চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সামাজিক অস্থিরতা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

মাহমুদ আহমদ

১১ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক অস্থিরতা হঠাৎ করেই যেন প্রবল রূপ ধারণ করেছে। পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়জনিত একের পর বীভৎস ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশ। হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও আত্মহননের মিছিলে বেরিয়ে পড়ছে সমাজের এবং নৈতিকতার বিপর্যয় এবং অধঃপতনের ভয়ানক চিত্র। প্রতিদিনই ঘটছে নানা অঘটন। সারাদেশে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও খুন হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এসব খুনের বেশিরভাগ ঘটছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে। বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খ-িত লাশ। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর বরগুনার রিফাত শরীফের হত্যাকা- বড় ধরনের আলোড়ন তুলল দেশে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার- শত শত লোকের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে মারল সন্ত্রাসীরা, সঙ্গে থাকা স্ত্রী ছাড়া আর কেউ এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে। প্রাকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে আর আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করছি, সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে এই ঘটনা থেকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়।
আজ আমরা এতটাই অবক্ষয়ে জর্জরিত যে, বিবেকের যেন মৃত্যু ঘটেছে। যে দিকে তাকাই শুধু অস্থিরতা। মাত্র পৌণে এক ভরি স্বর্ণের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে হত্যা করা হলো পাঁচ ও ছয় বছর বয়সী দু’টি শিশুকে। এই শিশুহত্যার রহস্য উদঘাটনের মধ্যেই নরসিংদীতে ছয়, আট ও দশ বছর বয়সী তিন ভাই-বোনকে হত্যা করল আপন ভাই। অশান্তির জ্বালা মেটাতে মা অবুঝ শিশুকে শাড়ির সাথে বেঁধে ঝাঁপ দিচ্ছেন নদীতে। কুমিল্লায় দরজা আটকে এক গৃহবধূর হাত-পা বেঁধে গায়ে অকটেন ঢেলে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে পাষ- স্বামীর বিরুদ্ধে।
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করেছে এক বখাটে। স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় সাভারের সিরামিক্স বাজার এলাকায় গৃহবধূ ও তার স্বামীকে কুপিয়ে জখম করেছে বখাটেরা। একের পর এক মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে অসহায় শিশুদের ওপর দীর্ঘ দিন ধরে চলছে ভয়ঙ্কর নির্মমতার স্রােত। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ নারীকে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ছয় মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
আসক বলেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের হত্যা এবং নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। গত ছয় মাসে ৮৯৫ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৪ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ৪০ শিশু আত্মহত্যা করেছে, নিখোঁজের পর এক শিশু এবং বিভিন্ন সময়ে ১৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জন শিশুর। বর্তমানে যে সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থা তাতে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অশান্তি বাড়ছে। ফলে মানুষের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। আর এ হতাশা থেকে তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রাসী মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলো ফুটে ওঠে। সে আত্মবিশ্বাসী হয় না। তার মধ্যে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি কাজ করে। নৃশংস হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তি নিজে যেমন অন্যকে ধ্বংস করতে চায়, অন্যদিকে সে নিজেও এর শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুরাই নৃশংসতার শিকার হয় বেশি। কারণ শিশুরা দুর্বল। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিরোধও করতে পারে না। মূলত আমরা প্রতিনিয়ত যেসব পৈশাচিক আর হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি তা আসলে সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এসব আমাদের অবক্ষয় আর সামাজিক সঙ্কটের চিত্র। অনেক ক্ষেত্রেই সবার অজান্তে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও অসাম্য বিস্তার লাভ করেছে ভয়াবহ আকারে।
আজ নগর থেকে শুরু করে নিবিড় পাড়াগাঁয়েও ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের ছোবল। প্রযুক্তির অপব্যবহারে ফলে নিমেষে পাল্টে যাচ্ছে সমাজ। যুবসমাজ যেন আজ অস্থির আর তাই সমাজে বাড়ছে নানামুখী অস্থিরতা। নীতি আদর্শ এবং মূল্যবোধ যেন সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। নেত্রকোনার কেন্দুয়ার আঠারবাড়ি এলাকায় মা হাওয়া (আ.) কওমি মহিলা মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আবুল খায়ের বেলালী নিয়মিত একজন করে শিশুছাত্রীকে কক্ষে ডেকে নিতেন শরীর টেপাতে। এক পর্যায়ে অবুঝ শিশুদের ধর্ষণ করে দোজখের ভয় দেখিয়ে এ কথা কাউকে বলতে নিষেধ করতেন আর ধর্ষণের পর তিনি এ কথা প্রকাশ না করতে শিশুদের পবিত্র কোরআন শরিফ ছুঁইয়ে শপথও করাতেন। একটু ভেবে দেখি, মানুষের নৈতিক অবক্ষয় কতটা নি¤œমানের হলে এ কাজ করতে পারে। গত ৫ জুলাই সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার ওয়ারীতে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় সামিয়া আফরিন নামে ৭ বছরের এক শিশুকে। ৪ জুলাই রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া ইন্টার্ন ডাক্তারকে সিস্টার বলে সম্বোধন করায় রোগীর আত্মীয়কে দল বেঁধে পেটানো, প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা থেকে শুরু করে সামান্য ঝগড়ার রেশ ধরে অহরহ স্বামী-স্ত্রী হত্যাসহ একের পর এক নারকীয় ঘটনার অবতারণা ঘটছে সমাজে। আসলে লোভ, ন্যায়বিচার, বৈষম্য, নৈতিক শিক্ষার অভাব ইত্যাদি অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে, ফলে আত্মহত্যা ও হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা বেড়েই চলছে।
পারিবারিক কলহ, যৌনাচার, অশ্লীলতা, ধর্ষণ, খুন, ইভটিজিং, অ্যাসিড-সন্ত্রাস, শিশু হত্যা-নির্যাতন, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সামাজিক সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোয় ফাটল ধরছে, ঢুকে পড়ছে অবিশ্বাস। ফলে বাবা-মায়ের হাতে সন্তান বা বিপরীত, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে, যা সমাজ অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ।
এসব সামাজিক অস্থিরতার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে যুবসমাজ। অথচ তারা একটি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। যেভাবে একজন প্রখ্যাত ইসলামী নেতা বলেছিলেন ‘যুবকদের সংশোধন ব্যতিত জাতিসমূহের সংশোধন সম্ভব নয়’। ঠিক তাই, কোন জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যুবকদের ভূমিকা ব্যাপক।
অথচ তারা আজ শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মদ্যপ, ধর্ষক ও সন্ত্রাসী। ইতিহাস ঐতিহ্য আর ক্রমবর্ধমান সভ্যতার ক্রমবিকাশের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মানুষ তার আপন সত্তার কথা ভুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানান অপকর্মে। প্রশ্ন হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা এক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কী? বিশিষ্টজনদের মতে, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। সাধারণত দেখা যায়, ঢাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেক সন্তানদের মধ্যে মাদকাসক্ত বেড়ে গেছে। পিতা-মাতাও জানতে পারেন না কখন তাদের সন্তানরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে।
এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতিও জোর দিতে হবে। সন্তানদের প্রতি যদি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া যায় এবং তারা কী করছে, কোথায় সময় কাটাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়, তাহলে হয়তো সামাজিক অপরাধের মাত্রা অনেকটাই কমে যাবে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব, প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও মাদকের কারণে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। সহিংসতার বিকাশ ঘটছে। দেখা গেছে, যেসব নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে সেখানে খুনিরা হয়তো কখনও খুনি ছিল না। এ ক্ষেত্রে আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব ও মাদকের বিস্তারের কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের জিঘাংসা ও মানসিক অস্থিরতা কাজ করে। এর ফলে ব্যক্তি খুনের মতো জঘন্যতম কাজ করতে পিছপা হয় না। কিন্তু এ ধরনের পৈশাচিকতা কখনও কাম্য হতে পারে না।
শেষে এটাই বলবো, সামাজিক অস্থিরতা ও অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে পারিবারিক বন্ধন জোরদারের বিকল্প নেই। সেই সাথে ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি পরিবারের অভিভাবককে সন্তানের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট