চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

মহান আধ্যাত্ম সাধক হাতেমে আছাম্ম (রহ.) এর উপদেশ

ইসলামের আলোকধারা

মনিরুল ইসলাম রফিক

১১ জুলাই, ২০১৯ | ১২:৫৭ পূর্বাহ্ণ

খোরা সানের অধিবাসী হাতেম আছাম্ম (রহ.) ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ সংসার ত্যাগী, অদ্বিতীয় আবেদ, দুনিয়া হতে সম্পূর্ণরুপে পরাক্সমুখ, আখেরাতের প্রতি একনিষ্ঠ মনোযোগী। কথিত আছে, প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর হতে তার একটি মুহূর্তও মুরাক্বাবা এবং মুসাহাদা ব্যতীত অতিবাহিত হয়নি। সততা এবং খাঁটি নিয়ত ছাড়া তিনি তরিক্বতের পথে একটি কদমও রাখেন নি। হযরত জোনায়েদ বোগদাদী (রহ.) তার সম্বন্ধে বলেছেন, হাতেমে আছাম্ম (রহ.) আমাদের মধ্যে ছিদ্দিক পর্যায়ের লোক। নফসকে ফরমাবরদার করা, নফসের প্রতারণা ও ধোকা হতে রক্ষিত থাকা এবং নফসের বিশ্বাসঘাতক ধোকাবাজের পরিচয় সম্বন্ধে তার বহু জ্ঞানগর্ভ উক্তি রয়েছে। একবার এক ব্যক্তি এসে হাতেম আছাম্ম (রহ.) কে দাওয়াত করল। তিনি তার দাওয়াত কবুল করলেন না। যখন সে কাকুতি মিনতি করতে লাগল, তখন তিনি বললেন, আচ্ছা আমি তিন শর্তে তোমার দাওয়াত কবুল করব। (১) যেখানে ইচ্ছা আমি সেখানে বসব। (২) যা আমার পছন্দ হবে খাব। (৩) যা তোমাকে করতে বলব করতে হবে। দাওয়াতকারী শর্তগুলি স্বীকার করলে তিনি তার দাওয়াতে গমন করলেন। সেখানে গিয়ে তিনি নিমন্ত্রিত লোকদের পাদুকা রাখবার স্থানে বসে পড়লেন। লোকেরা বলল, “হযরত! এই স্থানটি আপনার বসার উপযুক্ত নয়। তিনি বলেন, ভাই! প্রথমেই আমি দাওয়াতকারীর সঙ্গে এ রূপ শর্ত করে নিয়েছি যে, আমার যেখানে ইচ্ছা আমি সেখানে বসব। অতঃপর যখন দস্তরখান বিছানো হলো, তখন তিনি নিজের আস্তিনের ভিতর হতে দু’টি রুটি বের করে খেতে আরম্ভ করলেন। উপস্থিত লোকেরা বলল, হযরত! আপনি গৃহস্বামীর এই খাদ্য হতে আহার করুন। তিনি বললেন, নিমন্ত্রণকালে তার সাথে এও শর্ত করেছি যে, আমার যা পছন্দ হবে আমি তাই খাব।’
আহার কার্য শেষ হলে যখন দস্তরখান উঠিয়ে নেয়া হল। তখন তিনি গৃহস্বামীকে ডেকে বললেন, লোহার তাওয়া গরম করে আন। সে তাই করল। হযরত হাতেমে আছাম্ম (রহ.) তার উপর নিজের পা রেখে বললেন, আমি দু’টি রুটি আহার করেছি। অতঃপর উত্তপ্ত তাওয়া হতে পা নামিয়ে তিনি বললেন, তোমরা কি এ বিশ্¦াস রাখ যে, তোমরা আজ যা কিছু খেলে, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কাল কিয়ামতের দিন তার প্রত্যেকটির হিসাব গ্রহণ করবেন? সবাই বলল ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, আমার মনে হয় তোমাদের সে বিশ্বাস নেই, বরং তোমরা তা অবিশ্বাস করছো। আচ্ছা যদি তোমাদের সে বিশ্বাস থাকে তবে তোমরা কল্পনা করে নাও যে, এটা কিয়ামতের ময়দান এবং পালাক্রমে প্রত্যেকে নিজের পা এই গরম তাওয়ার উপর রাখ এবং যা কিছু এই ঘরে আহার করেছো তার হিসাব দাও। এ কথা শুনে উপস্থিত লোকেরা বললো, এই গরম তাওয়ার উপর দাঁড়াবার সাধ্য আমাদের নেই। তিনি বললেন, চিন্তা করে দেখ, কিয়ামতের দিন হিসাব কেমন করে দিবে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন: অতঃপর তোমরা সকলেই অবশ্যই সে দিন নিয়ামত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।’ একথা শুনে সবাই বেদনায় কাতর হয়ে পড়ল। এমনকি সে নিমন্ত্রণের বাড়ি শোকালয়ে পরিণত হয়ে গেল।
হাতেম আছাম্ম (রহ.) বলতেনঃ বর্তমান যামানার আলেম ও যাহেদগণের অহংকারকে ওজন করলে দুনিয়াদার বাদশাহ ও আমিরদের অহংকার অপেক্ষা বেশী ভারী দেখা যাবে। সুরম্য অট্টালিকা ও সুভাসিত উদ্যানের জন্য অহংকার করিও না। কেননা বেহেস্তের চেয়ে উত্তম ও সুন্দর স্থান কোথাও নেই। অধিক নেক আমল করেছো বলে গর্বিত হয়ো না। কেননা তোমরা অভিশপ্ত ইবলিশকে দেখেছো যে, অত্যধিক ইবাদত ও নেক আমলের অহংকার করা উচ্চ মর্যাদা হতে কেমন করে নিকৃষ্ট স্তরে অবনত হয়েছে। যে ব্যক্তি হেদায়েতের পথে আগমন করে তার তিন প্রকারের মউতের স্বাদ উপভোগ করা উচিৎ। ক) মউতুল আরইয়ায অর্থাৎ অনাহার ক্লেশ। খ) মউতুল আসওয়াদ’ অর্থাৎ সবর ও ধৈর্য্য ধারণ করা। গ) মাউতুল আহমার অর্থাৎ লেবাসের জাঁকজমক পরিত্যাগপূর্বক ছেঁড়া ও তালিকাযুক্ত খেরকা পরিধান করা। তিনি আরো বলেছেন: অন্তর পাঁচ প্রকার ঃ (১) মৃত অন্তর (২) পীড়িত অন্তর (৩) আল্লাহর প্রতি অমনোযোগী অন্তর (৪) বিপরীতমুখী অন্তর (৫) সুস্থ অন্তর।
কাফেরের অন্তর মৃত। গুনাহগার মুসলমানের অন্তর পীড়িত। লোভ ও পেট পুজকের অন্তর আল্লাহ তায়ালা হতে গাফেল। নাস্তিক ও ইহুদিদের অন্তর বিপরিতমুখী, যেমন আল্লাহপাক তাদের উক্তি উদ্বৃত করে বলেছেনঃ আর তারা বলে যে, তাদের অন্তরসমূহ সত্য উপলব্ধি করার ব্যাপারে পর্দাবৃত। আর দ্বীনদার মুসলমান লোকের অন্তকরণই সুস্থ। দিন-রাত ইবাদতে মশগুল থাকা সত্বেও তারা আল্লাহ তায়ালার আরো ইবাদাত করার জন্যে সর্বদা প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং তাদের অন্তর মহান আল্লাহপাকের ভয়ে পরিপূর্ণ থাকে। উল্লেখ্য, হাতেমে আছাম্ম (রহ.) এর জম্ম ও মৃত্যুর তারিখ ইতিহাস বইগুলোতে দৃষ্টি গোচর হয়নি। তবে অনুমান করা হয় যে, তিনি আব্বাসীয় যুগের মনীষী ছিলেন।

লেখক : অধ্যাপক, কলামিস্ট, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট