চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : সাংবাদিক হেলাল

হুমায়ন রায়হান আজাদ

৩০ অক্টোবর, ২০১৯ | ২:০৭ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা ও সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রায় যুগপৎ নেতৃস্থানীয় ছিলেন সাংবাদিক হেলাল হুমায়ন। সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তার ভূমিকা ছিল নিরন্তর। চট্টগ্রামের প্রয়াত মনীষীদের স্মরণে তিনি ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন। আজ এ বরেণ্য সাংবাদিক ও সমাজসেবীর ৩য় ইন্তেকালবার্ষিকী। বহুমুখী প্রতিভার উজ্জ্বল প্রতিনিধি হেলাল হুমায়ন দৈনিক নয়া দিগন্তের চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পারিবারিক সূত্রে উর্দু-ফার্সি সাহিত্যে দক্ষতা অর্জন এবং ইউনানী চিকিৎসার অগ্রগতিতে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান সর্বমহলে স্বীকার্য। উদার দৃষ্টিভঙ্গি, কাব্যরসিক মন, সমাজসেবা ও নির্মল আতিথেয়তা সর্বোপরি অমায়িক ব্যবহারের মাধুর্যে হুমায়ন ভাই ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে সমান প্রিয়।

সাংবাদিক হেলাল হুমায়ন ১৯৫৬ সালের ৬ জুলাই সাতকানিয়া উপজেলাধীন চরতী ইউনিয়নের তালগাঁও গ্রামের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ মাওলানা আবদুল মজীদ প্রকাশ বুড়া মৌলভী ছাহেবের স্বনামধন্য কনিষ্ঠ পুত্র সাড়া জাগানো উর্দু কবি ও ইউনানী চিকিৎসাবিদ ক্বারী মাওলানা ইসমাঈল হিলালী (১৯১৭-১৯৮৮) এবং মাতা লোহাগাড়া উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের সুপ্রসিদ্ধ বড় মাওলানা পরিবারের কন্যা আনছারা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। হেলাল হুমায়নের দাদীর নাম লুৎফুন্নেছা আর প্রপিতামহ মাগনে আলী মিয়াজী। এ পরিবারের সন্তানেরা সবাই নামজাদা আলিম ও পরহেযগার ব্যক্তি হিসেবে সর্বত্র সুপরিচিত ছিলেন।

হেলাল হুমায়ন যে পরিবারে প্রতিপালিত হন সে পরিবেশেই ছিল সাহিত্য-সাংবাদিকতা চর্চার নান্দনিক ঐতিহ্য। তাই ছাত্রজীবনেই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তার লেখালেখির যাত্রা। ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করে ১৯৮২ সালে তিনি বেছে নেন সাংবাদিকতা নামক জনকল্যাণমুখী পেশা। তিনি দৈনিক দেশ বাংলা, দৈনিক অর্থনীতি, খবরপত্র এবং ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেস প্রভৃতি দৈনিকে চট্টগ্রাম অফিসের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। সর্বশেষ জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে আমৃত্যু তিনি বিশেষ প্রতিনিধি ও ব্যুরো চিফ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর থেকে চট্টগ্রামের ধর্ম-সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি-রাজনীতি বলতে গেলে সবকিছুর জন্য হেলাল হুমায়ন ছিলেন জীবন্ত ইতিহাসগ্রন্থ। চট্টগ্রামে যারা স্ব স্ব অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ তিনি তাদের কর্মময় জীবনের স্মরণার্থে বের করেন প্রামাণ্য স্মরণিকা আর আয়োজনে ভূমিকা রাখেন নাগরিক শোকসভা। অন্ততপক্ষে ১৫টির অধিক স্মরণিকা সম্পাদনার সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও সৎ সাংবাদিকতার সাহসী সৈনিক হেলাল হুমায়ন গ্রামীণ জনপদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন আল হেলাল ডিগ্রি কলেজ, আল হেলাল মহিলা মাদরাসা, তালগাঁও আল হেলাল প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরো একাধিক মসজিদ ও মাকতাব। তার শিক্ষানুরাগী পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম তিব্বিয়া কলেজ ও বায়তে খোদা মসজিদের তিনি আজীবন পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

সদা সরব হেলাল হুমায়ন; দেশ ও জাতির কল্যাণ ভাবনায় বিভোর থাকতেন তিনি। সমাজ ও দেশের মঙ্গল কামনা ও স্বার্থ রক্ষায় তিনি নানান সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হন। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক সমবায় সমিতির সহ-সভাপতি এবং চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ব্যবস্থাপনা কমিটি ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম ইউনানী তিব্বিয়া কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক এসোসিয়েশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমাজ কল্যাণ ফেডারেশনের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদের সদস্য হিসেবে তিনি ইসলামী তামাদ্দুন-তাহযীবের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আনজাম দেন। তিনি সবার সাথে সমানভাবে মিশতে পারতেন। দল মত নির্বিশেষে সমাজসেবা করতেন। হামদ-না‘ত, গজল ও উর্দু কাব্যে তার মনকাড়া কন্ঠ সবাইকে বিমুগ্ধ করতো। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক। পিতৃভক্ত এ একমাত্র পুত্র ফি বছর বাবার মৃত্যু বার্ষিকীতে ইছালে সাওয়াব মাহফিলের আয়োজন করতেন।

জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকায় তার বাবার সচিত্র জীবনবৃত্তান্ত ছাপানোর ব্যবস্থা নিতেন। তিনি প্রিয় বাবার হাদিয়া স্বরূপ উর্দু কবিতা ও হাকিমী চিকিৎসায় বিশেষ দক্ষতা হাছিল করতে সক্ষম হন এবং আজীবন এতদুভয়ে নিজের সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখেন। নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রামে যারা দেশ ও জাতির কল্যাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে কলম ধরেছিলেন হেলাল হুমায়ন ছিলেন তাদের মধ্যমণি।

রায়হান আজাদ এমফিল গবেষক

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট