চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

স্মরণ : চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী

মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্ভেজাল ভালোবাসা দিয়ে মানবসেবা করেছেন। ’৬০ এর দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা। মহিউদ্দীন চৌধুরীর পিতা হোসেন আহমদ চৌধুরী চাকুরী করতেন আসাম রেলওয়েতে। সেই সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। মেট্টিক পাশ করেন মাইজদী সরকারী স্কুল থেকে। পিতার স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তাইতো ভর্তি হয়েছেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে ভর্তি হলেন। এর কিছুদিন পরে সরকারী বাণিজ্য কলেজে অবশেষে চট্টগ্রামের ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার সিটি কলেজে ভর্তি হয়ে শুরু করেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন।
ষাটের দশকে এসএসসি ও এইচএসসি পাশ করেন। ’৬৮ সালে স্নাতক ডিগ্রী। এর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ’৬২সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ও ’৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ’৬৬ এর ছয়দফা আন্দোলনে মরহুম এমএ আজিজ ও জহুর আহম্মদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে থেকে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেন তিনি। ’৬৮ সালে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। সভাপতি ছিলেন বাঁশখালীর কৃতি সন্তান বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদ। ’৬৯ এর গণআন্দোলনে শহর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব প্রদান করেন তিনি। ’৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামীলীগের দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। ’৭১ এর মহান মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছেন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদী হয়ে উঠেন মহিউদ্দীন চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর অনেকে দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। খুনীদের সাথে আঁতাত করে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ফায়দা নিয়েছিলেন। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি এই বীর। শুরু হয় নতুন উদ্যোমে আন্দোলন-সংগ্রাম। মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে বারবার কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ’৮০ দশকে চট্টগ্রামের শহর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার সময়ে সভাপতি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সাবেক মন্ত্রী মরহুম এমএ মান্নান। ১৯৮৬ সালে নিজ এলাকা রাউজান থেকে প্রথম দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেন। স্বৈরাচার এরশাদ এর ভোট ডাকাতি ও চর দখলের মত কেন্দ্র দখল করে নির্বাচিত হলেন যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী। থেমে ছিলেন না মহিউদ্দীন ভাই। ’৯১ সালে কোতোয়ালী আসন থেকে আবারো মনোনয়ন পেলেন কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বাকশাল থেকে কাস্তে মার্কায় নির্বাচন করলেন সিরাজ মিয়া।

ভোটের হিসাব নিকাশে আবারো পরাজিত হলেন মহিউদ্দীন ভাই। ১৯৯৩ সালে বন্দরটিলা ট্রাজেডির কথা আমরা অনেকেই জানি। নৌবাহিনীর সাথে এলাকার সাধারণ মানুষের একটি সংঘাতে বহুলোক হতাহত হয়েছিলন। সেইসময় নিহত মানুষের লাশ দাফনসহ সব ধরনের কাজে মহিউদ্দিন চৌধুরী সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ান। তার সেই কর্মকা-ে দেশ জুড়ে তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেই খুশীর দিন এলো ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়র নির্বাচনে লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত করলো ক্ষমতাসীন বিএনপি ও চার দলীয় জোটের প্রার্থী এড. মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনকে। মানুষের ভোটের অধিকার ফিরে পায় ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময় বাবু ভাই, নাছির ভাই (বর্তমান মেয়র) জোট সরকারের একটি ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। নাছির ভাই কলকাতা থেকে আমাকে ফোনে বলেছিলেন মহিউদ্দীন ভাইয়ের পক্ষে নির্বাচনে কাজ করতে। আধাজল খেয়ে আমরা ভোটযুদ্ধে নেমে পড়ি। নির্বাচন প্রচারণাকালীন সময়ে আন্দরকিল্লা মোড়ে নাগরিক কমিটির উদ্যোগে মহিউদ্দীন ভাইয়ের নির্বাচনী প্রচারণা সভা হয়েছিল। সেই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন দলের সভাপতি (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং আরো উপস্থিত ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ, ওবায়দুল কাদের, আ.ফ.ম বাহাউদ্দীন নাসিম, ইছহাক মিয়া, নুরুল ইসলাম বি.এস.সি, মরহুমা আইভী রহমানসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। সভাটি পরিচালনা করেছিলাম আমি। মহিউদ্দীন ভাই শুধু রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না তিনি ছিলেন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সৃজনশীল রাজনৈতিক কর্মী গড়ার কারিগর। কখনও গালি দিতেন আবার কখনো আদর করে কাছে ডেকে নিতেন এই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ’৯৫ সালে খালেদা পতন আন্দোলনে ঢাকার পান্থপথে বিশাল সমাবেশ হলো। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের অনেক বড় নেতারা সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। চট্টলবীর মহিউদ্দীন ভাই যখন বক্তব্য দিতে উঠলেন তখন করতালি আর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হলো ঢাকার আকাশ বাতাস, প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য। মানুষের ভীড় লেগে গেলো সভামঞ্চের আশেপাশে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসে আবারো গ্রেফতার হলেন মহিউদ্দীন ভাই। এবার চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষসহ দলমত নির্বিশেষে সকলেই রাজপথে নেমে এসে সমগ্র চট্টগ্রাম অচল করে দিলেন। খালেদা জিয়া বাধ্য হলেন তাকে ছেড়ে দিতে।

মহিউদ্দীন চৌধুরী একটি মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠানের নাম। জীবন যৌবনের বেশীরভাগ সময় মানুষের মঙ্গলে কাটিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাঁশখালী জলদী পাইলট স্কুলের মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগের জনসভায় এসেছিলেন সেই সভাটি আমি সঞ্চলনা করি। বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে নেত্রী মঞ্চে এসেই আমার কাছ থেকে বক্তাদের তালিকা নিয়ে সমস্ত বক্তার নাম কেটে দিলেন সময়ের স্বল্পতার কারণে। তবুও আমি মহিউদ্দিন ভাইয়ের নাম মাইকে ঘোষণা করে দিলাম। এর পর নেত্রী আমাকে ডেকে বললেন তুমি কি মহিউদ্দিন ভাইয়ের লোক? আমি তো জানি তুমি বাবু ভাইয়ের লোক। মহিউদ্দিন ভাইয়ের প্রতি আমার প্রচ- দুর্বলতা ছিল যদিও গ্রুপ রাজনীতি আমরা নাছির ভাইয়ের সাথে করতাম। স্কুল পালানো ছেলে যেমন নজরুল (বিদ্রোহী কবি) হবে না, তেমনি শত আন্দোলন সংগ্রামের পরও একজন মহিউদ্দীন চৌধুরীর জন্ম হবে না।

২০০১ সালে বিএনপি চারদলীয় জোট সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘু ও আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের উপর স্টিম রোলার চালানো শুরু করে। ঐসময়ে বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী (বর্তমান এমপি) একাধিক মামলার হুলিয়া নিয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। ঐ সময় নেতাকর্মীদের খবর নেওয়ার কেউ ছিলো না। মহিউদ্দীন ভাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতে পাঠান। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ মহিউদ্দীন চৌধুরী শেষ বারের মত গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ ১৯ মাস কারানির্যাতন ভোগ করে ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর কারাগার থেকে মুক্তি পান। ঐ সময় তাঁর মেয়ে টুম্পা ব্যাংককে একটি হাসপাতালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। ২০০৮ সালের ১৮ অক্টোবর টুম্পা মৃত্যুবরণ করেন। মেয়ের অকাল মৃত্যুতে নির্বাক হয়ে যান তিনি। অনেকে মনে করেন মহিউদ্দীন ভাই কঠিন হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু আমি দেখেছি কন্যা শোকে তিনি বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। ২০০৬ সালে এক মর্মান্তিক সড়কদুর্ঘটনায় আমার ছেলে মিনহাজুল আলম মারা যায়। আমাকে জড়িয়ে ধরে মহিউদ্দীন ভাই বলেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু হলো সন্তানের লাশ পিতার কাঁধে উঠানো। সন্তান হারানোর বেদনা আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না। অত্যন্ত অতিথিপরায়ন ছিলেন মহিউদ্দীন ভাই। খালিমুখে ঘর থেকে কোনদিন মেহমানকে যেতে দিতেন না।

২০১৭ সালে ১৫ ডিসেম্বর পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর জানাজায় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষের ঢল নেমেছিল। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান একটি টেলিভিশন সাক্ষাতে বলেছিলেন, মহিউদ্দীন ছিলেন গণমানুষের নেতা। তার মৃত্যুতে চট্টগ্রামের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হবার নয়। আসুন আমরা সকলে মিলে মহিউদ্দীন ভাইয়ের জন্যে দোয়া করি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাত বাসী করেন। আমিন।

মোঃ. খোরশেদ আলম শ্রম সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট