চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবলে নৈতিকতায় অবক্ষয়

নুর মোহাম্মদ রানা

১৭ জুন, ২০১৯ | ১:২৬ পূর্বাহ্ণ

অপসংস্কৃতির কৃষ্ণ-কালো ধূম্রকুঞ্জ যে হারে বাংলাদেশের সামাজিক পরিবেশকে গ্রাস করে চলেছে তা এক কথায় বর্ণনাতীত। অপসংস্কৃতির অপ্রতিহত বিস্তারের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে অপসৃত হচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালিত মূল্যবোধভিত্তিক ধ্যান-ধারণা, নৈতিকতা, আদর্শ ইত্যাদি। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে নিছক জৈবিক পরিতুষ্টির চিন্তাধারা। যার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে। নৈতিকতাবিচ্ছিন্ন সংশয়বাদিতা, উন্নাসিকতার সুতীব্র প্লাবনে শিকড়বিহীন কচুরীপানার মত অস্থিরচিত্ত মানুষ ধাবিত হচ্ছে এক অনিশ্চিত অজানা গন্তব্যের পানে।
জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সমাজে বসবাসরত মানুষের প্রত্যেকটি কার্যকলাপই তাদের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। কোনো সমাজই তাদের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না। মূলত সংস্কৃতি এবং জীবন একে অপরের পরিপূরক। সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, “সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচা”। অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্য মানুষের নৈমিত্তিক প্রচেষ্টাই সংস্কৃতি। আর অপসংস্কৃতি হলো এর বিপরীত। আত্মার মৃত্যু ঘটিয়ে অসুন্দরের উপাসনা করে, অকল্যাণের হাত ধরে বেঁচে থাকাই অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি মানুষকে কলুষিত করে এবং জীবনের সৌন্দর্যের বিকাশকে স্তব্ধ করে দিয়ে শ্রীহীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
আজকের তরুণেরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অপসংস্কৃতি তাদের জীবনকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যুবসমাজ শুদ্ধ সংস্কৃতির সাধনার পথ থেকে প্রায় বিচ্যুত। তারা কলুষিত সংস্কৃতি তথা অপসংস্কৃতির শিকার। যুবসমাজের একটা বড় অংশকে সুকৌশলে করা হয়েছে আদর্শভ্রষ্ট। সুন্দর জীবনের পথ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্ধকার জীবনের পথে। তারা তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জগতে, অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মাদকের নেশায়। বিপুল সংখ্যক তরুণের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে অস্ত্র, জড়িয়ে ফেলা হয়েছে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকা-ে। তারা লিপ্ত হচ্ছে অসামাজিক কাজে। হিংসাশ্রয়ী-অশ্লীল চলচ্চিত্র, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী বিকৃত রুচির নাচ-গান, রুচিহীন পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি এভাবে তাদেরকে আকৃষ্ঠ ও অনুরক্ত করার গভীর নীলনকশা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে।
পোশাক-পরিচ্ছদে আমাদের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য ছিল। বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও চর্চা আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। জিন্স, টি-শার্ট, স্কার্ট এখন আমাদের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয়। শাড়ি-লুঙ্গি কিংবা পাজমা-পাঞ্জাবি এখন আর তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় না। আমাদের মেয়েদের অনেকেই স্বল্পবসনকে আধুনিক জীবনের নমুনা বলে ভুল করে। পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ফলে তারা একদিকে যেমন আধুনিক জীবনের ধারাকে ধরতে পারে না, তেমনি দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তারা একটি দোদুল্যমান অবস্থায় পতিত হয় অবশেষে জীবন হয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ও হতাশাপূর্ণ।
বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে চরমভাবে আঘাত করছে, সেটি হলো আমাদের ধর্মীয় জীবনবোধ ও নৈতিক শিক্ষা। পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতির ব্যাপক প্রচারের ফলে আমাদের যুবসমাজে ধর্মনিষ্ঠা এবং নৈতিকতাবোধ ক্রমহ্রাসমান। সুখী সুন্দর ও শান্তিময় জীবনের জন্য এসব কিছুর চেয়ে জীবনে সুনীতি অনুসরণ খুবই জরুরি। বিদেশি সংস্কৃতির আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে প্রধান অনুুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উদ্দাম ভোগ-বিলাসিতা ও উচ্ছৃংখলতার জন্ম দেয়। নতুন সংস্কৃতির উন্মত্ততায় সে সময়ে যে অনাচার ও উচ্ছৃংখলতা দেখা দিয়েছিল সেগুলোকে বর্জন করে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সদর্থক ইতিবাচক দিকগুলোকে গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিল সমাজ-সংস্কারক বাঙালি মনীষীরা। বর্তমানে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার অবাধ সুযোগে আমাদের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পাশ্চাত্য যুবসমাজ যে মাদকনেশা ও অবক্ষয়ে আক্রান্ত, আকাশ-সংস্কৃতির মাধ্যমে তা ক্রমবিস্তার লাভ করছে আমাদের তরুণ সমাজে। অসংযত পাশ্চাত্য মানসিকতা, উগ্র বিদেশিয়ানা ও ভোগপ্রবণ স্থূলতা আজ আমাদের সংস্কৃতির মূলধারাকে গ্রাস করতে বসেছে। বৈদেশিক সংস্কৃতির নির্বিকার গ্রহণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য এখন হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে অপসংস্কৃতির প্রবল প্রতাপ লক্ষণীয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ করার এক উদ্ভট জোয়ার চলছে দেশে। বিশেষত এ দেশের তরুণসমাজ আজ দিকভ্রান্ত দিশেহারা। তাদের বেঁচে থাকার সাথে নীতির সম্পর্ক নেই। দুর্নীতি এখন সামাজিকভাবে স্বীকৃত। আর এখন অনৈতিকতার সূত্রপাত হচ্ছে মানুষের অসৎ জীবিকার্জনের হাত ধরে। সৎভাবে যে জীবিকার্জন করে না তার পক্ষে অপসংস্কৃতির দাসত্ব ছাড়া উপায় নেই। অশ্লীলতা, নোংরামি, খুন, ছিনতাই, প্রতারণা-সবই অপসংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। আমাদের সমাজ আজ এসবেরই দাসত্ব করে চলেছে।
ভারতীয় টিভি সিরিয়াল আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ নেশার মতো। নেশা যেমন ব্যক্তি, পরিবার,সমাজ বা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে, ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও একটি দেশকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়। আমাদের পারিপাশির্^ক ঘটনাগুলো তাই প্রমাণ করে। বিদেশী সিরিয়াল নাটকগুলো আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিবার প্রথাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। সমাজের মধ্যে এইসব নেতিবাচক পরিবর্তন বাতাসের গতিকেও হার মানায়। একশ্রেণির খুচরা অন্ধ বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতে নারাজ। হিন্দি সিরিয়ালে কী দেখানো হয়? ওই সব সিরিয়ালে যা দেখানো হয় তা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়! হিন্দি সিরিয়ালের মূল দর্শক হচ্ছে দেশের গৃহিণী ও তাদের সন্তানরা। প্রতিটি সিরিয়ালে অবৈধ প্রেমকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকে।
জাতীয় সংস্কৃতির চরম ক্রান্তিকালে যুবসমাজের সিংহভাগ যখন এক অনিশ্চিত গন্তব্যহীন মোহগ্রস্ত জীবনের পথ বেছে নিচ্ছে, বস্তাপচা সংস্কৃতির শিকার হয়ে যখন তারা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন এই যুবসমাজেরই বিচারবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত অপর একটি অংশ-যারা শত বাধা মোকাবিলা করে সামাজিক দায়বদ্ধতায় এগিয়ে আসতে হবে ত্রাতার ভূমিকায়।
পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যে বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আমাদের নেই। তাই এর মধ্যে থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আর স্মারককে বাঁচিয়ে রেখে চলতে হবে। এই ব্যাপারে সকল শ্রেণির মানুষকে সচেতন হতে হবে। দেশীয় সংস্কৃতি লালন করতে হবে, আর মোকাবিলায় টিকে তাকার জন্য দেশীয় সংস্কৃতিকে করে তুলতে হবে যুগোপযোগী। সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে যুবসমাজকে অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। যুবশক্তির পুনরুজ্জীবন আর চাই শুভ সুন্দর জীবনের নবতর দীক্ষা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গণমাধ্যম কর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট