চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

উড়নচ-ী একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস

সিরাজুল মুস্তফা

২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২৫ পূর্বাহ্ণ

একজন লেখকের কলম একটি ধারালো তরবারির চেয়েও অনেক ভয়ংকর। লেখেন তবে নিজেকে আড়ালে রাখেন এমন লেখকদের মাঝে মান্যতম মহি মুহাম্মদ। তাঁর লেখনি না পড়ে বুঝার উপায় নেই যে তিনি কি মাপের লেখক। শব্দের পর শব্দকে তিনি যেভাবে সাজান তা এক অদ্ভুত শিল্প-নিদর্শন। আধুনিক লেখকদের মাঝে এই শব্দ-চয়নের নতুনত্ব তাকে পাটক প্রিয় করে তোলে। চট্টগ্রামের মতন একটি জায়গায় থেকে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন চাট্টিখানি কথা নয়। সেই জাযগায থেকে বিবেচনা করলে মহি মুহাম্ম্দ ভাগ্যবান লেখক। তাঁর লেখার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে পাঠক সমাজে। তার প্রতিটি লেখার মতন ‘উড়নচ-ী’ উপন্যাসটিও অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

ইমতিয়াজ চরিত্রটি এখানে বারেবারে দৃশ্যপট বদলেছে। সে মূলত উড়নচ-ী স্বভাবের, কখন কি করে তার কোন নির্দিষ্টতা নেই। ফটিক রেগে গাল দেয় ইমতিকে ‘তুই শালা উড়নচ-ী না একটা খাটাশ চ-ী’। পান্নার বিয়ের খবর পেয়ে মূলত ফটিকের মেজাজ বিগড়ে যায়। পান্না ইমতুর খুঁজে ফটিকের বাসায় আসে। সেসময় ফটিক মুক্তার দেয়া চিঠি পড়ছিল। তাতে ভিলেনের মতন ব্যাঘাত ঘটায় পান্না। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ে সে। হতচকিত হয়ে ওঠে ফটিক। দরজা খুলে দেখে পান্না। সে তার হাতে বিয়ের চিঠি ধরিয়ে দেয়। ফটিক পষ্ট দেখতে পায় তখন পান্নার চোখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে নোনা জল ঝরছিল। ইমতু মানবিক সাহসী ছেলে। ছোট বেলায় মোটু আংকেলের সাথে সে বাজী ধরে অমাবস্যা রাতে চিতা খোলায় খুঁটি আটকানোর কাজে যায়। দুরন্ত সাহসের জোরে। একবার মাছ ধরতে গিয়ে বেলাল মামা আর ইমতু এক ভুতুড়ে অবস্থায় পতিত হয়। এভাবেই কাটে বেলাল মামার সাথে ইমতুর শৈশব-কৈশোর। রং পাল্টাতে রঙের শহরে অজপাড়া গাঁ ছেড়ে একদিন ইমতু চলে আসে শহরে। এখানে খাপ খেতে তার বেগ পোহাতে হয়। তবে তা কিছুদিনের মাঝেই কেটে যায় দীপ্র, সুজন এদের সংস্পর্শে। কলেজ জীবনে ঝুমার সাথে প্রেমে ঝড়ায় সে। বসন্ত উৎসবের দিন মন্দিরার সাথে রিকশায় ছড়া নিয়ে তালগোল পাকানো, সেদিন মন্দিরাকে বিব্রতই করেছিল। অনেকদিন দেখতে না পাওয়ায় ঝুমার মনদ্বারে শ্রাবণের উপচে পড়া জল ভিজিয়ে দেয় তার চৌকাঠ। নানানভাবে ফুসলিয়ে সে ইমতিয়াজের সাথে দেখা করে। তারপর বেয়াড়া প্রেমিকার মতন সে তাকে লুটেপুটে সর্বশান্ত করে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় না ঠেকার পর ইমতু আর ঝুমার মাঝে দূরত্ব বাড়ে। কিছুদিন পর খবর আসে ঝুমার বিয়ে। ইমতিয়াজ তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ইউসুফ তাকে বলে, ‘মেয়ে মানুষ চৌকাঠ পেরোলেই সব ভুলে যায়।’ তুই তাকে নিয়ে কেন অযথা ভাবছিস! পিতাও একসময় পুত্র সুখ ভুলে যায়। ঠিক একইভাবে ইমতুও একদিন ভুলে যায় ঝুমাকে। সেন্ট্রাল প্লাজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইমতু। ইউসুফ আসতে দেরি হওয়ায় সে চা গিলে গলা ভিজাতে চায়। দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, কত রঙ বেরঙের বাতি জ্বলছে এ শহরে। কত রূপসী এই শপিংয়ে ঢুকছে বেরোচ্ছে। এক রুপসী কন্যার ভেতর ইমতুর চোখ আটকে যায়। তার শরীরের মাতাল করা পারফিউমের ঘ্রাণ তাকে মাত করে দেয়। সে দেখতে পায় মেয়েটি তাকে আহ্বান করছে। সে অবাক হয়! কেমন মেয়ে মানুষরে বাবা! তার দিকে বেহায়ার মতন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তাকে আহ্বান করছে। পরে সে বুঝতে পারে মেয়েটি ছিল মূলত নিশিকন্যা। ঢাকা শহরটা সেই কবে রসাতলে গেলো। চট্টগ্রামটাও বাকি রইল না! ইমতু একটি টিউশন করত। সাবিহাদের বাসায়। সাবিহার বোন বৃষ্টি আর জিয়াদকে সে পড়াত। জিয়াদকে দেখে তার মায়া হতো। গল্পের মূল কাহিনি এখান থেকেই শুরু হয়। এখানে উঠে আসে মানবিকতা, বুদ্ধি ও সাহসিকতার এক অকুতোভয় গল্প। হঠাৎ একদিন সাবিহা ফোন করে জানায় তার দ্রুত রক্তের প্রয়োজন। বৃষ্টিটা বোধহয় আর বাঁচবে না। এক ব্যাগে হবে? না। ইমতু পাগলের মতন ছুটে হাসপাতালে। রিকশাআলা তার শারীরিক ভাষা সাবিহার সাথে ফোনে কথা বলা দেখে বুঝতে পারে ইমতুর রক্ত প্রয়োজন। সে বলে বসে ‘মামার কি রক্ত লাগবো! আমি ও দিতে চাই। এক ব্যাগ।’ ইমতু বলে কি টাকা নিবা নাকি? কত নিবা? তখন রিকশাআলা মন খারাপ করে উত্তর দেয়,‘ ছি ছি গরীব বলে কি ভাই এরকম ভাবছেন! গরীব বলে কি মানবিকতাও থাকার অধিকার নাই আমাদের?’ এখানে রিকশাআলা মানবিকতার এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে। বৃষ্টি আর ফিরতে পারেনি। ইমতিয়াজের পঙ্গু পা ভাল করতে অনেক টাকা দরকার। তার দাদার দাদা গোলামুর তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে কবরস্থ করে আম বাগানের তলে। তাতে তার পরিহিত সকল সোনা জওহরতগুলো পুঁতে দেন। ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ।। আম বাগানের নিচে কোথায় যে পুঁতে রাখেন তার হদিস কেউ পায়না। জিয়াদের পা ভাল করতে এই গুপ্তধন উদ্ধারে নামে ইমতু। পথে পথে সে নানান বাধার সম্মুখিন হয়। অনেক কষ্টেসৃষ্টে সে একদিন গোলামুরের চামড়ার ডায়েরিটা উদ্ধার করে। সাবিহার চাচা জাহেদ গুলবদিন ও তার দাদুকে বেঁধে রেখে বাধ্য করে এই গুপ্ত ধনের ম্যাপটি ইমতুর কাছ থেকে ভাগিয়ে আনতে। তার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উদ্ধার হয় কাক্সিক্ষত গুপ্তধন। ইমতু এ’কদিনে গুলবদিনের নাচের প্রেমে পড়ে যায়। যাবার বেলা ইমতু গুলের মুখোমুখি হয়ে জানাল, মনের মতন সে একটা রাত চায়। সে রাতে চাঁদ থাকবে আর গুল থাকবে। সাকি শরাব সবই থাকবে। সাথে গুলের পাগল করা নৃত্য থাকবে। ইমতু চলে যায়। তখন যদি সে পেছন ফিরে একবার তাকাতো দেখতে পেত গুলের সেই অদ্ভুত আলোভরা চোখদুটো টলমল করছে। এই উপন্যাসটিতে রয়েছে প্রেম, এডভাঞ্চার, মানবিকতা। এই তিনের মিশেলে দারুণ ছন্দময় লেগেছে এই উপন্যাসটি। উড়নচ-ী পাঠকের হৃদয়ে দীর্ঘজীবী হোক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট