চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

জলাবদ্ধতার জন্য আমরাও দায়ী

আকাশ ইকবাল

১৫ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৬ পূর্বাহ্ণ

সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা! মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে টানা বৃষ্টি, তার সাথে জোয়ার এবং নগরের পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরের নানা শ্রেণি-পেশার ২০ লাখ মানুষকে। স্কুল-কলেজ, বাসা-বাড়ি, অফিস-কলকারখানা থেকে শুরু করে হাসপাতালেও পানি ঢুকে জনদুর্ভোগ দেখা গেছে। যেনো দিন দিন জনজীবন স্থবির হয়ে যাচ্ছে। এই জনদুর্ভোগ ও জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী কে? স্যাটেলাইট টিভি আর পত্রিকা পাতা উল্টালেই দেখা যায় প্রশ্নটি আর তার উত্তরে সাধারণ মানুষ অকপটেই বলেন, জলাবদ্ধতা আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। আর জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী সিডিএ। আমার প্রশ্ন, জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী শুধুই কি সিডিএ?
প্রাকৃতিকভাবে চট্টগ্রাম একটি ব্যতিক্রমী শহর। এখানে সমতল ভূমি আছে; পাহাড়, নদী ও সাগর আছে। শহরের উত্তর দিকে পাহাড়, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কর্ণফুলী ও হালদা নদী। আর পশ্চিমে বঙ্গপসাগর। নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পানি কর্ণফুলী ও হালদা নদী আর পশ্চিম দিকের পানি বঙ্গপোসাগরে বাধা ছাড়াই পতিত হওয়ার কথা। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের এ ধরনের চমৎকার ব্যবস্থা থাকার পরও নগরে জলাবদ্ধতার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে বুঝতে হবে, পানি নিষ্কাশনে ব্যবহৃত খাল, স্লুইচগেইট, ড্রেন ও মেনহোলে কোন সমস্যা আছে।
চট্টগ্রাম বাণিজ্য নগরী। সময়ের সাথে সাথে জনসংখ্যা যত বেশি বাড়ছে, নগরায়নও দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই নগরায়ন ছড়াতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নগরে ভেতর থাকা ছোট-বড় খাল দ্রুত সংকুচিত-সংকীর্ণ হচ্ছে। আর তাদের দ্বারা সৃষ্ট ময়লা-আবর্জনাও তত বেশি হচ্ছে। ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র নিক্ষেপের ফলে সংকুচিত ও সংকীর্ণ খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, আর পানি আটকা পড়ছে। এতে সামান্য বৃষ্টি হলেও দ্রুত পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
৫০-১০০ বছর আগে চট্টগ্রামে ৫১টি খাল-ছড়া ছিল। বর্তমানে রয়েছে মাত্র ২৯টি। তাহলে বাকি ২২টি ছড়া ও খাল কোথায় গেল? এসব ছড়া-খাল দখলদারির কারণে ভরাট হয়ে গেছে। কারা দখল করলো আর কারা ভবন নির্মাণ করলো? এভাবে চলতে থাকলে একসময় বিদ্যমান ২৯টি খালও উঠে যাবে। যাবে কি? যাচ্ছেও।
আমরা বারবার বলে যাচ্ছি, জলাবদ্ধতা আমাদের জন্য অভিশাপ। আমরা জলাবদ্ধতা দেখতে চাই ন। এ অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই। জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ সিটি কর্পোরেশনের, নাকি সিডিএ বা ওয়াসার তা জানতে চাই না। শুধু মাত্র দেখতে চাই, জলাবদ্ধতা নেই।
জলাবদ্ধতার জন্য আমরা সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন কিংবা ওয়াসা কে বারবার দায়ী করছি, আঙ্গুল তুলছি। কিন্তু আমরা কেউ নিজের দিকে আঙ্গুলটা তুলছি না। আচ্ছা, নগরীতে জলাবদ্ধতার জন্য আমরা নগরবাসী কি দায়ী নই? খাল দখল করছে কারা? ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র ফেলছে কারা? প্লাস্টিক- পলিথিনের অবাধ ব্যবহার করি কারা? পলিথিন ব্যবহার না করার আইন থাকলেও তার সামান্যটুকুও আমরা মানিনা। ফলে ৭০ লক্ষ মানুষের এই শহরে প্রতিদিন যে বর্জ্য তৈরি হয় তার অধিকাংশজুড়েই থাকে পলিথিন। এসব পলিথিন পানি নিষ্কাশনের পথগুলো বন্ধ করে দেয়। ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র ফেলার কারণে সেগুলো ড্রেনে গিয়ে জমা হয়। আমাদের এক শ্রেণির প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা নিয়মিত খাল, নদী, ছড়া ভরাট করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। আর তাই বিশাল জনসংখ্যার এ শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই নগরায়নের যুগে আমরা এতোটাই স্বার্থপর হয়েছি যে, এক ইঞ্চি জায়গা কেউ ছাড় দিচ্ছি না। চিন্তা করছি না, আমার এই ছাড় না দেওয়ার কারণে হাজার মানুষের দুঃখের কারণও হতে পারে। বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে প্রশ্নগুলো নিজের দিকে আঙ্গুল তুলে করুন। তাহলে উত্তর পাবেন। জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজে আমরা নিজেরাও বাধা দিচ্ছি। তৈরি করছিও আমরা। আইন করে অপরাধ দমানো যায় না, যদি না নিজেরা সচেতন হই। হ্যাঁ, অবশ্যই কর্তৃপক্ষও এর জন্য দায়ী। কর্তৃপক্ষের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মহানগরীতে এখন প্রায় ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ বাস করছেন। এই শহরের বাড়িঘর, রাস্তঘাটসহ নানা অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে, হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। আর এর জন্য অনুমতি প্রধান করছে কর্তৃপক্ষ। ফলে শহরের বেশিরভাগ এলাকার পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। খোঁড়াখুড়ির একটি বিশেষ সময় থাকা উচিত। শহরের সড়কগুলোতে খোঁড়াখুড়ির মহোৎসব শুরু হয় বর্ষা মৌসুমের ঠিক আগে থেকে। পুরো বর্ষামৌসুম ধরেই চলে এসব খোঁড়াখুড়ি। একারণেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়া কর্তৃপক্ষ অপরিকল্পিত ভাবে যত্রতত্র নির্মাণ করছে ফ্লাইওভার, ব্রিজ, কালভার্ট। যার ফলেও রাস্তার ক্ষয়ক্ষতি, ড্রেনেজ ভরাট হওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় কম কালভার্ট তৈরি, নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না করা ইত্যাদির কারণেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট