ.’র যেয়ারতে গমন করতে মন থেকে তাড়িত হওয়া স্বাভাবিক।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দুঃসম্পর্কীয় আত্নীয়কে নিয়ে প্রথম ভারতে গমন করি। মূল উদ্দেশ্য যেয়ারত। তখন আজমগড় গমন সাহসের বাহিরে ছিল। বাংলাদেশ বিমানের চট্টগ্রাম-কলকাতা সাপ্তাহিক দু’টি ফ্লাইট ছিল। মঙ্গলবার ও শুক্রবার। যাওয়া আসা ভাড়া জনপ্রতি ৮০০ টাকা। তখন মার্চের ১১ তারিখ মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ বিমানে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা রওনা হই। যকরিয়া এস্ট্রিট এ নাখোদা মসজিদের নিকটে একটি হোটেলে অবস্থান নিই। তখন ঐ এলাকা বর্তমানের মত গিঞ্জি ছিল না। সহযাত্রী রাজি না হওয়ায় তিন দিন পর শুক্রবার সকালে জুমার প্রস্তুতি নিয়ে খোঁজ করে করে হাওড়া ট্রেন স্টেশনে চলে যাই। তথা হতে ট্রেনে বান্ডেল ট্রেন স্টেশনে পৌঁছি। বান্ডেল স্টেশনের একদম নিকটে মাত্র ১০০/১৫০ মিটারের মধ্যে হযরত শাহসুফি সাইয়েদ আবদুল বারি ওয়াইসী (রহ.)’র মাজার। তথায় জুমা পড়াসহ দীর্ঘ সময় যেয়ারতে থেকে বিকেলে কলকাতা ফিরে আসি। পরদিন ট্রেনে দিল্লি রওনা হই। অবস্থান নিই সহযাত্রীর পরিচিত দিল্লি হযরত খাজা নেজাম উদ্দীন (রহ.)’র খাদেমের ঘরে। সহযাত্রী রাজি না হওয়ায় পরদিন ১৭ মার্চ সোমবার ভোরে একা বাসে সেরহিন্দ রওনা হই। হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আল ফেসানীর যেয়ারতে থেকে ট্রেনে রাতে দিল্লি ফিরে আসি। এর দু’দিন পর ২০ মার্চ বৃহস্পতিবার উভয়ে ট্রেনে আজমীর গমন করি। খাদেমের ঘরে অবস্থান করি। ১৪ মার্চ সোমবার আজমীর হতে ট্রেনে দিল্লি ফিরে আসি। আবারও হযরত খাজা নিজাম উদ্দীন (রহ.)’র খাদেমের ঘরে অবস্থান নিই। সহযাত্রী রাজি না হওয়ায় খাদেমের পুত্রের সহযোগিতায় ৪০ রূপি দিয়ে অত্যাধুনিক ট্যুরিস্ট বাসের টিকেট সংগ্রহ করে ভোরে আগ্রা রওনা হই। রাত ১২ টায় দিল্লী ফিরি। পরদিন কলকাতা রওনা হই। তারপর দিন ২৮ মার্চ সকালে কলকাতা হাওড়া ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে বিমান বন্দর রওনা হয়ে যাই। অতঃপর বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসি।
এরপরেও একাধিক বার যেয়ারতের উদ্দেশ্য ভারতে গমন করার সুযোগ হয়। ঐ সময়ও কলকাতার পার্ক সার্কাস চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের নিকট গোবরা (এক) কবরস্থানের প্রবশ মুখে দুই শহীদের যেয়ারত, মানিকতলায় হযরত সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র যেয়ারত, ফুরফুরা, আজমীর, দিল্লি সেরহিন্দ, পানিপথ, আলীগড়, দক্ষিণ ভারত, পশ্চিম ভারতে যেয়ারতে গমন করলেও যথাযথ তথ্যের অভাবে উত্তর প্রদেশে আজমগড় যাওয়া সম্ভবপর হয়নি।
এরই মধ্যে একবার চট্টগ্রাম অক্সিজেন এরিয়ায় গমন করি। তথায় আজমগড়ী হযরতের অন্যতম খলিফা হযরত সাঈদ খান (রহ.)’র সন্তান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আজম উদ্দিন খান সাহেবের সাক্ষাৎ করতে যাই। অক্সিজেন এরিয়ায় তাদের তরিক্বতের খানকাহ রয়েছে। তিনি তথায় তশরীফ এনেছেন জানতে পেরে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাই। তিনি কেন জানি আমাকে আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে যেতে নিরুৎসাহিত করেন। যাতায়াতের কোন তথ্য দিলেন না। এরই মধ্যে আমার হযরত পীর ছাহেব কেবলার মহান খলিফা হযরত শাহ সুফি এ.কিউ.এম মহিউদ্দীন মুজাদ্দেদী আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে গমন করেছিলেন। ফলে তাঁর থেকে যাতায়াতের বিস্তারিত অবগত হই।
অতঃপর বন্ধুবর পাটোয়ারী এম.এ গফুর ও সহোদর ছোট বোনের ছেলে ভাগিনা হাসানকে নিয়ে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা রওনা হই। পাটোয়ারী এম.এ গফুর বৃহত্তর কুমিল্লা চাঁদপুর জেলার বাসিন্দা। বিসিআইসির জিএম হতে অবসরে যান। পশ্চিম খুলশী আবাসিক এলাকায় ঘর করেন। ঐ সময় গারাংগিয়া তরিক্বতে ছিলেন। পরবর্তীতে তাবলীগের প্রতি অনুরাগী হন। ২৮ মার্চ ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গলবার ইন্তেকাল করেন।
৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ বুধবার আমরা বান্ডের যেয়ারতে যাই। ১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৮ টায় অঈ ঞড়ি ঞরবৎ দূন এক্সপ্রেসে আমরা হাওড়া থেকে রওনা দিই। তরিক্বতের ভাই আলমগীর সাহেবের মাধ্যমে কলকাতায় বসবাসকারী অমলেন্দু বাবু আমরা ৩ জনের জন্য সমস্ত ট্রেনের খরিদ করে রেখে দেন। ঘন ঘন ভারতে যাওয়া আসা থাকায় ভারতের ট্রেনের সময়সূচি বই সংগ্রহ রাখতে গুরুত্ব দিই। এ সময়সূচি বই ঘাটাঘাটি করে তারিখ, ট্রেনের নাম, ট্রেনের নাম্বার ইত্যাদি মিলিয়ে আলমগীর সাহেবকে দিলে তিনি কলকাতা অমলেন্দু বাবুর কাছে ফ্যাক্স করে দেয়। তখন ই-মেইল সহ আধুনিক মোবাইলের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়নি।
হাওড়া থেকে দেরাদূন সর্বশেষ গন্তব্যের এ দূন (উড়ড়হ) এক্সপ্রেস। আমরা ২ অক্টোবর বিকালে অযোধ্যা ট্রেন স্টেশনে নেমে পড়ি। তথা হতে প্রায় ৫০ কি.মি দূরত্বে গুন্ডা রওনা হই বাসে। সন্ধ্যায় গুন্ডায় পৌঁছলে জিগর মেমোরিয়াল কলেজের নিকটে আজমগড়ী হযরতের মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছি। তখন আজমগড়ী হযরতের পুন্যবতী কন্যা মুছাম্মৎ মছরুরা খাতুন, তাঁর স্বামী তথা আপন ফুফাত ভাই প্রফেসর ড. ইলতেফাক আহমদ এবং তাদের তিন সন্তান যথাক্রমে ফজলুল বারী, জাফরুল বারী ও ডা. আবদুল বারী ঘরে ছিলেন। সন্ধ্যায় তাঁরা আমাদের চা নাস্তা দিয়ে আতিথেয়তা করেন। অতঃপর ডা. আবদুল বারী তাঁর একজন কম্পাউন্ডার আমাদের সাথে দেন যেয়ারতে যাওয়ার জন্য। আমরা ৩ জনের ব্যাগ তাদের ঘরে রেখে প্রায় ৪/৫ ‘শ’ মিটার দূরত্বে হেঁটে হেঁটে আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে যাই।
আজমগড়ী হযরত ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে গুন্ডাতে ইন্তেকাল করেন তখন তাঁর ভাগিনা ও জামাতা প্রফেসর ড. ইলতেফাক আহমদ এবং তাঁর তিন সন্তান চিন্তা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন। আজমগড়ী হযরত যেহেতু একজন তরিক্বতের মহান শেখ, অতএব তাঁকে সাধারণ কবরস্থানে দাফন করা ঠিক হবে না। ফলশ্রুতিতে প্রফেসর ড. ইলতেফাক আহমদের বাড়ির ৪/৫ ‘শ’ মিটার দূরত্বে প্রায় ১ একর এরিয়া নিয়ে নিজস্ব জমিতে দাফন করা হয়। এতে চারপাশে ৩/৪ ফুট উচ্চতায় বাউন্ডারী দেওয়ালও দেয়া হয়।
পরবর্তীতে প্রয়োজনের তাগিতে উক্ত জমি একজন মুসলমানের নিকট বিক্রি করে দেয়া হয়। এতে দলিলে শর্ত রাখা হয় আজমগড়ী হযরতের কবর এরিয়া যে দলিলের অন্তর্ভুক্ত নয় তাও উল্লেখ রাখা হয়। ক্রেতা ওখানে টঃঃৎধষধ ঈড়ড়ষ ঝঃড়ৎধমব স্থাপন করেন। বরফ কলের মালিক ইন্তেকাল করলে আজমগড়ী হযরতের দেওয়ালের বাহিরে তাকে দাফন করা হয়। প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের সময়ের ব্যবধানে যেয়ারত ও এশারের নামাজ পড়ে তাদের ঘরে ফিরে আসি। (চলবে)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট