চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিআরবির বাণিজ্যিকীকরণ গ্রহণযোগ্য নয়

এ এম এম নাসির উদ্দিন

১৯ আগস্ট, ২০২১ | ৩:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সিআরবি ঘিরে অশনি সংকেত। শনি ভর করেছে সিআরবি’র কাঁধে। শোনা যাচ্ছে চট্টগ্রামের সিআরবি চত্বরে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্বে হাসপাতাল নির্মাণের জন্যে একটা বেসরকারি কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে বা করতে যাচ্ছে। বিষয়টি ঘিরে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ এ প্রস্তাবিত প্রকল্পের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। সঙ্গতভাবেই প্রকল্পটি নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া, ক্ষোভ, শঙ্কা এবং অনুভূতির প্রতিফলন প্রতিনিয়তই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় প্রকল্পটির বিরোধিতা চট্টগ্রামের গ-ি পেরিয়ে সারাদেশ এমনকি বিদেশে প্রবাসীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে।

কি কি শর্তে বেসরকারি কোম্পানি হাসপাতাল নির্মাণ করবে, কি প্রক্রিয়ায় কোম্পানিটি বাছাই করা হয়েছে (প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র বা অযাচিত প্রস্তাব), সাধারণ জনগণের কথা বাদ দিলেও রেলওয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবা পাবে কিনা ইত্যাদি বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে এটি নির্দ্বিধায় বলা যায় বেসরকারি কোম্পানিটি শুধুমাত্র জনসেবার মানসে বা দয়া দাক্ষিণ্যের জন্যে হাসপাতালে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়নি। এর পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছেন তাদের বিবেচনা আর যাই হোক রেলওয়ের স্বার্থ, জনস্বার্থ কিংবা রেলওয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের স্বার্থ নয়। কোম্পানিটির আগ্রহে নিঃসন্দেহে ব্যবসায়িক স্বার্থতাড়িত। কোম্পানিটিকে তাড়া করছে মুনাফার হাতছানি। হাসপাতালটি স্থাপনের মূল লক্ষ্য বাণিজ্যিক। উল্লেখ্য, সিআরবি চত্বরে হাসপাতাল নির্মিত হলে পরবর্তীতে অনিবার্যভাবেই আশে-পাশে অনেক সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠবে। এ ধরনের হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা অনিবার্যভাবেই ব্যয়বহুল যা সাধারণ জনগণের নাগালের বাহিরেই থাকে। এ ধরনের হাসপাতাল গরিবের জন্যে নয় এবং এটি সচ্ছল ও ধনিক শ্রেণির সেবায়ই নিবেদিত হতে বাধ্য। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার (ইউনিভার্সেল হেলথ কেয়ার) একটা মৌলিক শর্ত হচ্ছে সবার জন্যে অব্যাহতভাবে সাশ্রয়ী মূল্যে (ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে) মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ যা এসডিজি’র একটা গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রাও বটে। বলাবাহুল্য, প্রস্তাবিত হাসপাতাল সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার এ শর্ত পূরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

চাকরির কল্যাণে আশির দশকে প্রায় সাত-আট বছর সিআরবি’র কাছেই সরকারি বাসভবনে থেকেছি। প্রাতঃকালীন বা বৈকালিক ভ্রমণে আমার বাটালি হিল অথবা সিআরবি চত্বরে বিচরণ ছিলো দৈনন্দিন রুটিনের অংশ। ওই সময়ে সিআরবি’র সাথে গড়ে উঠে আমার আত্মার সম্পর্ক। শহরের যান্ত্রিক জীবনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে মুক্ত বাতাসে অবগাহনের একটা স্থান হিসেবেই পেয়েছিলাম সিআরবিকে। চট্টলবাসীকে সিআরবি অদ্যবধি অব্যাহতভাবে সে সুযোগটাই দিয়ে এসেছে। সবুজ নৈসর্গিক পরিবেশে জীববৈচিত্র্যের সমারোহে শতবর্ষী গাছের ছায়ায় নিঃশ্বাস নেবার অপূর্ব সুযোগ করে দিয়েছে সিআরবি চত্বর। রাত-দিন, সকাল-বিকাল এখানে জড়ো হয় হাজারো মানুষ। সিআরবি মুখরিত হয়ে উঠে বিনোদন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিয়াসীদের পদচারণায়। এ স্থান ছাড়া চট্টলবাসীর শহরে নিঃশ্বাস ফেলার আর জায়গাও নেই। সাম্প্রতিককালে সিআরবি চত্বর সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায়শই দেখা যায় ওই চত্বরে আনন্দ উল্লাসে ব্যস্ত রয়েছেন ছেলে যুবা নারী পুরুষ নির্বিশেষে হাজারো শহরবাসী। এখানে বসে বৈশাখী মেলা, সারা বছরই হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে সিআরবি চত্বর হয়ে উঠেছে বিনোদনের একটা আকর্ষণীয় প্রাণকেন্দ্র, যেখানে নগরবাসী খুঁজে পায় প্রাণের স্পন্দন।
সিআরবি চত্বরে হাসপাতাল তথা বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের সংবাদে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের মতই গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি। এ প্রকল্পের কারণে সিআরবি’র পরিবেশ প্রতিবেশ ধ্বংস হবে, নাকাল হবে জীববৈচিত্র্য। চট্টলবাসী হারাবে বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের আকর্ষণীয় কেন্দ্র এবং নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকু। চট্টলবাসী হাসপাতাল চায়, চায় শহরের এবং দেশের উন্নয়ন। কিন্তু পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, পরিবেশ বান্ধব। চট্টগ্রাম শহরের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি চত্বরে হাসপাতাল চট্টলবাসী চায় না। হাসপাতাল স্থাপনের নামে সিআরবি’র বেসরকারিকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণ গ্রহণযোগ্য নয়।

সিআরবি-টাইগারপাস এলাকা চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে সুন্দর অংশ বললে অত্যুক্তি হবে না। বৃটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিলো চট্টগ্রামের সিআরবি। শহর জুড়ে এবং এর আশে-পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রেলওয়ের অনেক জায়গা। তাছাড়াও রয়েছে বিস্তর জায়গা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। চট্টগ্রাম হাটহাজারী রোডের আশে-পাশেও বেসরকারি মালিকানাধীন জায়গা পাওয়া সম্ভব। রেলওয়ের অনেক জায়গা ইতোমধ্যে বেহাত হয়েছে। রেলওয়ের জায়গা দেখলেই হামলে পড়ার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। হাসপাতাল নির্মাণের জন্যে উপযুক্ত বিকল্প স্থান বিবেচনা করতে হবে। কোন অবস্থায়ই সিআরবি চত্বরে হাসপাতাল নির্মাণ নয়। শুধু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা বা শত শত শতবর্ষী গাছের কারণে নয়, ঐতিহ্যগত কারণেই সিআরবি এলাকাকে রাখতে হবে অবিকৃত। সিআরবি’র শতবর্ষী দালানগুলোও সংরক্ষণ করতে হবে। সিআরবিকে বাঁচাতে হবে, চট্টগ্রাম শহরের স্বার্থেই সিআরবিকে রাখতে হবে অবিকৃত!

সিআরবি এলাকার মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে বা রাষ্ট্র। এটি জনগণের সম্পত্তি। জনগণের স্বার্থবিরোধী কোন কাজে এটা ব্যবহারের কর্তৃত্ব বা সুযোগ রেলওয়ের নেই। ব্যাপক জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়েই এ সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থ এখানে বিবেচ্য হতে পারে না। এ সম্পত্তি ব্যবহারে কোন কোম্পানির প্রতি বিশেষ আনুকূল্য প্রদর্শনের সুযোগ একেবারেই নেই। সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব যা সরকার মূলত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করে থাকে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ পরিচালনায় বিনিয়োগ রেলওয়ের কর্মপরিধিভুক্ত নয়। আশার কথা যে সিআরবি চত্বরে প্রস্তাবিত হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। চলছে প্রতিবাদ, পালিত হচ্ছে নানাবিধ কর্মসূচি। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সংশ্লিষ্টরা সিআরবি চত্বরে হাসপাতাল নির্মাণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।

এ এম এম নাসির উদ্দিন
সাবেক সচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়,
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট