চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

মৌর্যোত্তর যুগে ভারত ও বাংলা

নাওজিশ মাহমুদ

১৪ জুলাই, ২০১৯ | ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭ সালে মৌর্যবংশের শেষ স¤্রাট দশরথ তাঁর সেনাপতি পূষ্যমিত্র শুঙ্গের হাতে নিহত হলে মৌর্য শাসনের অবসান ঘটে। সেই সাথে বৃহৎ সা¤্রাজ্যেরও ভাঙন ধরে। মৌর্য শাসনের পতনের পর গুপ্ত শাসনের উত্থানের (৩২ খৃস্টাব্দ) পূর্বে প্রায় ৫০০ শত বছর ভারত কোন একক কেন্দ্রীয় শাসনের বদলে আঞ্চলিক শাসক ও বিদেশী দ্বারা শাসিত হয়। পূর্ব ও মধ্য ভারতে শুঙ্গ রাজবংশ (১৮৭ খৃস্টপুর্ব থেকে ৭৫ খৃস্টপূর্ব পর্যন্ত) ও কান্ব বংশ (৭৫ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৩০ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত), কলিঙ্গে (উড়িষ্যা) চেদি বংশ, দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন রাজবংশের উত্থান ঘটে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে চলে যায় মধ্য এশিয়া থেকে আগত কুষাণসহ বিদেশীদের হাতে।
শুঙ্গরা ছিলেন ব্রাম্মণ। পাটলিপুত্রসহ পূর্ব ভারত এবং মধ্যভারতের বেশ কিছু অঞ্চল তাঁদের অধিকারভূক্ত ছিল। রাজধানী ছিল বিদিশায়। প্রথম শাসক ছিলেন পুষ্যমিত্র শুঙ্গ, যিনি মৌর্যবংশের শেষ স¤্রাট দশরথের সেনাপতি ছিলেন। দশরথকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। এর পর ধারাবাহিকভাবে তাঁর বংশধররা মগধের সিংহাসনে বসেন। এরা হলেন অগ্নিমিত্র, বসু জ্যাষ্ঠ, বসুমিত্র, ভদ্রক পুলিন্দক, ঘোষ বজ্রমিত্র, ভাগবত ও দেবভূমি। শুঙ্গবংশের শেষ শাসক দেবভূমি বা দেবভূতিকে হত্যা করে তার মন্ত্রী বাসুদেব মগধের সিংহাসনে বসেন এবং কান্ব নামে রাজবংশ এই অঞ্চল শাসন করেন। মাত্র ৪৫ বছরে এই বংশের পতন ঘটে।
খ্রিস্টপূর্ব শেষ শতকে কলিঙ্গে (উড়িষ্যা) নিয়ে একটি রাজ্য গড়ে উঠে । এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বুন্দেলন্ড থেকে আগত চেদি বংশের মহামেঘবাহন। এই বংশের বিখ্যাত ছিলেন তৃতীয় শাসক খারবেল। তারা জৈনধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। মহবিজয় নামে মনোরম রাজপ্রাসাদ তাঁর আমলে তৈরী হয়েছিল।
এই সময় দেশীয় রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দাক্ষিণাত্যের সাতবাহন রাজবংশ্। মৌর্য শাসনের ১০০ বছর পর মহরাষ্ট্রে এই সাতবাহনদের উত্থান ঘটে। ধীরে ধীরে কর্নাটক এবং অন্ধ্র প্রদেশে তাঁদের আধিপত্য বিস্তার করে। বিদেশী আক্রমণে পশ্চিম ভারত এবং মহারাষ্ট্র হাতছাড়া হয়ে যায়। গৌতমপুত্র সাতকর্নী (১০৬ খ্রিঃ-১৩০ খ্রিঃ পর্যন্ত) শকদের পরাজিত করে সা¤্রাজ্যকে আবার সুসংহত করেন। তিনি নিজেকে ব্রাম্মণ দাবী করতেন। গৌতমপুত্রের উত্তরাধিকারীরা ২২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। সাতবাহনের আমলে বর্ণপ্রথা আবার চালু হয়। সাতবাহন রাজা ও রানিরা অশ^মেধ ও বাজপেয় যজ্ঞ পালন করতেন। ব্রাম্মণ হলেও বৌদ্ধভিক্ষুদের করমুক্ত গ্রাম দান করতেন। উত্তর ভারতের মতো লৌহের ব্যবহার বিস্তার লাভ করে। লোহানির্মিত কোদাল লাঙলের ফলা, কুড়–ল বাটালি নরুন ব্যবহার করতো। সেই সাথে ধনুকের জ্যা, খাপযুক্ত তীরের ফলা ও ছোড়া ব্যবহার করতো। ব্যাপকভাবে ধান চাষ ও তুলা উৎপন্ন হতো। সেই সাথে মুদ্রা, পোড়া ইট, ছিদ্রযুক্ত টালির ব্যবহার এবং কুয়ার খনন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছিল। তবে লিখিত ভাষা হিসেবে প্রাকৃত ভাষার প্রচলন ছিল। সরকারী ভাষাও ছিল প্রাকৃত। ব্রাম্মী বর্ণমালা চালু ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ভারতে বার বার বিদেশী আক্রমণ চলতে থাকে। হিন্দুকুশ পার হয়ে গ্রীক (২০৬ খ্রিস্টপূর্ব), শক (খ্রিস্টপূর্ব ৫৮), পার্থীয় বা পহ্লবগণ (৪৫ খৃস্টপূর্ব), কুষানগণ (৫০ খৃস্টাব্দে) এবং সর্বশেষে ইন্দো-সাসানীয়গণ (২৩০ খৃস্টাব্দে) এই আক্রমণ চালায়। ভারতের উত্তর ও পশ্চিম অংশে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
গ্রীকরা ব্যাকট্রিয় বা উত্তর আফগানিস্তানের অক্ষু নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বাহ্নিক অঞ্চলে রাজত্ব করতো। এরা ইন্দো-গ্রীক বা ব্যাকিট্রিয় গ্রীক বলে পরিচিতি পায়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শুরুতে পশ্চিম ভারতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে অযোধ্যা এবং পাটালিপুত্র (পাটনা) পর্যন্ত তার সা¤্রাজ্য সম্প্রসারিত করেছিলেন। রাজধানী ছিল সাকল (শিয়ালকোট)। রাজাদের মধ্যে সবার সেরা ছিলেন মিনান্দর বা মিলিন্দ (খ্রিস্টপূর্ব ১৬৫ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫)। বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত নাগার্জনের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। এই গ্রীকরাই সর্বপ্রথম রাজকীয় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। গান্ধার শিল্পের বিকাশ ঘটে হয় এই গ্রীকদের বদৌলতে।
এরপর শকরা এসে গ্রীক আধিপত্যের অবসান ঘটায়। শকরা গ্রীকদের চেয়ে বড় সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম শাখা আফগানিস্তানে, দ্বিতীয় শাখা পাঞ্জাবের রাজধানী তক্ষশীলা, তৃতীয় শাখা মথুরায়, চতুর্থ শাখা পশ্চিম ভারতে গুজরাট ও সিন্ধুসহ, পঞ্চম শাখা উচ্চ দাক্ষিণাত্যে তাঁদের শাসন অব্যাহত রাখে। তবে শকরা চারশত বছর ধরে পশ্চিম ভারতে রাজত্ব করে। উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন রুদ্রাদমন (১৩০ খৃস্টাব্দ থেকে ১৫০ খ্রিস্টাব্দ) । তিনি প্রাকৃত ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। শকরা ভারতীয় জনগোষ্ঠী ও সমাজের সাথে মিশে যায়।
উত্তর-পশ্চিম ভারতে শকদের পরে শাসনভার গ্রহণ করে ইরান থেকে আগত প্রার্থীয় বা পহ্লবরা। পহ্লব রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন গল্ডোফার্নেস (২০ খ্রিস্টাব্দ- ৪৮ খ্রিস্টাব্দ)। তারাও ভারতীয় সমাজের সাথে একীভূত হয়ে পড়ে।
এরপর আসে চীনের পার্শ¦বর্তী যাযাবর জনজাতি কুষাণগণ। শকদের কাছ থেকে উত্তর আফগানিস্থান দখল করে। সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে কাবুল হয়ে হিন্দুকুশ গিরিপথ ধরে গান্ধার অঞ্চলে প্রবেশ করে গ্রীক ও পহ্লবদের কাছ থেকে শাসনভার নিয়ে নেয়। পশ্চিম ভারত ও উত্তর ভারতে তাঁদের শাসন সম্প্রসারিত করে। তাঁদের সা¤্রাজ্য বৃহত্তর সোভিয়েত অন্তর্গত মধ্য এশিয় অঞ্চল (বোখারা ও সমরকন্দসহ), ইরানের একটি অংশ, সমগ্র পাকিস্তান এবং ভারতের সমগ্র উত্তর ভারত মিলে একটি বৃহৎ সা¤্রাজ্য গড়ে তোলে। এ সা¤্রাজ্যের বৈশিষ্ট্য হলো ভারত (পাকিস্তানসহ) আফগানিস্থান পারস্য এবং মধ্য এশিয়া অধীনে থাকায় একে মধ্য এশীয় ও ভারতীয় সাম্রাজ্য বলা যায়। কুষাণ সা¤্রাজ্যে বিভিন্ন দেশের শিল্পী ও কারিগরদের সমন্বয়ে নতুন শিল্পধারা গড়ে উঠেছিল। প্রধান তিনটি ধারা হলো মধ্য এশিয়, গান্ধার এবং মথুরা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভাষ্কর্য মধ্য এশীয় ও আফগানিস্তানে বিস্তার লাভ করেছিল। গ্রীক ও রোমান পদ্ধতিতে বৌদ্ধমূর্তি নির্মিত হয়েছিল। কুষাণ রাজবংশ দুটি। ৫০ খৃস্টাব্দ থেকে ৭৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত একটি। এই বংেশের প্রথম রাজা প্রথম কদফিসেস। দি¦তীয় রাজা দ্বিতীয় কদফিসেস। এরপর রাজত্ব করে কনিষ্ক বংশ। এই বংশ ২৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত শাসন করে। কুষানদের প্রথম রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা পেশোয়ার। দ্বিতীয় রাজধানী মথুরা। কনিষ্ক ছিলেন কুষানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি ভারতে শকাব্দ সালটি প্রচলন করেন, যা ভারত সরকার এখনও অনুসরণ করে। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধ ধর্মের নতুন ধারার উদ্ভব হয়, যা মহাযান নামে পরিচিত। এই মহাযানের কারণে বৌদ্ধ ধর্মের মূল ধারা হীনযান কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ব্রাম্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থানে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হলেও প্রাচ্য দেশে এই মহাযানরা ছড়িয়ে পড়ে। কুষানরা ক্রমান্বয়ে ভারতীয় হয়ে উঠায়, মধ্য এশিয়া হাতছাড়া হয়ে যায় পারস্যের সাসানীয়দের উত্থানে। কুনিষ্কের উত্তারাধিকার বাসুদেব শৈব সম্প্রদায়ের অুনসারী হওয়ার পর কুষান সা¤্রাজ্যের পতনও শুরু হয় তখন থেকে। তবে কুষানদের আমলে ইরানীয় সংস্কৃতি, হেলেনীয় সংস্কৃতি ও ভারতীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন সংস্কৃতির গোড়া পত্তন হয়। প্রাচীন সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার দ্বার উন্মোচিত হয়। ফলে মধ্য এশিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান ও বর্তমান পাকিস্তান অঞ্চলে সহজে ইসলাম ধর্ম প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায়।
তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি ইরানের সাসানিয়রা (২৩০ খৃস্টাব্দে) পশ্চিম ভারতের একটি অংশে আধিপত্য বিস্তার করে। তারাই সিন্ধুর অধিবাসীদের হিন্দু বলে অভিহিত করে। সেখান থেকে হিন্দুস্তান নামকরণ হয়। ১০০ বছর শাসন করে। ইন্দু-সাসানিয় হিসেবে পরিচিতি পায়। তাঁদের বড় কৃতিত্ব হলো মুদ্রার ব্যাপক প্রচলন।
গ্রীক, শক, পহ্লব, কুষাণ এবং ইন্দু-সাসানীয়রা ধীরে ধীরে স্বকীয়তা হারিয়ে ভারতীয় সমাজে মিশে যায়। যেহেতু আক্রমণকারী হিসেবে ভারতে আগমণ করে। তাই তারা ক্ষত্রিয় হিসেবে ভারতীয় সমাজে গৃহীত হয়। ভারতবর্ষে মৌর্যোত্তর যুগের মতো এতো বেশী বিদেশীর আগমণ আর কখনো ঘটে নাই। ভারতীয় সমাজে এদের মিশ্রণের ফলে পশ্চিম ভারত ও উত্তর ভারতে যুদ্ধ দক্ষতায়, ব্যবসা বাণিজ্যে, কারিগর শিল্পে, কাঁচ শিল্পে, কৃষিক্ষেত্রে, ভাষা ও সাহিত্যে, শিক্ষায়, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনৈতিক সংগঠনে ও সমাজের মধ্যে বিশাল প্রভাব পড়েছিল। গ্রীক সভ্যতা , পারস্য সভ্যতা ও মধ্য এশিয়া সভ্যতা, প্রতিবেশী হিসেবে রোমান সভ্যতা এবং চৈনিক সভ্যতার প্রভাবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এগিয়ে যায়। উত্তর ভারতের পূর্বাংশ বিহার, পশ্চিম ভারত ও উত্তর ভারতের পশ্চিম অংশের পরস্পরের প্রভাবে ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য দিল্লীতে এসে স্থির হয়।
মৌর্যদের আমলে বাংলা অঞ্চলের পশ্চিম বঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গ পুন্ড্রবর্ধন এলাকা হিসেবে, যার কেন্দ্র ছিল পুন্ড্রনগরী (বর্তমানের বগুড়া), অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। শুঙ্গ আমলেও তা অব্যাহত ছিল। বাংলা অঞ্চল কুষানদের অধীনে ছিল না এটা নিশ্চিত। কুষানযুগে বাংলার সমুদ্রবন্দর দিয়ে রোমের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। গঙ্গা নদীর মোহনায় গঙ্গে বন্দর দিয়ে মসলা ও বিলাসদ্রব্য রোমে রপ্তানী হতো। এটা কার অধীনে ছিল তা এখনও রহস্যাবৃত। মৌর্যোত্তর যুগের এই অঞ্চলে কোন ইতিহাস এখন পর্যন্ত জানা যায় নি। গুপ্তযুগের উত্থানের আগে প্রায় ৫০০ শত বছরের ইতিহাস অন্ধকারে রয়ে গিয়েছে। তবে গুপ্তরাজবংশের উত্থানের পূর্বে তাঁদের চারণভূমি ছিল এই বাংলায়। এই অঞ্চলের গঙ্গারাজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিদেশী ইতিহাস থেকে পেলেও এর উত্থান এবং পতন , সেই সাথে এর উত্তারাধিকার সম্পর্কে এখনও কোন সঠিক তথ্য উদঘাটিত হয়নি। তবে এই সময় বাঁকুড়া হতে ফরিদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত সিংহবর্ম ও তার পুত্র চন্দ্রবর্মার রাজত্ব ছিল বলে অনুমান করা হয়। এই রাজত্ব গুপ্তদের হাতে পতন ঘটে। এই গুপ্তদের আদি বাস স্থান মুর্শিদাবাদ ছিল বলে মনে করা হয়। আর কোন কোন ঐতিহাসিক মালদহ দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলায় আদি বাসস্থান ছিল বলে দাবী করেন। তবে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য রাতারাতি গড়ে উঠে নাই। বাংলায় ছোট ছোট রাজ্য ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল গুপ্তদের। যেখান থেকে পাটালিপুত্র (পাটনা) দখল করার জন্য প্রস্তৃতি নেয়া হয়। নাগদত্ত নামে একজন উত্তবঙ্গের শাসক ছিলেন জানা যায়, যার বিস্তরিত তথ্য পাওয়া যায় নি।
মৌর্য সম্রাাজ্য পতনের পর ও গুপ্ত সা¤্রাজ্য উত্থানের পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ২৫০ খ্রিস্টাব্দ সময়কে মৌর্যোত্তর যুগ বলে গণ্য করা হয়। এ সময় উত্তর ও পশ্চিম ভারতে কুষান সা¤্রাজ্য, দক্ষিণাত্যে সাতবাহন সা¤্রাজ্য ছাড়াও দক্ষিণতম প্রান্তে- মাদুরাইকে রাজধানী করে পান্ড্য রাজ্য, পুহারকে রাজধানী করে চোল রাজ্য এবং চেন বা কেরল নামে তিনটি ক্ষুদ্র রাজ্য গড়ে উঠেছিল। যারা সমুদ্রবাণিজ্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এই সময়ে ভারতবর্ষে কারিগরি শিল্প, নানা ধরনের বণিকসম্প্রদায়, স্থলপথে বর্হিবাণিজ্য পথ ও বাণিজ্যকেন্দ্রের বিকাশ, সমুদ্রপথে বহির্বাণিজ্য বিকাশ, মুদ্রা অর্থনীতির বিকাশ, নতুন নতুন নগরকেন্দ্রকে ভিত্তি করে নাগরিক সমাজের বিকাশ ঘটে। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মের মহাযান ধারার উত্থান যেমন ঘটে, তেমনি বিষ্ণু ধর্মেরও বিকাশ ঘটে। গ্রীক ও সংস্কৃত প্রভাবিত প্রাকৃতিক ভাষার ব্যাপক প্রচলন হয়। সেই সাথে বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার চর্চাও অব্যাহত থাকে। প্রচলন ছিল গ্রীক, খারোষ্ঠী ও ব্রাম্মলিপিরও। গ্রীকদের সংস্পর্শে জোতির্বিদ্যা ও জোতিষবিদ্যার চর্চা ও উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দু ধর্মের চর্চা অব্যহত ছিল। শাসকেরা কোন ধর্মের প্রতি কোন বৈরী আচরণ করেছিলেন বলে মনে হয় না। গ্রীকদের প্রভাবে নাট্যকলার চর্চার নতুন মাত্রা পায়। পর্দাবিহীন যাত্রাপালার বদলে পর্দার ভিত্তিতে যবনিকাভিত্তিক নাটক চালু হয়েছিল। চিকিৎসাবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, রসায়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারত ও গ্রীকদের পরস্পরের জ্ঞান-বিজ্ঞান আদান প্রদানের ফলে উভয়ে উপকৃত হয়েছিল। বৈশি^ক সভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। যার উত্তরাধিকার ছিল ইউরোপীয় সভ্যতা। আরবরাই এই সভ্যতা ইউরোপে বহন করেছিল। ভারতের এই সকল জ্ঞান, সংষ্কৃতি, সাহিত্য, ভাষা ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বাঙালিরা সবচেয়ে বেশী আত্মস্থ করেছিল। বাংলা অঞ্চল থেকে বৃহৎ সা¤্রাজ্য গড়ে উঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়। ফলে এই অঞ্চল থেকে বৃহৎ গুপ্তসা¤্রাজ্যের উত্থান সহজ হয়ে পড়েছিল।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট